বিজ্ঞান যখন ব্যর্থ, মুক্তির সকল পথ যখন রুদ্ধ, সভ্যতা আর ক্ষমতার দম্ভ যখন পরাজিত; তখন শুধুমাত্র ধৈর্য আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনাই মানুষের অবলম্বন। বৈশ্বিক মহামারি ‘নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)’ পুরো বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। দুর্যোগের কাছে মানুষের অর্থ, অস্ত্র, ক্ষমতা, সভ্যতাকে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সামান্য উঁচু-নীচুর ব্যবধানেও যেখানে মানুষ মানুষকে প্রতিপক্ষ-প্রতিযোগী ভাবতো, আজ মৃত্যুর ভয় সবাইকে জড়সড় করে ফেলেছে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের বিভেদহীন দূত হিসেবে প্রতিদিন শত শত মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে নতুন নতুন মানুষের দুয়ারে হাজির হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনা। লাখ লাখ মানুষকে সংক্রমণ আর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু বিশ্বকে আজ এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এবারই প্রথম সবগুলো রাষ্ট্র একসাথে একই দুর্যোগের মুখোমুখি। ক্ষমতার দম্ভ ভুলে মানুষের জীবন রক্ষা ও যার যার ভূখণ্ডের মানবতা রক্ষার একমাত্র চিন্তায় নিদ্রাহীন বিশ্বনেতারা। আমেরিকার মতো পরাশক্তি শক্তিহীন হয়ে পড়েছে ভাইরাসের থাবার কাছে। বিশ্ববাজার দখলে রাখা চীন দখলদারিত্ব দেখাতে পারেনি করোনার উপর। ইরানের পরমানু অস্ত্র থামাতে পারেনি মৃত্যুর মিছিল। ইতালির আধুনিকতা, কানাডার সভ্যতা, সৌদি আরবের ধর্মীয় অনুশাসন; সবই তুচ্ছ হয়েছে ক্ষুদ্র-অতিক্ষুদ্র একটি জীবাণুর কাছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র প্রধানের কান্না ও জাতির কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব মানুষকে আরো শক্তিহীন করে দিচ্ছে। সেই তুলনায় আমরা বাংলাদেশিরা করোনা ও তৎসংশ্লিষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় কতোটা সামর্থবান- তা ভাবতে হবে।
আমাদের সরকার করোনা মোকাবেলায় কতটা সফল হবে, সেই চিন্তা এখন আমরা না-ই করি; সরকার যা নির্দেশ দিয়েছে আপাতত সেগুলো রক্ষা করাই কর্তব্য। হোম কোয়ারেন্টাইন (নিজ ঘরে অবস্থান) নির্দেশনা অনুসরণ, নির্ধারিত দূরত্ব (কমপক্ষে তিনফিট) বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি পালন করা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমাদের আর তেমন করণীয় নেই। আমাদের সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। যার যার ঘরে অবস্থান করতে হবে। আসুন আমরা যুদ্ধ করি, ঘরে বসে যুদ্ধ। এবারের যুদ্ধটা পরিবারের খুব কাছের মানুষের সঙ্গে, সমাজের ঘনিষ্ট বন্ধুর সঙ্গেই, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্থ সহকর্মীর সঙ্গে। আমরা কেউ কারো সামনে নিরাপদ নই, কার দেহের জীবাণু কাকে আক্রমণ করবে তা আমরা কেউ-ই বলতে পারবো না।
৫২’র ভাষা সংগ্রাম, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন; একেকটির একেকরকম ভয়াল ইতিহাস আমাদের বাংলাদেশিদের মনে গেঁথে আছে। দেশটা শত্রুমুক্ত তথা স্বাধীন করতে রক্তের বন্যা বইয়ে গেছে। ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই সবুজ-শ্যামল দেশ আজ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পতিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি কাটাতে ধৈর্যযুদ্ধে লড়াই করতে হবে। হাতে অস্ত্র তোলার দরকার নেই, শরীরের রক্ত বিসর্জনের দরকার নেই, শুধু ঘরে থাকলেই চলবে। আসুন না, এই যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনি, আমরা হয়ে উঠি বীর যোদ্ধা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কিছুদিন ঘরের বাইরে যাবেন না। প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু কাউকে ঘরে তুলবেন না। এতে কারো রাগ কিংবা অভিমানের কোনো কারণ নেই, পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করুন। জীবনে বেঁচে থাকলে আমরা আবার সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবো। শুধু যুদ্ধ শেষে বিজয়টা অর্জন হোক।
যুদ্ধকালীন আমাদের কিছু কাজও রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর এবং যেকোনো খাবার গ্রহণের আগে অবশ্যই সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে উভয়হাত (কব্জি পর্যন্ত উভয়পাশ ও নখের ভেতর-বাহিরসহ) ধোয়া, জীবাণুনাশক হ্যা- স্যানিটাইজার ব্যবহার, ঘনঘন বিশুদ্ধ পানি পান, বেশিবেশি ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ, কাপড়, বিছানা, নিত্যব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়মিত পরিস্কার রাখা, ভালোভাবে ধুয়ে ও বেশি সেদ্ধ করে রান্না, অপরিস্কার হাত দিয়ে মুখ, চোখ, নাক স্পর্শ না করা, হ্যান্ডশ্যাক, কোলাকুলি, গা ঘেঁষে না বসা, গাদাগাদি ঘুমানো বর্জন, হাচি-কাশির সময় টিস্যু বা কনুইয়ে ঢাকা, ব্যবহৃত টিস্যু ফের ব্যবহার না করা, বাসাবাড়ি, টয়লেট, রান্নাঘর যথেষ্ট পরিস্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ তথা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। খুব প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক ও গ্লাভস পরিধান করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পাশেই আছেন। মনে রাখবেন, তাঁরা যা করছেন, ভালোর জন্যই করছেন। সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে তাঁদের কাজ করতে দিন। সম্মিলিত সহযোগিতা ছাড়া এ বিপদ ঠেকানো সম্ভব নয়। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষই পারে করোনাকে রুখে দিতে। প্রচুর টাকা কিংবা ক্ষমতা থাকলেও আপনি নিরাপদ নন, ইতিমধ্যেই বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেক ব্যক্তিও এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই প্রতিবেশির পাশে দাঁড়ান। দেশের এই অবস্থায় খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সামর্থ অনুযায়ী সবাইকে তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি বিত্তশালীদের সহযোগিতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে। সরকারি বরাদ্দের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের লোভ ও আত্মসাতের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বেঁচে থাকলে হয়তো আরো অঢেল অর্থের মালিক হতে পারবেন। তাই মানবতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করুন। দেখছেন তো, মৃত্যু কীভাবে তাড়া করে বেড়াচ্ছে! যদি এ যাত্রায় বাঁচতে না পারেন, তবে কোনো কাজেই আসবে না আপনার ধন-দৌলত। সমাজের অসহায়দের সাহায্য করলে, হয়তো তাঁদের দোয়ায় রক্ষা হবে আপনার সম্পদ। দেশটা আবারো হাসি-আনন্দে ভরে উঠলে, তবেই কাজে লাগবে বিত্তশালীর বিত্ত। ভালো থাকবো আমরা সবাই। যে যার অবস্থান থেকে যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হবে। যার যার ধর্ম মতে ঘরে বসে প্রার্থনা করুন, মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ও মুক্তি চান। আসুন নিজে বাঁচি, নিজের পরিবারকে বাঁচাই, দেশ বাঁচাই। বাঁচিয়ে রাখি মানবতা ও আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী।
লেখক: জাকারিয়া জাহাঙ্গীর
কবি, সাংবাদিক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : জাকারিয়া জাহাঙ্গীর করোনাভাইরাস
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh