করোনাভাইরাসের নিজস্ব কোনো উচ্চাশা নেই

আমাদের জীবনকালে আমরা বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, বৈশ্বিক মহামারি যেমন- বার্ড ফ্লু, সার্স, মার্স, ইবোলা ইত্যাদি দেখেছি; কিন্তু এই কোভিড-১৯ সবকিছুকে ছাপিয়ে এমন এক পৃথিবীর সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে যে, পৃথিবী আমাদের কাছে একেবারেই অচেনা। আমরা সবাই জানি, চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে এই ভাইরাসটি পৃথিবীর ১৯৯ দেশে আঘাত করেছে। বদলে দিয়েছে জীবনের সব হিসাব এবং চেনা সমীকরণ। আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে ভেঙে পড়ছে বৃহৎ সব কাঠামো- অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি- যেই কাঠামোগুলোতে আমাদের চিরায়ত আস্থা ছিল। পৃথিবীর মানুষ ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। আমাদের জীবনে আমরা এমন সময় আর কখনো দেখিনি। গত ১০ দিন ধরে আমরা নিজের ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছি। কতদিন এভাবে থাকতে হবে, কেবল ভাইরাসটিই বলতে পারবে, মানুষের পক্ষে বলা দুষ্কর। ইংল্যান্ডের প্রিন্স চার্লস ও প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পর রানী এলিজাভেথ-২ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কারণ তিনি বিগত ১১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বরিসের সঙ্গে সামনাসামনি বৈঠক করেছেন।

মানব ইতিহাসের আদিলগ্ন থেকেই মহামারি ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো মহামারিরই কিছু কারণ এবং কিছু পূর্বাভাস থাকে। ফ্র্যাঙ্ক স্নোডেন তার বিখ্যাত ‘এপিডেমিকস অ্যান্ড সোসাইটি: ফ্রম দ্য ব্ল্যাক ডেথ টু দ্য প্রেসেন্ট (২০১৯)’ বইটিতে বলেছেন, ‘Epidemic diseases are not random events that afflict societies capriciously and without warning. Every society produces its own specific vulnerabilities. To study them is to understand that society’s structure, its standard of living, and its political priorities.’ অর্থাৎ ‘সংক্রামক রোগ কোনো দৈব ঘটনা নয়, যা মানুষের সমাজকে কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই খামখেয়ালিভাবে পীড়িত করে। প্রত্যেক সমাজই তার নিজস্ব নির্দিষ্ট দুর্বলতা তৈরি করে। সেসব বিষয় অধ্যয়ন করতে হলে সেই সমাজের কাঠামো, তার জীবন মান এবং তার রাজনৈতিক অগ্রাধিকারসমূহ বুঝতে হবে।’

এখন এটা খুব একটা ভেবে দেখার সময় নয় কেন বা কার কারণে কিংবা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসটি সংক্রমণ শুরু হলো, বরং কীভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটাই এখন মূল এজেন্ডা। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, মহামারি শুধু  প্রাকৃতিক বিষয় তা নয়, এটা সাংস্কৃতিকও। 

এক সময় কলেরা বিরাট সংক্রমণে পরিণত হয়েছিল, যখন মানুষ নগরে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল; কিন্তু তাদের পয়ঃব্যবস্থা একটি মান পর্যায়ে উন্নত করার আগ পর্যন্ত তা কমছিল না। কলেরাই আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে আমাদের নিজেদের মল-মূত্র ব্যবস্থাপনা করতে হবে। 

করোনাভাইরাস কোন ধর্মে কী বলছে, কোন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী, কাকে পুনর্বার নির্বাচিত হতে হবে ইত্যাদি পরোয়া করে না। সেই অর্থে ভাইরাসের আছে এক নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সত্তা, যার কোনো লিবারেল কনজারভেটিভ, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, আওয়ামী লীগ-বিএনপির পক্ষপাতিত্ব নেই। এ ভাইরাসের নিজস্ব কোনো উচ্চাশা নেই। নেই তার কোনো নিজস্ব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রয়োজন কিংবা বাসনা। কারণ এ ভাইরাসের নিজস্ব কোনো মস্তিষ্ক নেই। এটাই এক নিদারুণ বিপন্নতা আর অসহায়ত্ব যে মানুষ প্রাণীজগতে তার সবচেয়ে বড় আর ক্ষমতাবান মস্তিষ্ক নিয়েও একটি মস্তিষ্কহীন অনুজীবের সঙ্গে পেরে উঠছে না। 

নব্য উদার অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা পরার্থপরতাকে এক দুরারোগ্য ব্যাধি আখ্যায়িত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকেই সব রোগের উপশম বানিয়ে বিশ্বকে এক নাজুক বিভীষিকায় পরিণত করেছে। যখন মহামারির মতো বিপদগুলো আসে, তখন আমরা জানি পরস্পরের ওপর আস্থা আর ভালোবাসাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে এবং যে কোনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করে। 

আমরা জানি যে, বহু ব্যক্তি আর পরিবার এই করোনা উদ্ভূত লকডাউন মানতে পারছে না। তাদের জীবন আর জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। অনেকেই বলছে, আমি করোনায় মরার আগে ক্ষুধায় মরে যাব। রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এমনকি এই বিপদের দিনে হ্যান্ড সেনিটাইজারও দিতে পারছে না। বিত্তবানরা টাকা দিয়ে এতদিন সব কিছু কিনেছে; কিন্তু করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি কিনতে পারছেন না। আমাদের একমাত্র অবলম্বন এখন সচেতনতা আর মানুষ হিসেবে সবচেয়ে বড় ক্ষমতাটিকে সামনে নিয়ে আসা। সেই অসম্ভব ক্ষমতাটির নাম হলো ‘মানুষের জন্য ভালোবাসা’। সেই ভালোবাসা থেকেই ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা সেনিটাইজার বানিয়ে গরিব মানুষদের বিতরণ করছে। যেই ভালোবাসার শক্তিতেই স্বাস্থ্য কর্মীরা, চিকিৎসকরা জীবন বিপন্ন করে অসহায় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সেই ভালোবাসার পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আজ আমাদের করোনাকে জয় করতে হবে। 

কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি; কিন্তু যে ভ্যাকসিন মানব সভ্যতাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঁচিয়ে রেখেছে, তার নাম ‘ভালোবাসা’। এই ‘ভালোবাসা’র শক্তিই বিপদের দিনে আমাদের শৃঙ্খলা দেবে, করোনার করাল গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে রাখবে।

একেএম মাজহারুল ইসলাম

এডজাঙ্কট প্রফেসর

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //