আমাদের পথ

[বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম এর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮১ সালের ৩০মে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিচের লেখাটি প্রকাশ করা হলো]

মানুষের কর্ম, চিন্তা-ভাবনা, রাজনীতি এ সব কিছুই নির্ণীত ও পরিচালিত হয় একটা বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এ জীবন দর্শনের তারতম্য ঘটতে পারে। তাই কোন কোন মানুষের রাজনীতি ও জীবনদর্শন ভীতির উদ্রেক করলেও সব সময় তা বিপজ্জনক বা অকল্যাণজনক নাও হতে পারে। বস্তুত কোন কিছুকে অবলম্বন না করে কোন রাজনীতি, কোন দর্শনের উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটতে পারে না।

উদাহরণ স্বরূপ মার্কসইজম এর কথা বলা যেতে পারে। যদি আমরা মার্কসইজম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করি তাহলে দেখা যাবে এর একটা আদর্শ এবং লক্ষ্য আছে। এ আদর্শ ও লক্ষ্যকে ভিত্তি করেই রাশিয়ায় মার্কসইজম কায়েম হয়েছে। একথা আজ বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মার্কসইজম এর প্রভাব না ঘটলে রুশ জাতি এতটা উন্নত অবস্থায় উপনীত হতে পারতো না। হয়তো বা সেখানকার সাধারণ মানুষের আরও অবনতি ঘটতো।

এই যে আমরা সবাই রাতের বেলায় আলো জ্বালাই এর পেছনেও যুক্তি আছে। ভিত্তি আছে। রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার পেছনেও রয়েছে একটা ভিত্তি। এ ভিত্তিটা কি? অপরাপর বিরোধী রাজনৈতিক দর্শনকে যথার্থভাবে যুক্তি ও কর্মসূচিসহ মুকাবিলা করে স্বীয় জীবনবোধের আলোকে সমাজ ও জাতিকে গড়ে তোলা এবং কখনো কখনো পথভ্রষ্ট স্বেচ্ছাচারের কাছ থেকে বাঁচার তাগিদই হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতের পতাকাতলে সমবেত হবার মৌল কারণ। এর অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, রাজনীতি, রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাস মানুষের একটা সুষ্ঠু সুন্দর চেতনাবোধ।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ একটা গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে তুরস্ক, মিসর, মরক্কো এবং স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থানের একটা সাদৃশ্য আছে। বাংলাদেশ এ উপমহাদেশে ও এ অঞ্চলের সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত আর দক্ষিণে সুগভীর বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখণ্ডের বৈচিত্র্য দিয়ে। তাই বাংলাদেশ ভূখণ্ডটিতে অতীতে অনেক উত্থান-পতন ঘটে গেছে।

হাজার হাজার বছরের পটপরিবর্তনের ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ। এখানে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, ইংরেজ জাতি এ উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশ কায়েমের প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল কেন? উপমহাদেশের অন্য যে কোন স্থান তারা প্রথমে দখল করতে চাইলে নিশ্চয়ই পারতো। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা এ জন্যে বেছে নিয়েছিল যে, এখান থেকে অন্যান্য স্থানে চলাচল সুবিধা হবে। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান ও আকার তাতে এখান থেকে পশ্চিমে পূর্বদিকে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করাও সুবিধাজনক বলে ইংরেজগণ এ স্থানকে প্রথমে বেছে নিয়েছিল। সুচতুর ইংরেজের এ পরিকল্পনা এতটা নির্ভুল ছিলো যে, পর্যায়ক্রমিকভাবে তারা গোটা ভারতবর্ষ এবং ব্রহ্মদেশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

এ থেকে তাই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের ছিলো এক বিরাট স্ট্রাটেজিক অবস্থান এবং বলা বাহুল্য যে, সেই অবস্থান আজও গুরুত্বপূর্ণই রয়ে গেছে। এ কারণেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশির ওপর এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এবং পরাশক্তিগুলোর অশুভ দৃষ্টি রয়েছে। যা আমাদের জন্যে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ। কাজেই বাংলাদেশের নয় কোটি মানুষের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে এবং এই আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদী চেতনা। কারণ জাতীয়তাবাদী চেতনাই দেশ জাতিকে বহিঃশক্তির হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ যখন হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তখনই জাতীয়তাবাদী চেতনার পথ অবলম্বন করেছে। জার্মানির হিটলারও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু নয়। তারা জার্মান এরিয়ান জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল।

পঞ্চাশ দশকে জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায় সমগ্র আরব জাহানে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টা চলেছিল। মিসরের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এতে কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার সুফলও তাঁরা পেয়েছেন। জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঝড় আজ প্রবাহিত হয়ে চলেছে কালো আফ্রিকার এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। বিদেশীদের দ্বারা শোষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়ে আজ তারা ‘আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ’ এর আদর্শকে গ্রহণ করেছে।

ফলে তাদের মধ্যে একতার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয়তাবাদের আবার রকমফের আছে। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ‘জাতীয়তাবাদ’ বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্নভাবে কার্যকর হয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ। কেউ ভাষাভিত্তিক আবার কেউ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সমর্থক। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন আঞ্চলিক মতাদর্শ পরিচালিত হচ্ছে।

অন্যদিকে রয়েছে অর্থনীতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হিসেবে ই ই সি। একে আমরা যুদ্ধভিত্তিক জাতীয়তাবাদও বলতে পারি। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিকভিত্তিক। এ জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে জাতিগত, চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিক বোধ, অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের উন্মাদনা। অন্যদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। অকারণে এ দাবি নয়। বিশ্বের অপরাপর দেশের নেতৃবৃন্দ ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিবর্গের মতে বাংলাদেশে আগের তুলনায় অনেক পরিমাণে স্থিতিশীলতা এসেছে। এ স্থিতিশীলতা, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’-এর যে পন্থায় আমরা গড়ে তুলতে চাচ্ছি, তারই প্রতিশ্রুতি।

বিশ্বে আর যাই থাকুক মতাদর্শের অভাব অন্তত নেই। মার্কসইজম, লেনিনইজম, মাওইজম, ক্যাপিটালইজম ইত্যাদি বহু ধরনের ইজমের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের উৎকর্ষ এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটে চলেছে যার ফলে এসব ইজম তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এসব মতাদর্শের স্রষ্টাদের মানসিক এলাকা থেকে বিজ্ঞান বর্তমান পরিবেশকে বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কাজেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এসব মতাদর্শের প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং সংযোজন। কিন্তু একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে আছে।

কেন আমরা এসব মতাদর্শের রদবদল ঘটাবো? সমাজতান্ত্রিক দেশে মার্কসীয় দর্শন পুরোপুরিভাবে রূপ পরিগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছে না। রেজিমেন্টেশনের যাঁতাকলে পড়ে হিউম্যান এনার্জি স্থবির হয়ে রয়েছে। এদের মানুষকে তার ইচ্ছামত, পছন্দমত বিষয়ে পড়বার অধিকার দিতে হবে, তবেই না তার প্রতিভার বিকাশ পরিপূর্ণভাবে ঘটতে পারে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যে সব দেশে রেজিমেন্টেশন চরমভাবে বিদ্যমান সেখানে প্রতিভার বিকাশ স্বাভাবিকভাবে ঘটতে পারে না।

এ সত্য উপলব্ধি করে গণচীন আজ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্ব দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে চীন সংঘটিত ব্যাপক ধররে এ রদবদলকে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে প্রথম দিকে চীন দেশে যে অবস্থা দেখেছিলাম তার থেকে আজকের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কিন্তু সব সমাজতান্ত্রিক দেশ এখন মারাত্মক স্ববিরোধিতায় ভুগছে। আমাদের সামনে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্ববিরোধিতামূলক তিক্ত পরিবেশের চিত্র রয়েছে। কাজেই যে মতাদর্শে গলদ রয়েছে তা আমরা গ্রহণ করবো কেন? যে জিনিস আমাদের পুরোপুরি কাজে লাগে না তা গ্রহণ করে কি লাভ?

আমাদের সামনে বর্তমানে লক্ষ্য একটাই, আর তা হলো দেশ ও জাতি গঠন। ২০০ বছর পরাধীন থাকার ফলে দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি হয়েছে, সময়ও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রয়োজন অনতিবিলম্বে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তবে কথা থেকে যায়, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে কিভাবে? একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে? নিশ্চয়ই নয়। ‘ওয়ান পার্টি সিসটেম’ এবং রেজিমেন্টেশন ইনফোর্স করে যে সাফল্য অর্জন করা যায় না নিকট অতীত তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশের জনগোষ্ঠীকে একটা পথে পরিচালিত করাই সর্বোত্তম পথ বলে আমি মনে করি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘খাল খনন’ এর কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রেজিমেন্টেশনের মাধ্যমে যে কাজ হতো সে কাজ আমরা জনগণের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করিয়ে নিচ্ছি। এখানেই আমাদের দর্শনের সাফল্য।

অপ্রিয় হলেও একটা সত্য কথা বলতে চাই। আর তা হলো চারিত্রিক বলিষ্ঠতা অর্জনের প্রসঙ্গটি। আমাদের যে চরিত্রগত দিক রয়েছে তা ভালো নয়। আমাদের গলদ আমরা নিজে যা পছন্দ করি না তা অপরকে করতে বলি। “আতা মুরুনান-নাসা বিল বিরবে ওয়া তানসাওনা আন ফুসাকুম” অর্থাৎ “তুমি নিজে যেটা কর না তা অন্যকে করতে বল কেন?” এ ব্যাপারে সবাই সংযত হতে পারলে বা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে আমরা আরো দ্রুতগতিতে অগ্রগতির পথে চলতে পারবো।

এদেশের মানুষ কোনদিন ভালো কিছু পায় নি। সব সময় পেয়েছে দুঃখ-নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার আর এক্সপ্লয়টেশন। একই সঙ্গে দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে পাহাড়-পর্বতের মত সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। গত বছরের আগের বছর হাভানায় গিয়েছিলাম। ফিদেল কাস্ট্রোর সঙ্গে আলোচনায় এক পর্যায়ে ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে আট কোটি, সাড়ে আট কোটি জানালে তিনি মাথায় হাত দিয়ে জিভ কেটে বললেন, ‘এটা চালাও কিভাবে?’ আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে না উঠলে জগদ্দল পাথরের মত সমস্যাবলীর সমাধান করা সম্ভব নয়। সেই দুরূহ কাজে আট কোটি মানুষের হাতকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ গড়ার কাজে লাগাতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //