সাধারণ মানুষের প্রধান সমস্যা

কিছুদিন আগের ঘটনা। এক আড্ডায় হঠাৎ করেই একজন প্রশ্ন রাখেন সাধারণ মানুষের প্রধান সমস্যা কী? সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রশ্ন করেন, দেশের না এলাকার? দেশের যেসব সমস্যা আছে, তার পাশাপাশি এলাকার মানুষেরও তো বেশকিছু সমস্যা আছে? প্রশ্নকর্তা বলেন- ‘আগে এলাকার মানুষের সাধারণ সমস্যা শুনি তারপর দেশের সমস্যার কথা ভাবা যাবে।’ আড্ডাটা মোটামুটি বড়ই ছিল। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষ থেকে শুরু করে আইনজীবী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আড্ডা ছিল। প্রাথমিকভাবে আড্ডাটা জমজমাট মনে না হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা গভীরতা পেতে শুরু করল। এখানে কত বিষয় উঠে এসেছে, তা স্মরণে এনে লিপিবদ্ধ করা সত্যিই কষ্টসাধ্য। অসম্পূর্ণ এ আড্ডায় সমস্যা জর্জরিত সাধারণ মানুষের প্রধান সমস্যা কি সে ব্যাপারে ঐকমত্যে আসা শুধু কঠিনই নয় একপ্রকার অসম্ভব ছিল। সম্ভব ছিল শুধু সমস্যাগুলোকে সামনে আনা।

আলোচনায় উঠে আসা বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল- অর্থনৈতিক বৈষ্যমের গতি, বেহাল যাতায়াত ব্যবস্থা, কৃষির উন্নয়ন ও বৃহৎশিল্প স্থাপনের দৈন্য, সরকারি প্রাপ্তিতে বৈষম্য, নদী সংস্কার ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে উদাসীনতা, পরিবেশ, মানসম্মত শিক্ষা, সব ধরনের প্রশাসনের দৌরাত্ম্য, এলাকায় দারিদ্র্য বিবেচনায় কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, ব্যাংক ঋণের সুবিধা, সরকারি সেবা পেতে বিড়ম্বনা, আনুপাতিক উন্নয়ন, আবাসন সমস্যা, কৃষি ভূমি রক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দৈন্য, এলাকার দারিদ্র্য বিবেচনায় বিশেষ প্রকল্প, বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম, যানজট, ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ার বাজারে ধস, এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা, নারীর ক্ষমতায়ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এনকাউন্টার ও জঙ্গি সমস্যা, মৌলবাদের বিস্তার, স্থানীয় সরকারের দায়বদ্ধতা, ’৭২-এর সংবিধান, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের নামে প্রতারণা, পেশাজীবীদের সেবার মানসিকতার ক্রমনিম্নগামী প্রবণতা, স্থানীয় সরকারকে বাক্সবন্দি করে রাখা, জেলাকে বিভাগ এবং পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন করা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়বদ্ধতাহীনতা, আইনের শাসন, কালোবাজারি, ভেজাল খাদ্য, মানহীন ওষুধ, মূল্যবোধের সমস্যা, জবাবদিহিহীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, ঋণখেলাপি, আইনের শাসন না থাকা, জনসংখ্যা, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিসহ আরও কত কী!

আড্ডায় একজন বলা শুরু করলে থামতে চায় না। ফলে নানামুখী কত বিষয় যে আলোচনায় উঠে এসেছে, তা আমার দৈন্যের জন্য পুরোপুরি এখানে উপস্থাপন করা সম্ভব হলো না। দ্বিতীয়ত, প্রধান জাতীয় সমস্যার সঙ্গে এলাকার প্রধান সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে পৃথক করা যায়নি। জাতীয় সমস্যাকে পুরোটা মাথার ওপর রেখে এলাকার সমস্যার মধ্যে কেউ সীমাবদ্ধ থাকতে পারেনি। সাধারণ বিবেচনায় এটা সম্ভব কি না, ঠিক বুঝতে পারি না। তাই আড্ডায় শোনা আলোচনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করব। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অন্যতম প্রধান একটা স্তম্ভ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল এখন সরকারকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোঝে, যার ফলাফল দারিদ্র্য বিমোচন। সরকার দাবি করে- দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। তবে  বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের মতে, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমাদের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা- ৮ কোটি ৬২ লাখ এবং আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা হিসেবে হতদরিদ্র ২ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। এসব উপাত্তকে বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন হিসেবে উড়িয়ে দেওয়াই যায়। তাহলে চোখ রাখি সরকারি প্রতিবেদনে। ২০১৭ সালে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন মতে, দেশের নিম্নবর্গের ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের তুলনায় উচ্চবর্গের ৫ শতাংশ মানুষ বেশি আয় করে। আবার ১০ শতাংশ ধনীর হাতে রয়েছে দেশের আয়ের ৩৮ শতাংশ এবং সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে দেশে মোট আয়ের ১ শতাংশ। আমাদের চলমান উন্নয়নের ফলে বিশ্বের দ্রুত ধনীর উত্থানের দৌড়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। অর্থনৈতিক এমন বৈষম্যের রাশ টেনে ধরা না গেলে দেশে ধনীরা আরও ধনী এবং গরিব আরও গরিব হবে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটাই প্রধান সমস্যা। 

সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৬০- এর দশকে দেশে ‘সবুজ বিপ্লব’ শুরু হয়। প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদ করার অঙ্গীকারে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। পোল্ডার আর স্লুইস গেট নির্মাণের হিড়িক পড়ে। এই পোল্ডার ও স্লুইস গেট নির্মাণ প্রাথমিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখলেও অচিরেই তা এলাকার জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যশোর-খুলনা অঞ্চলের ভবদহ-বিলডাকাতিয়া আজ চার দশক ধরে জলাবদ্ধ। আমাদের ভুল পরিকল্পনার কারণে আজ রাজধানীর মতো জেলা শহরগুলোও সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। নদী সংস্কার হচ্ছে, ড্রেন নির্মাণ হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। জলাবদ্ধ মানুষের কথা বিবেচনায় এটাই প্রধান সমস্যা। 

দেশের সামগ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থার মধ্যে আকাশপথের ব্যবহার বিত্তবানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নদীমাতৃক দেশের নৌপথকে ইতিমধ্যে আমরা অবহেলা করে ধ্বংস করে ফেলেছি। রেল পরিষেবা উন্নয়নে সরকার সচেষ্ট হলেও তা সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম নয়। তাই সাধারণ মানুষের জন্য সড়ক পথই ভরসাস্থল। অথচ এলাকার সড়কগুলো কত বছর ধরে বেহাল হয়ে পড়ে আছে, তা বর্ণনাতীত। নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা হয়তো আগামী আরও কয়েক বছরের মধ্যে জনগণকে মুক্তি দেবে, তবে তা আবার কতদিনের জন্য সেটা অনুমান করা না গেলেও বছর যে ঘুরবে না তা নিশ্চিত। এ তো গেল মহাসড়কের কথা। অন্য যেসব সড়ক আছে তার অবস্থাও করুণ। 

সবাই জানে বিশ্বে নদীকে ঘিরেই জনপদ গড়ে উঠেছে, সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করেছে নদীর ওপর। এমন গুরুত্বপূর্ণ নদী আজ অন্তহীন অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এককালের খরস্রোতা নদীগুলোকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। অধিকাংশই দখল হয়ে নালা হয়ে গিয়েছে, মশার খামার হিসেবে খ্যাত হয়েছে। উৎসে পানি প্রত্যাহারের ফলে পর্যায়ক্রমে একটার পর একটা নদী পথ হারিয়ে ফেলেছে। সরকার মহাপরিকল্পনা করে সংস্কার করে চলেছে। সেই সংস্কার কার্যক্রমে বহতা নদীকে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। আজ পর্যন্ত যেসব নদী সংস্কার করা হয়েছে তাতে দীর্ঘমেয়াদি উপকার জনগণ পায়নি। হয়তো আপেক্ষিকভাবে জলাবদ্ধতা কমেছে, মশা কমেছে, মাছ চাষ বেড়েছে, সৌন্দর্যবর্ধন হয়েছে, সাধারণ মানুষ খুশী হয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধেই নদী তার আগের রূপ ফেরত পেয়েছে। উৎসে পানির ব্যবস্থা না করা হলে বেশিদিন এ সংস্কারের সুফল পাওয়া যাবে না। পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা বিবেচনায় নদীকে বহতা না করাই প্রধান সমস্যা। 

আড্ডার আলোচনা-পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ ধীরে ধীরে পরিবেশকে গরম করে তোলে। কারো যুক্তিকেই পাশে সরিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। এসব শুনতে শুনতে শুধু মনে হতে লাগলো, আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে দেশকে অর্জন করেছি, তা কি আমাদের নীতি-নির্ধারকদের মনে আছে? দেশের দিকে তাকালে মনের বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, নীতি নির্ধারকরা দেশটাকে চিরকালের বলে মনে করে থাকবে, তাই তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্রত গ্রহণ করেছে। তারা ভুলে গেছে এখন আর ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিরা নেই। নিজেদের মঙ্গল নিজেদেরই করতে হবে। স্বাধীন দেশ হিসেবে এক টাকার কাজ ৮০ পয়সায় করতে হবে। নীতিনির্ধারকরা এ পথে না হেঁটে এক টাকার কাজ ৫ টাকায় করে চলেছে। এর ফলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, আইনের শাসনের অভাব, ব্যাংক জালিয়াতি, খাদ্যে ভেজাল, মানহীন ওষুধ, মানহীন শিক্ষা, কালোবাজারি, টেন্ডার বাণিজ্য, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধহীন, মাদক, কমিশন বাণিজ্য, প্রশাসন রাজার অংশ হয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। কে কার থেকে এগিয়ে যাবে তার জন্য জীবনবাজি রেখে রকেটের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় এলাকার চেয়ে জাতীয় সমস্যা হিসেবে বেশি বিবেচ্য। তবে এসব ব্যাপারে এলাকা মুক্ত নয়। এলাকার সমন্বয়েই তো দেশ।

আমার ব্যক্তিগত ভাবনা, এলাকার সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একজন নেতা প্রয়োজন। সেই নেতা যিনি এলাকার যাবতীয় সমস্যা সমাধানে অবদান রাখার জন্য জাতীয় ক্ষেত্রে বিশাল চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। যিনি জাতীয় পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন নেতা না হলে প্রাপ্তিযোগ হচ্ছে না। কারণ আমাদের রাজনীতি দেশের উন্নয়নে ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আর এই ব্যক্তিরা নিজ এলাকাকেই মনে করে থাকেন বাংলাদেশ।

আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা মান ও বিজ্ঞানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে সুজন করে, বিনয়ী করে, পারিপার্শ্বিকতা চিনতে শেখায় বা চক্ষুস্মান করে। এই শিক্ষা দেশের জনগণের জন্য করা গেলে সাধারণ মানুষ নিজেকে চিনবে, দেশকে চিনবে, স্বাধীনতার স্বরূপ বুঝবে। আর তাহলেই নিজের সমস্যা নিজে বুঝে করণীয় নির্ধারণে সমর্থ হবে। দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে সক্ষম হবে। আড্ডায় হয়তো একটা এলাকাকে বিবেচনায় নিয়ে নানামুখী কথা হয়েছিল। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষাই বাংলাদেশের সমস্যা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সমস্যা।


এম আর খায়রুল উমাম, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //