বাইরে ভাইরাস, ভেতরে ক্ষুধা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র পৃথিবী আর মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ এবার সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মখোমুখি হয়েছে। বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সামরিক ক্ষমতাধর, প্রযুক্তি মোড়ল ও নামিদামি রাষ্ট্রগুলো নিজেদের সভ্যতা, ক্ষমতা, আধুনিকতা- কোনোটা দিয়েই পরাস্ত করতে পারছে না করোনাভাইরাসকে। 

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগম কমাতে বলা হচ্ছে সব দেশেই। অধিকাংশ দেশের লকডাউন আর বাংলাদেশে টানা ছুটির কারণে স্থবির হয়ে গেছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষজন। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষদের পড়তে হয়েছে অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে। করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে খাবার নিশ্চিত করা। মানুষকে ঘরে রাখতে খাদ্য সরবরাহের বিকল্প নেই।

আমাদের দেশ উন্নয়নশীল। দেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সরকারি তথ্য আমরা যা জানি, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সে তুলনায় কতোটা উপকারভোগী- সেটাই বড় প্রশ্ন। উন্নতবিশ্বের সাথে বাংলাদেশকে মিলাতে গেলে শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু দেশের সিংহভাগ অর্থ সমাজের মুষ্টিমেয় শ্রেণির হাতে আবদ্ধ থাকায় ধনী-গরীবের বিরাট ফারাক। বিত্তশালীরা যে হারে ক্রমেই ধনী হচ্ছেন, আনুপাতিক হারে গরীবরা সে তুলনায় এগোতে পারছেন না। তাই সমাজে উন্নয়নের সুষম বণ্টন নেই, মানুষে-মানুষে সমতা নেই। দেশের যে কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে শুধু সরকারের উদ্যোগের দিকেই তাঁকিয়ে থাকতে হয় দেশবাসীকে। বেসরকারি সাহায্য-সহায়তা যে হারে থাকবার কথা, তেমনটা লক্ষ্য করা যায় না। আজ দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে সরকারকে সহযোগিতা করবার মতো, মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে বাঁচাবার মতো ধনবানের খুব একটা দেখা নেই। যারা এগিয়ে আসছেন, মোট ধনশালীর একভাগও হবে কি-না সন্দেহ। যারা এখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন, তারা একবারও ভাবছেন না যে, টাকা কিংবা ক্ষমতা থাকলেও আপনি নিরাপদ নন, বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেক ব্যক্তিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। একবারও ভাবছেন না, মৃত্যু আপনাকেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে! যদি এ যাত্রায় বাঁচতে না পারেন, কোনো কাজেই আসবে না আপনার ধন-দৌলত।

কর্মহীন মানুষ এখন দিশেহারা। খাদ্যের যোগান যথেষ্ট নয়। ঘরে বসে থাকলে ক্ষুধার জ্বালা, বাইরে গেলে ভাইরাস- এই নিয়ে এখন নিম্ন আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তা। দৈনিক আয়ের উপর যারা নির্ভরশীল সে সব নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো আহার যোগাতে ভাইরাসের ভয় উপেক্ষা করে যারা বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের প্রশাসনের সামনে পড়তে হচ্ছে। কোথাও কোথাও শিকার হচ্ছেন পিটুনি কিংবা লাঞ্ছনার। দরিদ্র মানুষের চিন্তা, করোনার আগে কি ক্ষুধায় মরবেন? তাই মানুষকে ঘরে রাখবার জন্য সরকারকে প্রতিটি ঘরে খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। খোঁজ নিতে হবে, যা বরাদ্দ হয়েছে সেগুলো সঠিকভাবে বিতরণ চলছে কি-না। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, প্রতিটি জেলায়-উপজেলায়, প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভায় করোনা মোকাবেলায় ফান্ড গঠনের নির্দেশ দিন। সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে ডিসি-এসপি, ইউএনও-ওসিদের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দা শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কোটিপতিদের তালিকা করে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করুন। সরকারি বরাদ্দ ও ওই বিশেষ ফান্ডের টাকা মিলিয়ে প্রতিটি ঘরে খাবার পৌঁছাবার ব্যবস্থা করুন। শুধুমাত্র চাল-ডাল বিতরণেই চলবে না, ন্যূনতম ভাত রান্না করে খেতে চাইলেও লবন-মরিচের দরকার আছে। একজন ব্যক্তি চাল আর ডাল পেলে তাকে অন্য কিছু কিনতে বাজারেই যেতে হয়। এতে সামাজিক দূরত্ব অমান্য করা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে স্থানীয় কাউন্সিলর ও ইউপি মেম্বারদের মাধ্যমে খিচুড়ি রান্নার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, শুকনো খাবার প্রদান করা যেতে।

একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, প্রান্তিক পর্যায়ে চাল-ডাল বিতরণের ক্ষেত্রে দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি ভিন্নমতের লোকদের ত্রাণ থেকে বঞ্চিত করছেন। উপকারভোগীদের তালিকা তৈরি করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা বাধ্যতামূলক করায় বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। যাদের পরিচয়পত্র করা হয়নি বা হারিয়ে গেছে, বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। বিষয়টি প্রশাসনকে বুঝতে হবে, মানবিক কারণে এই নিয়ম বাদ দিতে হবে। কবি সুকান্ত বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। তাই এখন কোনো নিয়মের ফাঁদে ফেলে, রাজনৈতিক পরিচয় লেপ্টে দিয়ে কাউকে বঞ্চিত করবেন না। পাশাপাশি সমাজের যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত, যারা দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল (আয় করেন তো ভালো চলেন), তাদের কর্ম বন্ধ হয়ে পড়ায় তারা চক্ষু লজ্জ্বায় হাত পাততে পারছেন না। প্রশাসন ও বিত্তবানদের প্রতি অনুরোধ করবো, ওইসব মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের ব্যাপারে ভাবতে হবে, খবর পাওয়া মাত্রই গোপনে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন, কিছু খাবার পৌঁছে দিন। দেখবেন, এ ঋণ তারা ভুলবেন না, ঠিকই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। 

শুধু মানুষ নয়, সমাজের অভূক্ত প্রাণিদের ব্যাপারেও আমাদের করণীয় আছে। যারা আমাদের প্রকৃতিকে সুন্দর রাখে, যারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, শহর-বন্দরের হোটেল-রেস্তোরা বন্ধ থাকবার কারণে সেইসব প্রাণিরা এখন খাবার পাচ্ছে না। ৩ এপ্রিল (শুক্রবার) রাজশাহী শহরের ক্ষুধার্ত পাঁচটি কুকুর শহীদ এএইচএম কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যানের চিড়িয়াখানায় ঢুকে চারটি হরিণকে ছিঁড়ে খেয়েছে। কুকুর-বেড়াল, কাকসহ আমাদেরই প্রতিবেশি পশুপাখিরা ডাস্টবিনের পঁচা-বাসি খাবার পাচ্ছে না। নায়িকা জয়া আহসান বাসার আশেপাশের অভূক্ত কুকুরদের খাওয়াচ্ছেন; খবরটি মিডিয়ায় প্রচার হলে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। আমার ভালো লেগেছে এই দৃষ্টান্তটি। পিরোজপুরের ইয়ূথ সোসাইটি শহরের অভূক্ত প্রাণিদের প্রতিরাতে খাবারের ব্যবস্থা করেছে। দিনাজপুরের খানাসামা উপজেলার সন্তান লিয়ন চৌধুরী খিচুড়ি রান্না করে ঘুরে ঘুরে শহরের কুকুরদের খাওয়াচ্ছেন। খবরগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, মানবতা বেঁচে থাকবার আশা জাগায়। সকলকে ভাবতে হবে, সমাজটা আমাদেরই।

জনপ্রতিনিধিদের বলছি, খাদ্যসামগ্রী বিতরণকালে দয়া করে ফটোসেশন বন্ধ করুন। সামান্য কিছু চাল-ডাল নিতে আসা মানুষকে ছবি তোলার নামে বিব্রত করবেন না। এরা আপনার দয়া নিচ্ছেন- এমনটা ভাববেন না। মনে রাখবেন, যাদের হাতে-পায়ে ধরে ভোট ভিক্ষা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোটা আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ একটা পোটলা হাতে নিয়ে কিছুদূর হেটে একজন মহিলার হাতে তুলে দিলেন, তার দিকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলতে ব্যস্ত পনের-বিশজন। এসব তামাশা বাদ দিন। গণমাধ্যমের উচিৎ, এ সব সংবাদ এড়িয়ে যাওয়া।

একটি বিষয় না বললেই নয়; গার্মেন্টসগুলো বন্ধ রাখা না রাখা নিয়ে বিজিএমইএ’র গড়িমসিতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে হলো শ্রমিকদের। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেও গার্মেন্টস খোলার কথা থাকায় পেটের দায়ে ও চাকরি রক্ষার তাগিদে হাজার হাজার শ্রমিক ময়মনসিংহ থেকে একশ’ বার কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে ঢাকায় রওনা করেন। অপরদিকে রাঙ্গামাটি থেকে সত্তর কিলোমিটার পাহাড়ি ও সমতল পথ হেটে চট্টগ্রামে রওনা করেন শ্রমিকরা। সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয়নি তাদের। অথচ রাতে জানানো হয় ছুটির মেয়াদকাল বৃদ্ধির খবর। কারখানা মালিকদের এমন খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের জন্য হয়তো দেশবাসীকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। বাড়তে পারে করোনার ভয়াবহতা। এ অবস্থায় যদি কোনো শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হন, তিনি যে কারখানায় কর্মরত তা চিহ্নিত করে যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় মালিককে বহন করতে হবে। কোনো শ্রমিক করোনায় মারা গেলে, পরিবারকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানে মালিককে বাধ্য করতে হবে। পাশাপাশি ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়ায় তিনটি কারখানায় তিনশ’ বাষট্টিজন শ্রমিককে করোনা সঙ্কটের মধ্যেই চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। গার্মেন্টস মালিকদের এহেন কর্মকাণ্ডে এটাই প্রমাণ হয় যে, তারা দেশের অর্থনীতির চাকা নয়; বরং নিজেদের ভাগ্যের চাকা সচল রাখতেই মরিয়া। 

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনার দিকে থাকিয়ে আছে দেশ। দেশবাসীকে রক্ষায় আরো কঠোর হোন। যারা নির্দেশ অমান্য করবে, দায়িত্বে অবহেলা করবে, সরকারি বরাদ্দের নয়-ছয় করবে; তাদের বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতর সাজার ব্যবস্থা করুন।

লেখক: জাকারিয়া জাহাঙ্গীর

কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।



লেখকের ঠিকানা:

জাকারিয়া জাহাঙ্গীর

(কবি, সাংবাদিক ও জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখক। তিনটি এককসহ ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত)।

আল-আমিন হোমিও হল, মহিলা কলেজ মোড়

সরিষাবাড়ী, জামালপুর।

ঊ-সধরষ: সুলধযধহমরৎ@মসধরষ.পড়স

মোবাঃ ০১৭১৪ ৬৩ ৬১ ৮৭।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //