করোনাতঙ্ক, আমাদের মূল্যবোধ এবং ফারাও সম্রাটরা

এক.

একটি প্রবাদ চালু আছে, ‘যে কোনো সংকট বা আপৎকালে একটি জাতিকে ভালোমতো চেনা যায়’। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নভেল করোনা ভাইরাসসৃষ্ট মহামারিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ফলে প্রবাদটি পরখ করার সময়ও এখন। সেই সঙ্গে দেখার বিষয়, এই প্রবাদটি শুধু কি বাংলাদেশ বা কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য প্রযোজ্য, নাকি ভাষাতাত্ত্বিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিশারদ নোয়াম চমস্কি বর্ণিত নিউ-লিবারেল বা নব্য-উদারতাবাদী মহামারিতে আক্রান্ত পশ্চিমা দুনিয়ার জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। যে কোনো মহাদুর্যোগে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়; যেমন: ১৯৭১ সালে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। ৯০-এর এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। এরশাদের পতনের পর আবারও আমরা বিভিন্ন দলে, গোত্রে, মতাদর্শে ভাগ হয়েছি। নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী মুখোশ পরেছি, প্রয়োজনে সে মুখোশ বদলেও ফেলেছি। তার মানে প্রথমোক্ত প্রবাদটি সঠিক নয়। কোনো সংকটকালেই আমাদের চেনা যায় না। স্বার্থান্ধ আমরা প্রয়োজনে তখন একটি মুখোশ পরিধান করেছিলাম মাত্র; মনোস্তাত্ত্বিক ঐক্য দীর্ঘমেয়াদের জন্য কখনোই আমাদের মধ্যে স্থায়ীভাবে হাজির ছিল না। সমস্যা হচ্ছে ওইসব সংকটকালে সাময়িকভাবে হলেও আমরা বাহ্যত একটা ঐক্য প্রদর্শন করেছিলাম; কিন্তু করোনা সংকট সেই মেকী ভব্যতার পথটিকেও রুদ্ধ করে দিয়েছে।

করোনার এই ক্রান্তিকালে মিডিয়া মারফত আমরা জেনেছি, করোনা আক্রান্ত সন্দেহে বগুড়া ও সাভারের দু’জন রোগীকে চিকিৎসার অভাবে মরতে হয়েছে। বগুড়ার ব্যক্তিটি জ্বর ও সর্দিকাশি নিয়ে ভয়াবহ শারীরিক বিপর্যয়ের দিকে গেলে তার স্ত্রী প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাননি। সারারাত ধরে অ্যাম্বুলেন্স ও হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেও তিনি কারো কাছে থেকে সহৃদয়তার ছিঁটেফোঁটা আদায় করতে পারেননি। জ্বর শোনার পর করোনা আক্রান্ত সন্দেহে কেউ এগিয়ে আসেননি। তার লাশ দাফন নিয়েও সেখানে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে। অন্যদিকে সাভারের সেই হৃদরোগীর মধ্যে শ্বাসকষ্টের আলামত দেখা দিলে করোনা সন্দেহে কোনো হাসপাতালই তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি না হলে তিনি মারা যান। আবার কিশোরগঞ্জের একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসাপাতালে ভর্তি হলে, স্থানীয় লোকজনের মারের ভয়ে তিনি হাসপাতাল ছেড়ে পালান। খিলগাঁওয়ে করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হলে তাকে সেখানে কবরস্থ করা যাবে না বলে ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়। রংপুরে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে এক শ্রমজীবীকে ট্রাক থেকে ফেলে দেওয়া হয়। হাজীগঞ্জে করোনায় মৃত্যুবরণকারী এক নারীকে তার পরিজন শ্বশুরবাড়ির কবরস্থানে দাফন করতে গেলে স্থানীয় লোকজন বাধা দেয়। রাত সাড়ে ৩টায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিজে ওই নারীকে দাফন করেন। আমরা আরও দেখেছি বাবার মৃতদেহ দাফন করতে সন্তানরা এগিয়ে আসেনি। বৃদ্ধা মাতাকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে পুত্রদের একাকী ফেলে যাওয়ার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটেছে। এরকম আরও অনেক ঘটনাই প্রতিনিয়ত ঘটছে। 

কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? আমাদের ভেতরের মূল্যবোধের এ নিদারুণ অবক্ষয়ের কারণ কী? এই মহামারি তো শুধু বাংলাদেশে নয়, সব জায়গাতেই একইভাবে ছোঁয়াচে। তাহলে সেসব দেশে এ রকমভাবে নির্দয় ঘটনা কেন ঘটছে না? এর কারণ কি শিক্ষার অভাব? হতে পারে, কারণ শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে এই উদাহরণ কম। যে কারণে আমেরিকা বা ইউরোপ করোনা সৃষ্ট কারণে মৃত্যুপুরী হয়ে যাওয়ার পরেও কিন্তু এই ধরনের ঘটনা ওইসব দেশে দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, ভালো শিক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধের একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু তাদের সমস্যা আবার অন্য জায়গায়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিসরে। সেখানেও মূল্যবোধ বিষয়টি জড়িত। তাই এবার আমরা চোখ ফেরাই পশ্চিমা দুনিয়ার দিকে, যেখানে বুর্জোয়া পুঁজিবাদের নৌকা পৃথিবীতে প্রথম পাল তুলেছিল।

দুই. 

করোনার প্রকোপ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য ও সংহতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিয়েছে। যে কোনো রাষ্ট্রই যেহেতু নব্য-উদারতাবাদের জায়গা থেকে নিজের জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয়, ফলে এই সর্বগ্রাসী মহামারিতে অপরের দিকে তাকানোর সময় কোথায়? নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দর্শন তো এশিয়াতে সৃষ্ট ধর্মীয় আদর্শসমূহের আর ইউরোপে দেড়শত বছরের পুরনো মার্ক্সবাদী চিন্তার ফসল। ফলে নব্য-উদারতাবাদীদের কাছে তা নেহায়েত এক অযৌক্তিক প্রবণতা মাত্র। ফলে ভোগ্যসামগ্রীর অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে মুক্তবাজার নীতির ধুয়া তুলে যে নব্য-উদারতাবাদ বা মুক্তবাজার পুঁজিবাদের সূচনা হয়েছিল, তা যখন এই করোনাকালে মাঠে মারা যাচ্ছে, তখন কে আর কাকে দেখে? করোনার এই ক্রান্তিকালে কোনো সাহায্য না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুচিচ ইউরোপীয় ঐক্যকে ‘রূপকথা’ বলে অভিহিত করেছেন। সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ইতালি যখন এই সংকটে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ছিল, তখন সমাজতান্ত্রিক কিউবা ইতালিতে মেডিকেল দল পাঠিয়েছে; যার উল্লেখ করে নোয়াম চমস্কি পশ্চিমা দুনিয়াকে কটাক্ষ করেছেন। চমস্কি আরও যা বলেছেন, তা মর্মন্তুদ। সার্সভাইরাসের সংকটকাল থেকেই জানা যাচ্ছিল যে, এ ধরনের আপৎ আরও আসতে পারে। ২০১৯ সালে করোনার প্রাদুর্ভাব যখন চীনে দেখা দেয়, তখনই যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুতি নিলে এই অবস্থা হতো না; কিন্তু বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো এর প্রতিষেধক বা টিকা বানানোর চেয়ে গায়ের ক্রিম বানানোকে বেশি লাভজনক মনে করেছেন। চমস্কি যথাসময়ে এই ওষুধ সরবরাহের অক্ষমতাকে বিশাল বাজার ব্যর্থতা বলে অভিহিত করেছেন। চমস্কি বলেছেন, সার্সের অভিজ্ঞতার কারণে করোনা প্রতিষেধক বানাতে হয়তো বেশি বেগ পেতে হতো না, যদি তারা আগে থেকে সোচ্চার হতেন। ফলে পশ্চিমেও আছে মূল্যবোধের সংকট, তবে তা ভিন্ন মাত্রায়, যার কারণ মুনাফা বৃদ্ধির পুঁজিবাদী মনোস্তত্ত্ব।

তিন.

দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞদের একদল বলছেন লকডাউনেও কাজ হবে না, এখন উপায় হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটিতে যাওয়া, যার মানে হচ্ছে রোগীদের একাংশের অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে; কিন্তু বৃহত্তর অংশে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ তৈরি হবে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ভাইরাসের কারণে জনগণের একাংশের মৃত্যু হলে, সেই সংখ্যাও নেহায়েত কম হবে না। করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন কবে আবিষ্কার হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত দুঃস্থদের ত্রাণসামগ্রী লুটপাট ও চুরির ঘটনা ঘটেছে দেশজুড়ে। আমাদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত না হলে, সরকারের একার পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন জেলায়, থানায়, ইউনিয়ন পরিষদের কর্তাব্যক্তিদের একাংশ এইসব ন্যক্কারজনক কাজ করেছেন। অথচ তাদের ধারণা ছিল না যে, তিনি দু’দিন পরে এই রোগে আক্রান্ত হবেন কি-না? কিংবা তার ছেলেটি এই রোগে আক্রান্ত হলে সে বাঁচবে কি না? মনে হচ্ছে এরা সবাই এক একজন প্রাচীন মিসরের ফারাও সম্রাট, যে মারা গেলে প্রচুর ধন-রত্ন তাদের কবরে দিয়ে দেওয়া হতো। কারণ তারা মনে করতেন, ওই সব মৃতদেহের সঙ্গে দিলে মৃত্যুর পরেও তারা সেগুলো ভোগ করতে পারবে। মূল্যবোধ জন্ম না নিলে, এই ফারাও সম্রাটের সংখ্যা কিন্তু দিন দিন বাড়তেই থাকবে, অন্তত কমবে না।


মুহাম্মদ তানিম নওশাদ, লেখক ও অনুবাদক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //