করোনাভাইরাসের ইতি-নেতি প্রভাব

সারা দুনিয়ার ঘটনাবলিতে করোনার প্রভাব কতখানি ও কী, তা বলে শেষ করা যাবে না। বরং যেন বলা ভালো কীসের ওপর করোনার প্রভাব নেই। আবার করোনাভাইরাসের আগেই কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে যেমন- পরিবেশদূষণ, শহরকে ঘিরে রাখা নদীগুলোর পানিদূষণ দূর করা ইত্যাদি সবই সংশোধন অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে তিন মাস পেরোনো লকডাউনে এই প্রথম এসব সমস্যার অনেক তাৎক্ষণিক সমাধান দেখা গেছে। আর তা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটেছে। যার মূল কারণ হলো- যানবাহন বন্ধ থাকা, কারখানা বন্ধ থাকায় অবিশ্বাস্য রকমভাবে জ্বালানি পোড়া বন্ধ হয়ে থাকায় প্রকৃতি নিজেই দূষণ কমিয়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছে। অর্থাৎ অকল্পনীয় কিছু ঘটনা করোনার প্রভাবে  সহজ ও সত্যি হয়ে উঠেছে। সারকথায় করোনার প্রভাব সবকিছুতে নেতিবাচক নয়। ইতিবাচক ঘটনাও অনেক আছে। তবে এই প্রসঙ্গে জ্বালানি তেল বা ফসিল ফুয়েলের বিক্রি করোনার প্রভাবে একেবারে নাজুক দশায় পৌঁছেছিল। এমন দিনও গিয়েছে ১২ ডলার ব্যারেল দরেও তেল বিক্রি হয়েছে। এমনকি কারও কারও এমন দুর্দশাও গিয়েছে এর কম মূল্যেও তেল বিক্রি করতে হয়েছে। কেন? কারণ হলো- তেল উত্তোলন বা শোধনাগারে তেল শোধন বা উৎপাদনের কাজ হঠাৎ করে শুরু বা বন্ধ করা যায় না। এর ওপর আবার সাপ্লাই-অর্ডার কমে আসছে বলে মজুদ বেড়েই চলেছে। এতে স্টোর ক্যাপাসিটির সমস্যা ছিল। এই পরিস্থিতিতে কেউ তেল কিনতে রাজি হলে তাকে উল্টা অর্থ হাতে গুঁজে দিলেও হয়তো লাভ আছে দেখা গেছে। কারণ এতে বাড়তি তেল মজুদ রাখার সমস্যাটা কিছুটা কমে যায়। এভাবেই সেই সমস্যার মুক্তি বা সমাধান বের করেছে। এটাও ঘটেছে এই করোনাকালেই।

বর্তমানে সম্মিলিতভাবে উৎপাদন কমিয়ে তেলের মূল্য আবার ৩৯ ডলারে উঠিয়ে উৎপাদকদের জন্য ন্যূনতম সহনশীল জায়গায় পৌঁছেছে।

সব মিলিয়ে কেন এ রকম হলো? মূল কারণ করোনা আতঙ্কে যে লকডাউন হয়, এই লকডাউন কথাটার সোজা অর্থ হলো, ‘না বিনিময়-লেনদেন’। ‘শারীরিক দূরত্ব তৈরি’ কথাটার সারার্থ এটাই। এর মানে উৎপাদন-পণ্য-বাজার-বিনিময়-ভোগ, ন্যূনতম এই চক্রকে স্তব্ধ বা বন্ধ করে দেওয়া। এ জন্যই প্রণোদনা দেওয়া; কিন্তু খুব পরিকল্পিতভাবে এই প্রণোদনা উপযুক্ত জায়গায় বিতরণ করতে হবে।

এসব ব্যাপারে প্রথম সবার আগে আইএমএফ লিড উদ্যোগ নিয়েছিল গত মার্চের মাঝামাঝি জি-৭ দেশগুলোর বৈঠক ডেকে; কিন্তু ট্রাম্পের নির্বাচনী এজেন্ডায় তিনি চীনা-ব্যাসিং করতে চাওয়াতে সব ভন্ডুল হয়ে যায়। একটা যৌথ বিবৃতিও এক সঙ্গে দেওয়া যায়নি। পরে আরও বড় পরিসরে চীন-ভারতের মত বড় বাজার আর রাইজিং ইকোনমির রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জি-২০ লেভেলের মিটিংয়ে অন্তত প্রাথমিক উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের পথে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু আমেরিকা ও সারা ইউরোপজুড়ে করোনাভাইরাস আক্রমণ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সব উদ্যোগ স্থবির হয়ে সবাই কোনোমতে টিকে থাকার লড়াইয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় তিন মাস পরে ইউরোপ আবার আস্তে আস্তে বাজারে ফেরার চেষ্টা করতে শুরু করেছে সতর্কতার সঙ্গে। তাই নতুন করে জি-৭ এর মিটিং ডাকা দিয়ে নতুন করে তৎপরতা শুরু হতে যাচ্ছে।

এ দিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এটা আসলে গ্লোবাল ইকোনমির নানান ইস্যুতেই কথা বলার ফোরাম; কিন্তু এটা বেসরকারি উদ্যোগ। এই সংগঠন ব্যক্তিদের একটা ফোরাম বা কথা বলার প্ল্যাটফর্ম। দেখা যায় গ্লোবাল ইকোনমি নিয়ে যা কিছু ফোরাম বা উদ্যোগ আছে তাতে এর আয়োজক সবই বিভিন্ন রাষ্ট্রজোট। কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী গ্রুপের উদ্যোগে কোনো কিছুই নাই, যাতে ব্যক্তি, কোম্পানি তাদের কনসার্নগুলো বাকি সবার সামনে তুলে ধরতে পারে। তাই ডব্লিউইইএফ মূলত এক বেসরকারি উদ্যোগ। বলা বাহুল্য এই করোনাকালে এসব মিটিংগুলোও মূলত ভার্চুয়াল মিটিং বা অনলাইনভিত্তিক মিটিং ছিল। মানে ঘরে যার যার ড্রয়িং রুমে বসেই অনলাইনে যতটা সম্ভব সক্রিয়তা বজায় রাখা। 

গত ৩ জুন ‘কোভিড অ্যাকশন প্ল্যাটফর্ম’ নামে এমনই এক ভার্চুয়াল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ডব্লিউইইএফ যে বক্তব্যটা নিয়ে কথা বলছিল তা হলো গ্রেট ‘রিসেট’। এখানে রিসেট কথাটার মানে হলো- ‘ঢেলে সাজানো’। অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো। সেটা এই অর্থে যে, করোনাভাইরাসের কারণে গ্লোবাল অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্থবির হয়ে গেছে। তাই এই সুযোগে তা আবার শুরু করার আগে একবার ঢেলে সাজিয়ে নেওয়া যাক। এ নিয়ে কথা বলতে তারা ডেকেছিল তিনজনকে। গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনাল নামের বহু পুরনো পরিবেশবাদী এনজিওকে। গ্রিনপিসের নির্বাহী পরিচালক জেনিফার মর্গান এসেছিলেন কথা বলতে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমরা একটা নতুন বিশ্বব্যবস্থা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম; কিন্তু আজ আমরা সেই সময়ের চেয়ে আলাদা দুনিয়ায় এসে পড়েছি। তাই এখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে পারি আবার নতুন করে শুরু করতে আমরা ভিন্নভাবে ঠিক কী করতে পারি? এ জায়গায় ওয়ার্র্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিরাট ভূমিকা রাখার ও দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ আছে। সে একটা ‘রিসেট বাটন’ খুঁজে পেতে ও চাপ দিতে পারে। কি সেটা? সেটা হলো- এবার এই পৃথিবী এবং এর মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে ও টিকে থাকতে নতুন পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ শুরু করা। কোম্পানিগুলো অতীত থেকে অনেক শিখেছে। তাদের এখন আরও ‘শূন্য-কার্বন উৎপন্নের ইকোনমি’ গড়ার দিকে ধাবিত হতে হবে, কেবল এভাবে মুনাফার জন্য আর মানুষের জন্য। যেমন আমাদের কয়লা খনি থেকে সরে আসতে হবে। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে ‘মানুষের স্বাস্থ্য আর পৃথিবীর টিকে থাকা আগে’- এভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। দেখা যাচ্ছে সেটা এখন কোভিট-১৯ আসাতে মানুষের স্বাস্থ্যের বেলায় যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর স্বাস্থ্য বা পবিবেশ রক্ষার বেলায়ও ততটাই গুরুত্ব এখনো দেওয়া হয়নি। এখন মহামারিতে যেমন মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছি, সেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি; মূলত মাটির নিচের ফসিল ফুয়েলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপ ও এর সঙ্গী শিল্প গ্রুপের কারণে।

এরপর ওই আসরে কথা বলতে আসেন গীতা গোপিনাথ। তিনি আইএমএফের চিফ ইকোনমিস্ট। মোটা দাগে তার বক্তব্যও গ্রিনপিসের জেনিফারের মতোই। তিনি অবশ্য বলেছেন, ২০০৮ সালের গ্লোবাল মহামন্দার তুলনায় এ সংকটে কাজ হারানোর গতি ও পরিমাণের দিক থেকে একেবারেই আলাদা। তাই সমাধানও হতে হবে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে খরচ বাড়ানো, একে ঢেলে সাজানো অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটা কেবল স্বাস্থ্যের জন্য নয়, অর্থনীতির রিকভারির দিক থেকে প্রধান শর্ত। আবার স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজানো মানে বড় বিনিয়োগে যাওয়া, অর্থাৎ আরও ঋণের প্রয়োজন পড়া। আর তাতে ঋণ পরিশোধের ওপর চাপ বাড়বে। সেটা সামলাতে বিশেষ করে গরিব অর্থনীতি দেশগুলোর জন্য ঋণ মওকুফ, সুদের হার কমানো, সহজ করা ইত্যাদিতে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি এবং আরও নিতে হবে। তবে তাতেও সংকট কাটবে না। অর্থনীতি যেভাবে রিকভার করবে সেই সঙ্গে ট্যাক্স, রাজস্ব আদায়ে মনযোগী ও দক্ষ হতে হবে।

সর্বশেষে, অর্থনীতির রিসেট বা ঢেলে সাজানো প্রসঙ্গে একটা কথা। অর্থনীতি-কথাটার আরেক মানে হলো- ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা। কোভিড-১৯ আমাদের অনেকেরই অযোগ্যতা উদোম করে দিয়েছে। যেমন ভারতে মোদির আমলারা দক্ষ নিঃসন্দেহে; কিন্তু যখন লকডাউনের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তখন লাখ-লাখ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে পাঠানো হবে কী করে তা নিয়ে এই আমলারা কোনো পরিকল্পনাই করেনি। এই ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ও অযোগ্যতা প্রমাণ করে ভারতের পুঁজিবাদ কোন মানের! আবার বাংলাদেশেও করোনা-পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে যে অযোগ্যতা আর লুকাচুরি সেটাও আমাদের পুঁজিবাদ নিজেই কত দুস্থ ও অযোগ্য তাই চোখের সামনে হাজির করে দিয়েছে। করোনা ন্যাংটা করে দিতে আমাদের কাউকে বাকি রাখেনি!


গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //