আই ক্যান্ট ব্রিদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্য এবং সহিংসতার ইতিহাস দেশটির জন্মের ইতিহাসের মতোই পুরনো। মার্টিন লুথার কিং, রোজা পার্ক, ম্যাল্কম এক্সসহ হাজার হাজার নারী-পুরুষের সারাজীবনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার কিছুটা আদায় হয়েছে; কিন্তু তারপরেও মার্কিন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বর্ণবাদের বিষ লুকিয়ে আছে মিনেসোটার সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্ববাসীকে সেটাই আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গত ২৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে ড্রেক শোয়িন নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা জর্জ ফ্লোয়েড নামক এক কৃষ্ণাঙ্গকে যেভাবে পাশবিক কায়দায় হত্যা করেছে, তা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জনগণও এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে এবং মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে।

মিনেসোটার সেই পুলিশ কর্মকর্তা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ফ্লোয়েডের ঘাড়ে তার হাঁটু দিয়ে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড চেপে ধরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। শোয়িনকে ২৯ মে-তে গ্রেফতার করা হলেও মাত্র ৫০০ ডলার মুচলেকায় জামিন দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শত হুমকি-ধমকি আর প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের ব্যাপক হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে উত্তেজিত মার্কিন জনতা সমগ্র দেশে ফ্লোয়েড হত্যাসহ বর্ণবাদবিরোধী ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে। বিক্ষোভ চলাকালে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মিছিলকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ২৫টি শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং জনগণের চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালাচ্ছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ও মেয়রদের বলেছেন বিক্ষোভ যাতে আরও শক্ত হাতে দমন করা হয়। ন্যাশনাল গার্ডকেও বিক্ষোভ দমনে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। বিক্ষোভকারীদের সরকারি সম্পদ বিনষ্টকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। তাদের দীর্ঘ মেয়াদে আটক রাখার দাবি জানান। আদেশ অনুযায়ী বিক্ষোভ দমনে ন্যাশনাল গার্ড যেভাবে কঠোর অভিযান চালিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর ট্রাম্প তাতে খুশি হয়ে ওই বাহিনীকে অভিনন্দিত করে টুইটারে বার্তাও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, প্রথম রাতেই যদি মেয়রেরা ওই দমন অভিযান চালাত তাহলে কোনো সমস্যাই হতো না।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামাসহ দেশটির বহু সিনেটর এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন এক আন্দোলন, মিছিল, আর প্রতিবাদের দেশে পরিণত হয়েছে। 

সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস এ ঘটনাকে বর্ণবাদের পাপের ফল বলে ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একই রকম ঘটনা বার বারই ঘটেছে। ২০১৫ সালে একইভাবে বুকের ওপর হাঁটু গেড়ে হত্যা করা হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জ্যামার ক্লার্ককে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পুলিশের হাতে খুন হওয়া ৭ হাজার ৬৬৬ জন নাগরিকের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলেছে- প্রতি ২৮ ঘণ্টায় কোনো না কোনো কৃষ্ণাঙ্গ নারী, পুরুষ কিংবা শিশু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। প্রতি তিনজনের একজন আফ্রিকান আমেরিকানকে জীবনের কোনো না কোনো সময়ে জেলে কাটাতে হচ্ছে। মার্কিন কারাগারগুলোতে মোট বন্দিদের ৪০ শতাংশই কালো রঙের মানুষ। 

সাম্প্রতিককালের বংশগতীয় গবেষণা বলছে যে, মাত্র ৫০-৭০ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এর আগে খুব ছোট একটা টিকে থাকা অংশ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষের বিকাশ ঘটেছে। তাদের মধ্যে ততধিক একটি ছোট দল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, যাদেরই উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছি। 

বর্ণবাদের ইতিহাস অনেক দিনের। দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় বর্ণবাদের কালো ইতিহাস কম বেশি সবারই জানা আছে। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে এই বর্ণবাদ বৈজ্ঞানিক রূপ লাভ করতে শুরু করেছিল, যার রূপকার ছিলেন ফ্রান্সিস গল্টন। গল্টন ছিলেন ডারউইনের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। ‘ইউজেনিক্স’ নামে একটি নতুন মত প্রচার করতে শুরু করেন তিনি। এর মূলকথা হচ্ছে- শুধু জৈব বৈশিষ্ট্য নয়, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক গুণাবলিও বংশগতীয়, সুতরাং তা গোত্রে গোত্রে বা বর্ণে বর্ণে আলাদা। সব বর্ণের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা সমান নয়। এ জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত যৌন নির্বাচন। অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত বাবা-মা নির্বাচন করা হলে তাদের সন্তান অপেক্ষাকৃত বেশি বুদ্ধিমান হবে এবং এভাবেই মানুষের ক্রমাবনতি ঠেকানো যাবে। সেক্ষেত্রে যথারীতি উন্নত বর্ণের মানুষের সঙ্গে কোনোভাবেই অনুন্নত বর্ণের মানুষের অন্তঃপ্রজনন ঘটতে দেয়া যাবে না। এ নিয়ে গল্টন অনেক লেখালেখিও করেছেন। ১৮৬৯ সালে তার ‘হেরেডিটারি জিনিয়াস’ প্রকাশিত হয় যেখানে তিনি জিনিয়াসের সংজ্ঞা দেন এভাবে- এমন একটি যোগ্যতা- যা ব্যতিক্রমী রকমের উন্নত এবং একই সঙ্গে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই গল্টনসহ আরও অনেকের রেসবিষয়ক তত্ত্বের অসারতা প্রমাণিত হতে থাকে এবং খাঁটি নরগোষ্ঠী বা রেস যে একটি অলিক কল্পনা মাত্র তা প্রমাণিত হয়ে যায়। কালে কালে রেসিজমের ধারণা যে একটি উপনেবেশিক ধারণা এবং তা যে এক রাজনৈতিক ও ঔপনেবেশিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার তা প্রমাণিত হতে থাকে; কিন্তু বহু শতাব্দীর প্রোথিত এই পাপ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো মিশে আছে। এখনো সাদা গাড়ির চাকার রঙ কালো। এখনো শুদ্ধতার রঙ শুভ, সুন্দরের রঙ সাদা, এখনো কষ্টের রঙ কালো। এখনো কালো মেয়ের নাম ময়লা। 

পড়াশোনার সূত্রে আমি বছর তিনেক মিনেসোটায় থেকেছি। ভদ্র ব্যবহারের কারণে প্রচণ্ড শীতের এই রাজ্যটির মানুষের মার্কিন দেশজুড়ে ‘মিনেসোটা নাইস’ বলে ডাকা হয়। অথচ সেই মিনেসোটার ড্রেক শোয়িনের মনের ভেতর কী পরিমাণ বর্ণবাদের পাপ লুকিয়ে ছিল, যে ঘাড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে শ্বাসরোধ করে তিনি জর্জ ফ্লোয়েড নামের এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে হত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ফ্লোয়েড চিৎকার করে বলছিল, ‘আই ক্যান্ট ব্রিদ’। সেই আর্ত চিৎকারও ড্রেকের মন গলাতে পারিনি।

তবে এই মহামারির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রেয়চেতনার মানুষ যেভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে যাচ্ছে, তা মানুষ হিসেবে আমাদের উচ্চকিত করে। অমানিশায় আমাদের আশা জাগায়।


একেএম মাজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //