করোনাকালে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা

করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ মহামারি বা খাদ্য-অর্থ সংকটের মধ্যে পড়বে কিনা এ নিয়ে যখন সবাই উদ্বিগ্ন, তখন করোনা পরিমণ্ডলের বাইরে এমন কতক অনভিপ্রেত-দুর্ভাগ্যজনক-নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে, যা বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না, যা জাতির মর্মমূলে সচেতন ব্যক্তি মানুষকে আঘাত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোড়িত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো তিনটি ঘটনা নিয়ে এখানে আলোকপাত করা হলো।

এক হৃদয়বিদারক কাহিনীর মধ্যে সামনের সারিতে থাকবে বাউল শিল্পী রণেশ ঠাকুরের বাড়ি, গানের বইপত্র, বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে ছাই করে দেয়ার ঘটনা। এই বাউল শিল্পীর ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। এলাকায় বাউলগুরু আব্দুল করিমের শিষ্য ও সাধক হিসেবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তিনি। প্রসঙ্গত, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের বাউল সাধক শরিয়ত সরকার ও রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে যেমন ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ উঠেছিল, তেমন ধর্মীয় কটূক্তির কোনো অভিযোগ এই বাউল শিল্পীর বিরুদ্ধে নেই। তবুও এই নিরপরাধী সর্বস্বান্ত হলেন। এই অগ্নিসংযোগ ব্যক্তিগতভাবে তার বাড়ির ওপর হলেও এটার মূলে হচ্ছে গ্রাম বাংলার হাজার বছরের লোকায়ত সংস্কৃতি ও শিল্পের ওপর আঘাত। এটা তো সর্বজন স্বীকৃত বাউলরা জাত-ধর্ম মানেন না, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান, জীবন দিয়ে দেখায় জাত-ধর্ম পরমগুরুর নয়, মানুষের সৃষ্টি। লালন বলেন, ‘যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,/নারীর তবে হয় কি বিধান?/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কিসে রে।’ বাউলের গান সাধনায় রয়েছে দেহতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, মানুষ ভজনা, অন্তর্লোক, আধাত্মবাদ, ভক্তি, বিচ্ছেদ প্রভৃতি।

এই কারণে পাকিস্তানি আমলে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে বাউলরা জাতির মননে বিবেক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অক্ষরজ্ঞান কিছু ছিল না, তবু তখন জাতির মনের কথা বলতে পেরেছিলেন গানের সুরে। ‘বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে,/ মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে!/সামন্তবাদ জালিম বটে, দয়া নাই তাহার মনে।’ তাই বাউলরা আমাদের জাতির রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।

তাই সাধক বাউলের ওপর আঘাত মানে আমাদের জাতির মর্মমূলে আঘাত, স্বাধীনতার চেতনার ওপরে আঘাত। চুল-দাড়ি কেটে দেয়া, গ্রাম থেকে বের করে, পরিবারের কাউকে জানাজা না পড়ানো প্রভৃতি তাদের যেন কপালে লিখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভাবলে বেদনাহত হতে হয়, বর্তমানে আওয়ামী লীগ শাসনামলেও এমন হচ্ছে। একদিকে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম একুশে পদক পেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে এই সম্রাটের গান শুনেছেন আর অন্যদিকে করোনা দুর্যোগের মধ্যে তাদের একজনের বাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক বাউলরা করোনা দুর্যোগের মধ্যে অভাবে থাকলেও নাকি ত্রাণ পাচ্ছেন না। বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের পুত্র বাউল শাহ নুরজালালসহ সুনামগঞ্জের অনেকে বাউল সাধক অভিযোগ করেছেন, আমরা ত্রাণের খাদ্যও পাইনি, ত্রাণের টাকার তালিকায়ও আমাদের নাম নেই।

এইসব নিরাশার মধ্যেও আশার কথা, বাউল রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে আগুন দেয়া সন্দেহে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাড়ি তুলে দিতে চেয়েছেন জেলা প্রশাসক। দিয়েছেন নগদ বিশ হাজার টাকা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তার বাদ্য যন্ত্রপাতি দেবে বলে জানিয়েছেন।

করোনার মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ত্রাণমন্ত্রীর কাছে যথাক্রমে গত ২৯ এপ্রিল ও ৪ এপ্রিলের স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। প্রথম স্মারকলিপিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ২৭টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার সংক্ষিপ্তসার সংযোজিত করে বলা হয়েছে, ‘দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এরা ভবিষ্যতে আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এবং করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্ন সৃষ্টিতে অধিকতর তৎপর হয়ে সরকারের ভাবমূর্তিই কেবল বিনষ্ট করবে না, বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।’

দ্বিতীয়টিতে লেখা হয়েছে, ‘ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যকার পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নিম্নবিত্ত হরিজন জেলে দলিত রবিদাস ও আদিবাসী সম্প্রদায় যাতে ত্রাণের বাইরে না থাকে তজ্জন্যে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণে আপনার মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।’ তবে ওই সংগঠন সূত্রে জানতে পারলাম, স্মারকলিপি দেয়ার পর দুর্বৃত্তদের অশুভ কর্মকাণ্ডে কিছুটা ছেদ পড়েছিল। এখন আবার বেড়ে যাচ্ছে। আর ত্রাণ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রসঙ্গত, সরকারি ত্রাণ তৎপরতা ও দুস্থ পরিবারগুলোকে অর্থপ্রদান করবে জানার পর সংগঠনটি উৎসাহিত হয়েছিল এবং এ জন্য একটি ধন্যবাদপত্রও প্রধানমন্ত্রীকে প্রেরণ করেছিল; কিন্তু তালিকার পর দেখা যাচ্ছে তাতে বৈষম্য থেকে গেছে। সংগঠনটি কয়েক দিনের মধ্যেই জেলাভিত্তিক দুস্থদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করবে বলে জানা গেছে।

বর্তমানের এই চিত্র যখন চোখের সামনে ভাসে আর বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যখন প্রায় ৫০ বছর আগের দিনগুলোর কথা ভাবে, তখন স্বপ্ন আর বাস্তবের আকাশ পাতাল ফারাক উপলব্ধি করে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকতে এমনটা হবে না বলেই একটা বিশ্বাস দানা বেঁধে উঠেছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না বলে ক্ষোভ ও অভিমানে উল্লিখিত ধরনের প্রতিক্রিয়া দাঁড়াচ্ছে। কারও কারও প্রতিক্রিয়াটা এতই প্রবল যে, দেশ-উপমহাদেশ-বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি বিষয়ে যে গণমনস্তত্ত্বে ও বাস্তবজীবনে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, সব ধর্মমতের মানুষের মধ্যেই সাধারণভাবে যে সেসব ধস নেমেছে; তা বিবেচনায় নিতে পারছেন না। তখন ছিল উত্থানের সময়কাল আর এখন ক্রমাগত পতন হচ্ছে। সমাজটা হয়ে পড়ছে যেন তৈলাক্ত বাঁশ, নিচে নামাটা যত সহজ উপরে ওঠাটা ততই কঠিন।

তৃতীয় ঘটনাটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক এবং মর্মমূলে আঘাত হানছে। ঘটনা মারদাঙ্গা সিনেমার মতো নাটকীয়তায় পূর্ণ। বাস্তবের ওই নাটকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অর্থ লুটপাটের পটভূমি আছে, অর্থ ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা আছে, গোলাগুলি আছে, হাইজ্যাক আছে, ভয়াবহ ও শঙ্কা জাগানো সব ডায়ালগ আছে, মামলা-পুলিশ আছে, সবশেষে আছে নায়কদ্বয়ের বিমান নিয়ে পলায়ন। দুটো বেসরকারি ব্যাংকের মালিক-পরিচালক ও কর্মকর্তারা কেউ কেউ হচ্ছেন ওই থ্রিলিং নাটকের কুশীলব। সমাজের উপরি মহলের কদর্য ও ভয়ংকর রূপ এতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। জাতির অর্থনৈতিক জীবনের এই ঘটনাটাকে বিচ্ছিন্ন হিসাবে দেখা যাবে না। পঁচাত্তরের পর মানি ইজ নো প্রবলেম নীতির ভিত্তিতে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যে লুটেরা অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এমন ঘটনা ঘটেছে। যা আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাকে অনেটাই ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

এই ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি যতটুকু খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার অর্ধাংশও যদি সত্য হয় তবে এক বিশেষ শ্রেণির (এর বাইরেও পুঁজিপতি রয়েছে) লুটেরা পুঁজিপতি ব্যাংক ও শিল্প মালিকদের অর্থ ও ক্ষমতার দৌরাত্ম্য কতটুকু হতে পারে, তার কয়েকটি দিক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

এক. এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেখিয়ে দিচ্ছে নামে-বেনামে বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের কেউ কেউ জামানত ছাড়া ঋণ দিয়ে থাকেন।

দুই. ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গুলি ছুড়তে, জিম্মি করতে, সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে অর্থ ও ক্ষমতা থাকলে কেউ পরোয়া করেন না।

তিন. গুলি-জিম্মির ঘটনা ৭ মে থেকে ১৯ মে অর্থাৎ সুদীর্ঘ ১২ দিন ফেলে রাখা যায়। কেন বিলম্বকে জানে।

চার. নিজ মালিকানাধীন হাসপাতাল হলে মামলার আসামিরও নৈতিকতা ও রীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে রোগী হিসেবে সার্টিফিকেট দিতে কোনো অসুবিধা হয় না।

পাঁচ. পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে হত্যা প্রচেষ্টা মামলার আসামিও পালিয়ে যেতে পারেন।

ছয়. করোনাকালে রোগী না হয়েও আসামির পক্ষে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিদেশ যাওয়ার ছাড়পত্র নেয়া এমন কঠিন কিছু না।

করোনাকালে বা পরিসমাপ্তির পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে মানবতা ও আইনের শাসন তথা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি আরও কার্যকর হবে নাকি সমস্যা-সংকটের মধ্যে আইন লঙ্ঘন-অনৈতিকতা-অমানবিকতা আরও দুর্দমনীয় হয়ে উঠবে, কে জানে! মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী আমাদের আলোর পথ দেখাক, এটাই আজকের কামনা।


শেখর দত্ত, কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //