করোনা পরিস্থিতি ও নবাবজাদা বিতর্ক

নবাবের পুত্রকে বলা হয় নবাবজাদা। এটা সম্মানের না অপমানের সম্বোধন তা বোঝা যাবে কে সম্বোধন করছে এবং কাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তা দিয়ে। সাধারণ কাউকে নবাবজাদা বললে সম্মানসূচক যে হয় না, তা বুঝতে কারোই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। মানুষের মুখের কথায় আর উচ্চারণের ভঙ্গিতে নাকি বুঝতে পারা যায়, তার মনের ভাব। যদিও মনের ভাবকে আড়াল করার দক্ষতা মানুষেরই আছে। মনে যা ভাবে সবসময় তা মুখে বলে না। তবে মানুষ মুখে যা বলে তা দিয়ে মনের প্রকৃত ভাব বুঝা না গেলেও সে কোন সংস্কৃতি ধারণ করে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। একসময় পরিবহনের বাসগুলো ততো উন্নতমানের ছিল না, গাড়ির সৌন্দর্য, গতি, বসার সিটের আরাম কোনো কিছুই এখনকার বাসের মতো ছিল না; কিন্তু বাসের ভেতরে বিভিন্ন উপদেশমূলক বাণী লেখা থাকত। একটা কথা তো বহুল প্রচলিত ছিল, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। যদিও কথাটি বিজ্ঞান ও যুক্তির বিচারে সঠিক ছিল না। কারণ বংশ বিষয়টি সামাজিক বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট। মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে তার সংগ্রাম ও সাধনায়। 

দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আছেন তারা যে সব বিষয়ে বাণী প্রদান করেন, তাতে তাদের রুচির প্রকাশ ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ রুচি সাধারণ মানুষের বুকে আশা জাগায় না বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কতটা অবনমন ঘটেছে আমাদের ক্ষমতাসীনদের মানসিকতার আর কতটা বেড়েছে তাদের ক্ষমতার দম্ভ। এখন করোনা ভীতি ছড়িয়েছে সারাবিশ্বে। সংক্রমণ আর শঙ্কা দুটোই বাড়ছে দ্রুত গতিতে। মানুষের জীবনের ভয় বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। আর বিদ্যুৎ চমকের মতো প্রকাশ করে দিচ্ছে দুর্বলতার চিত্র। মানুষ দেখছে রাষ্ট্রের দায়, সমাজের বন্ধন কতটা শিথিল হয়ে পড়েছে। সমাজ যে এখনো টিকে আছে, উৎপাদন ও উন্নয়ন বাড়ছে তার প্রধান কারণ শ্রমজীবী মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর স্বল্প মজুরির মানহীন জীবনযাপন। স্বল্প মজুরির শ্রমিক বলে পুষ্টিহীন শরীর তাদের কমদামের পোশাক, কায়ক্লেশে যাপন করা জীবন দেখে তাচ্ছিল্য করা সহজ শুধু নয়, তাদের অবদানকে অস্বীকার করাও সহজ। বিদেশে কাজ করছে দেশের ১ কোটি ২২ লাখ মানুষ। কত রকমের কাজই না তারা করে থাকেন সেখানে। কাজ তারা যাই করুক না কেন, মনটা তাদের পড়ে থাকে বাংলাদেশেই। এখানেই তো আছে তাদের মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন। এখানেই গড়ে তুলতে চায় তাদের স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ। বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে যেমন ছুটে আসে, বিপদে পড়লেও ফিরে আসে দেশের মাটিতেই। কারণ তিনি তো বিশ্বাস করেন, এখানেই তার শেকড়। তাই নাড়ির টান আর প্রাণের টান যাই বলি না কেন, সব তো তার দেশের প্রতি। তাদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে দেশের প্রতি যে ভালোবাসা তার প্রকাশ ঘটে আবেগে, গানে। গান শুনে আর গান গেয়ে ভিজে ওঠে তাদের চোখ। গুণ গুণ করে গায়- ‘আমি একবার দেখি বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ’।

ইউরোপসহ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া দেশগুলো থেকে এর ভয়ে ছুটে এসেছে তরুণ যুবকেরা দেশে তাদের মা বাবার কাছে, আত্মীয়-পরিজনের কাছে। যত উন্নতই হোক না কেন, আধুনিক জীবনের যত উপকরণই সেখানে থাকুক না কেন, যেখানে তিনি থাকতেন, সেটা তো তার দেশ নয়। অনাত্মীয় পরিবেষ্টিত বিদেশ বিভুইয়ে, অনেকের মধ্যেও একা একা থাকা মানুষ দেশে এসেছে ভরসা ও ভালোবাসার স্পর্শ পেতে। তিনি তো জানেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত নয়, তারপরও তিনি দেশে এলেন কেন? এর মনস্তাত্ত্বিক কারণটা বোঝা দরকার। তাকে বোঝানো দরকার ছিল, আপনি যে দেশ থেকে এসেছেন সেখানে তো করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে। আপনি যে সংক্রমিত নন, তা তো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই আপনাকে অন্তত ইনকুবিশন পিরিয়ড পর্যন্ত আলাদা থাকতে হবে। কখনো ভাববেন না এটা জেলখানা, এ হচ্ছে আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য নিরাপত্তার আয়োজন মাত্র। আপনার কারণে যেন আপনার বাবা- মা অথবা সন্তান ও প্রিয়জন আক্রান্ত না হয়, তা কি আপনি ভাববেন না? রাষ্ট্র সেটা ভেবেছে এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। আপনি এতে সহযোগিতা করুন। এই আহ্বানে সাড়া দেবেন না প্রবাসীরা, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের জন্য যে ব্যবস্থা করা হলো এবং যে আচরণ করা হলো- তা কি যথার্থ হয়েছে?

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বললেন, ‘প্রবাসীরা দেশে আসলে নবাবজাদা হয়ে যান। তারা কুয়ার‌্যান্টিনে যাওয়ার বিষয়ে খুব অসন্তুষ্ট হন। ফাইভ স্টার হোটেল না হলে তারা অপছন্দ করেন।’ তখন প্রবাসীদের প্রতি ক্ষোভ শুধু নয়, অবজ্ঞাও ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে। প্রবাসীদের প্রতি দায়িত্ব না দয়া কোনটার প্রকাশ ঘটবে আমাদের আচরণে? বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি বলে যা আমরা চিহ্নিত করছি তাকে সহজে প্রকাশ করলে বলা যায়, বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে চারটি খুঁটির ওপর। যেমন- দাঁড়িয়ে থাকে গ্রামের ঘরগুলো। এই খুঁটি চারটি হলো- এক. কৃষক এবং কৃষি। কৃষক নিজে বাঁচতে গিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে গোটা দেশকে। নানা জাতীয় খাদ্য, মাছ, মাংস, সবজি, ফল কি উৎপাদন করেন না তিনি। আর কর্মসংস্থানের এক বিশাল ক্ষেত্র এখনো কৃষি। এই কৃষক সবচেয়ে অবহেলিত শুধু নয়, অসম্মানিত হয় প্রতিনিয়ত। দুই. শিল্প, বিশেষ করে পোশাক শিল্প খাত। যারা রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ জোগানদাতা। তারা বিশ্বে সব চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক শিল্প রফতানির দেশে পরিণত করেছে বাংলাদেশকে। তিন. ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে স্বউদ্যোগে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনকারী। গ্রাম থেকে শহর এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করে তারা লক্ষ-কোটি টাকা সঞ্চালন করে অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছে। তাঁরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে নেয়া ঋণ শোধ করে। কিস্তির চাপ আর অপমানের বোঝা বহন করে চলছে প্রতিনিয়ত। চার. প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ১৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে যারা গত বছর। আমদানি রফতানি আয়ের ঘাটতি মেটাতে এই বৈদেশিক মুদ্রা যে কত প্রয়োজনীয় তা যারা অর্থনীতি নিয়ে খোঁজ খবর রাখেন তারা সবাই জানেন। এরা বিদেশে কাজ করতে গিয়েছে নিজের উদ্যোগে আর বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার পূর্ণ করছেন দেশের জন্য। দেশে যে কাজ করেননি বিদেশের মাটিতে সেই কাজ করেন, কষ্ট আর অপমান সয়ে পরিবারের মুখে হাসি দেখতে গিয়ে নিজে হাসতে ভুলে যান তারা। এদের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদের কি আচরণ দেখি আমরা? দেশে টাকা তৈরি করে এবং বিদেশ থেকে টাকা আনেন যারা তাদেরকে তো আমরা দেখছি। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি না দিয়ে বা সম্মান না করলেও তাদের কাজের সুফল ভোগ করতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের কোনো দ্বিধা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। এরা উপেক্ষিত ও অপমানিত যে হয় করোনাভাইরাস আক্রমণের সময় তা আবার দেখাল সেটা। কিন্তু কৃষি, শিল্প, ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতা আর প্রবাসী এই চার খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরের সম্পদ দুর্নীতি, অপচয়, লুটপাট, চুরি, ও পাচার যারা করে তাদের কি নামে ডাকা যেতে পারে? ১০ বছরে ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার, কানাডা মালয়েশিয়াসহ বিদেশে সেকেন্ড হোম করে পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দেয়া, সরকারকে আয়কর, শুল্ক না দেয়া, খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করা, শেয়ার মার্কেটে জালিয়াতি করা, ব্যাংকগুলোকে ধসিয়ে দেয়া, সিন্ডিকেট করে কৃষকের ফসলের দাম কম দেয়া আর বাজারে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করে- যারা কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়েছে, তারা তো অচেনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ধর্ম সব কিছুকেই পণ্য বানিয়ে মুনাফা লুটছে যারা- কি নামে ডাকবো তাদের? ড. আকবর আলী খান তার ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে একটা প্রবন্ধের নাম করেছিলেন, ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’। ব্রিটিশ আমলের আসানসোলের মহুকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটের সঙ্গে এক পাঞ্জাবি ঠিকাদারের কথোপকথনের বর্ণনা করেছেন- পাঞ্জাবি ঠিকাদার বলছিল, হুজুর এদেশে তিন ধরনের মানুষ আছে। এক যারা ঘুষ খায় না, দুই- যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে। আর তিন নম্বর যারা ঘুষ খায়; কিন্তু কাজ করে দেয় না, এরা হলো শুয়োরের বাচ্চা। আকবর আলী খানের খেদোক্তি হলো- দেশে এখন শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি চলছে। আকবর আলী খানের মতো এভাবে বলে কাউকে অপমান করা উচিত নয় বলে মনে করি। কিন্তু যারা প্রবাসীদের টাকায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে প্রবাসীদেরকেই নবাবজাদা বলে কটাক্ষ করে তাদের হারামজাদা বললে কথাটা খুব খারাপ শোনাবে; কিন্তু প্রবাসীদের কেউ কেউ রাগে ক্ষোভে এমন কথা বলেছেন বলে প্রচার মাধ্যমে এসেছে। প্রবাসীদের এই ক্ষোভকে বিবেচনায় নেয়া উচিত।

রাজেকুজ্জামান রতন

কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //