মনকে স্বাধীন করার কাজটাই রয়ে গেল বাকি

আমাদের মননে ইউরোপ, প্রধানত ব্রিটেন ও আমেরিকা, এখনো নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে বটে; কিন্তু মনোজগতের ঔপনিবেশিকতা থেকে এখনো আমরা মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, অভিসন্দর্ভ সব রচনায় ঔপনিবেশিক প্রভুর অনুসরণ। এই তথ্য এডওয়ার্ড সাঈদ পরিবেশন করার আগেই অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীর চিন্তাতে এসেছিল। নিজস্ব পথ নির্মাণের তাগিদ অনুভব করেছিলেন অনেকেই। পরের অনুকরণ ও পরের আরোপিত চিন্তাধারা দিয়ে যে নিজেদের জন্য আলাদা ও পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য নির্মাণ আদৌ সম্ভব নয়; সে বিষয়ে যেমন সিরিয়াস লেখালেখি করেছেন, তেমনিভাবে বৈঠকি ভঙ্গিতে বারবার আলোচনা করেছেন বিনয়কুমার সরকার। আমাদের মনোজগতে চল্লিশের দশকে অন্তত সাত-সাতটি বিদেশি প্রভাব কার্যকর ছিল। তাঁর মতে, ঊনবিংশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির বাচ্চারা বিদেশি মাল খেয়ে মানুষ হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতেও অপ্রতিহত সেই বিদেশি মাল। দেড়-দুইশ বছর ধরে বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল বিলাতি মনন-চিন্তন। ঊনবিংশ শতকের তথাকথিত আধুনিক সংস্কৃতির শুরুই হয়েছে বিলাতের ভাষা, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ওপর ভর করে। ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফরাসি বিপ্লব ও ফরাসি সাহিত্য-সংস্কৃতি কিছুদিন ঢেউ তুলেছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে। ফরাসি কোৎ-দর্শন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমের ওপর। অনেকেরই ধারণা, বঙ্কিমের হিন্দু ধর্মদর্শন পুরোটাই কোৎ-প্রভাবিত। ১৮৭০-৮৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন বিপ্লব ও সংস্কৃতি নিয়েও কিছুটা ঢেউ উঠেছিল। সেই সময় হেমচন্দ্র মার্কিন-প্রশস্তি লিখেছেন, ‘হোথা আমেরিকা নব-অভ্যুদয়/পৃথিবী গ্রাসিতে আসিছে আশয়’। একেবারে যথার্থ ভবিষ্যৎ অনুধাবন। নিজের বাণী বিশ্বমাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমেরিকাকেই বেছে নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। ইতালিয়ান আর জার্মান প্রভাব বাংলায় আসে একসঙ্গে। ১৮৬০-৭০ সালের মধ্যে ইতালির স্বাধীনতা অর্জন এবং জার্মান-সাম্রাজ্যেরও প্রতিষ্ঠা। এই দুই ঘটনা বাঙালিকে কিছুটা চাঙ্গা করে তুলেছিল। ইতালিয়ান মাৎসিনি আর জার্মান বিসমার্কের নাম না নিলে কোনো বাঙালি কংগ্রেসির তিন বেলার ভাত হজম হতো না। মাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির জীবনী সব শিক্ষিত বাঙালি তরুণের অবশ্যপাঠ্য ছিল। যোগীন বিদ্যাভূষণ ছিলেন এই আন্দোলনের চাঁই। সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন শীল, বিপিন পাল প্রমুখ দেশনায়করা সারা দেশে মাৎসিনি সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছেন। আর বিনয়কুমার সরকারের সরাসরি অভিমত হচ্ছে, ব্রজেন শীল, সতীশ মুখোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, হীরালাল হালদার প্রমুখ প-িতরা বিবেকানন্দর যুগে জার্মান হেগেল খেয়ে মানুষ হয়েছে। ভারতবর্ষীয় ঐক্যের প্রবক্তারা কথায় কথায় বিসমার্ক প্রবর্তিত জার্মান ঐক্যের উদাহরণ দিতেন। ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় উদ্যোক্তাদের সামনে ছিল জার্মান আদর্শ। রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রিডারিখ লিখ্টের দারুণ ভক্ত। সবশেষে এলো রুশ প্রভাব। মানবেন্দ্রনাথ রায়, ভূপেন দত্ত, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ‘মস্কো থেকে হজ’ করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বলশেভিক বিপ্লবের বাণী প্রচারে। রুশপ্রভাব অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। তবে প্রথম থেকে অদ্যবধি বাঙালি বিশ্ব দেখতে অভ্যস্ত ইংরেজের চোখেই। বিনয়কুমার সরকার আক্ষেপ করে বললেন, ‘এই জন্য আজ পর্যন্ত বঙ্গ সন্তানের চোখ ফুটল না। আমাদের অধ্যাপক, বিজ্ঞান-গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, বণিক, মজুর-নায়ক ইত্যাদি নানা পেশার লোকেরা অত্যাধিক ইংরেজ-চোখো লোক। আমাদের সংস্কৃতি বিলাতি সংস্কৃতির মফস্বলে পরিণত হয়েছে। বিলাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী অধ্যাপকগুলো যুবক-বাঙালিকে ইংরেজের সত্যিকারের গোলামে পরিণত করে ছেড়েছে।’

এই পরিস্থিতি এখনো অটুট, বলা যায় আশঙ্কাজনক হারে বর্ধিষ্ণু। ব্রিটিশের বদলে প্রধান জায়গা নিয়েছে কেবল আমেরিকা। ঔপনিবেশিকতা আরও বেশি প্রকট হচ্ছে। আমাদের সাহিত্যের জগতে এই প্রবণতা একবারে মহামারির আকার ধারণ করে আছে। ছেদ টেনে দিয়েছে আবহমান বাংলার সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে আমাদের উত্তরপুরুষদের। আমরা নিজেরা সেই হারানো সূত্রের সন্ধান না করে সাহিত্যে চালিয়ে যাচ্ছি ঔপনিবেশিক আকরণ ও অবয়ব। ফলে আমাদের রচনা বাংলায় লেখা হলে তা ‘বাংলার’ কি না এই সন্দেহ সবসময় থেকেই যাচ্ছে, কখনো প্রচ্ছন্নভাবে কখনো প্রকটভাবে। উপনিবেশবাদের পত্তনে শুধু মসলিন শিল্পই নয়, ভেঙে গেল আমাদের ওই সাহিত্যিক ধারাবাহিকতারও উপলব্ধি। অস্বীকৃত হলো, লেখক ও পাঠকের দ্বিবাচনিকতার আকরণ। বাংলা উপন্যাসের তথা কথাসাহিত্যের জন্মের পরিপ্রেক্ষিত এটাই। এলো ইউরোপীয় কাঠামো। পাশ্চাত্যের সঙ্গে তুলনা না করতে পারলে কাউকে যেন কোনো ধরনের স্বীকৃতি প্রদান ছিল এককথায় অসম্ভব। যে ইংরেজের সঙ্গে তুলনা করা হতো, যাকে মান বা স্ট্যান্ডার্ড ধরা হতো তার মান অনেক সময়ই উপমিতর তুলনায় কমই ছিল। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রকে আখ্যা দেওয়া হতো ‘বাংলার ওয়াল্টার স্কট’ নামে। অথচ অসুস্থ স্বাদেশিকতার কথাটা বাদ দিলে অন্য সব ক্ষেত্রেই বঙ্কিমের প্রতিভা ও কৃতি ওয়াল্টার স্কটের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। যদিও আবহমান বাংলার সাহিত্য-প্রাকরণিক ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই, কিন্তু তাঁর লিখনশৈলীর শক্তিমত্তাকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় নিন্দুকের জন্যও রাখেননি। তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। সেই ক্ষতির বিবরণ সংক্ষেপে সার আকারে তুলে ধরেছেন দেবেশ রায়, ‘বাংলা উপন্যাসে সঞ্চারিত হয়নি লোকায়তের পৌরুষ, বাংলা উপন্যাসের কাহিনিতে আসেনি পুরাণ বা মিথ, ভাষার লোকায়তিক পেশি, বাংলা উপন্যাসের সংলাপে আসেনি আমাদের প্রতি ক্রোশে আলাদা উপভাষার খর চলিষ্ণুতা ও ব্যঙ্গশ্লেষ রসিকতার শান! এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল আর এই সমুদ্রকে অন্বিত করে যে-মানুষ সে তার নিজের বাঁচার কাহিনি নিয়ে আমাদের উপন্যাসে এল না। আমরা উপন্যাসে কাহিনি খুঁজেছিলাম, কাহিনীর সেই মায়ামৃগ আত্মপরিচয় থেকে আমাদের আরও দূরে সরিয়ে এনেছে।’

এই পর্যন্ত কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। কারণ আমরা যারা এখন ‘বাংলাদেশের বাংলা গল্প’ লিখব বলে নিজেদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাদের হারিয়ে যাওয়া আবহমান পথ ফের খুঁজে নেয়া ও ধসে যাওয়া আবহমান সাঁকোর পুনর্নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।

সমস্যা তৈরি হয় যখন শিকড় খোঁজার নামে ধর্মীয় মৌলবাদ ঢুকে পড়ে আমাদের সাহিত্যের নিটোল সবুজ করুণ জমিনে।

সমস্যার সূত্রপাত ঘটানো হয় সুকৌশলে ছদ্ম মৌলবাদী বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা। বিশ্বব্যাংকের নাগপাশ, পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সর্বব্যাপী শোষণ, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ দখল নিতে বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদীদের কাড়াকাড়ি, মুসলিম বিশ্বের ওপর মার্কিনি-নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যক্ষ আগ্রাসন, বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের লজ্জাহীন দৃষ্টান্তস্থাপন- সব মিলিয়ে পশ্চিমাবিরোধী একটি হাওয়া আমাদের দেশে প্রবহমান এবং ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ের পথে। এই পথেই ঢোকার অপচেষ্টা মৌলবাদীদের। গরিব-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির অন্যতম আদর্শ মার্কসবাদকে ‘ইউরো-মতবাদের’ ছাপ মেরে মানুষের মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টায় তারা অত্যন্ত তৎপর। মার্কসবাদের এমন সব যান্ত্রিক ব্যাখ্যা তারা উত্থাপন করছে মানুষের সামনে, যাতে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা প্রগতিশীল লেখকরা পর্যন্ত অনেক সময় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এই বিভ্রান্তি সবচেয়ে বেশি ঘটছে তরুণ লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে।

মার্কসবাদকে প্রয়োজনে পরিত্যাগ করতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। যদি তা আমাদের চিন্তার মুক্তি ও শোষণমুক্তির আন্দোলনে সহায়ক না হয়ে প্রতিকূূলতা নিয়ে আসে, তবে অবশ্যই তা বিষবৎ পরিত্যাজ্য। তবে তার জন্য যে ব্যাপক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিতর্কেরও প্রয়োজন, সেই সুযোগটুকু মার্কসবাদকে দেয়া হোক- এটাই সময়ের দাবি। শত বছরব্যাপী মানবমুক্তির সংগ্রামে বিপ্লবীদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মার্কসবাদ ও মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব এটুকু দাবি তো করতেই পারে। আর বাংলাদেশে যতটুকু প্রগতিশীল সৃজনশীলতা দেখা গেছে, তার সবটুকুই মার্কসবাদীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। 

মার্কসবাদকে আমরা, আমি নিজেও, চিনেছি অর্থনীতির অসমতা দিয়েই। কিন্তু মনোজগতের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার যে পথ মার্কসবাদে রয়েছে, যা দিয়ে নিজেদের মুক্তিপ্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন, ফ্রানজ ফ্যানো প্রমুখ, সেই কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করাটাই তো হলো না আমাদের। আমার।

বাকির খাতায় আর কতদিন ফেলে রাখব তাকে?

জাকির তালুকদার

কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //