একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতির বাতিঘর

একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যদি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো হতেন, তাহলে বলতেন ‘জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা ঝাঁকে ঝাঁকে জন্মায় না’; কিন্তু তা তিনি জীবনেও বলবেন না। একজন মানুষ পাদপ্রদীপের আলোর পেছনে থেকে সারাটা জীবন কীভাবে মানুষের সেবা করে যেতে পারে, তার জীবন্ত উদাহরণ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। 

একজন মানুষ তার পেশা দিয়ে দেশ সেবা করতেই পারেন। সাধারণ দেশপ্রেমিক মানুষ তা করেনও; কিন্তু ডাক্তার পরিচয়, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পাশে সরিয়ে রেখে শুধু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও জাফরুল্লাহ চৌধুরী জীবন্ত কিংবদন্তি; যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে সবার আগে সবচেয়ে দরকারি কী, সেটা নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। আর তা পেরেছিলেন বলেই ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ গড়ে তুলেছিলেন। 

আজ যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে কিছু মিডিয়ায় ন্যক্কারজনক অপপ্রচার হচ্ছে, তার প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কার করা সস্তা দামের অথচ কার্যকর টেস্ট কিট নিয়ে যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে; তার পেছনে রয়েছে স্বার্থের রাজনীতি। তিনি শাসক দলের সমর্থক নন, এটাই যেন তার বড় অপরাধ! এই জাফরুল্লাহকে জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। 

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিলাতে ছিলেন। সে সময় পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ‘দেশহীন নাগরিক’ হয়ে যান! এরপর সেখানেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য সংগঠিত হতে থাকেন। বিলাসী জীবন ফেলে এসে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ শেষে চাকরি বা ব্যবসা না করে রণাঙ্গনের ফিল্ড হাসপাতালকে নিয়ে আসেন স্বাধীন দেশে। সাভারের অদূরে গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। 

গণমানুষের চিকিৎসা করতে করতেই এক সময় জাতীয় ওষুধনীতি তৈরি করার জন্য সরকারি মহলে ধর্ণা দিয়ে বসে থাকেন। এক সময় গঠিত হয় জাতীয় ওষুধনীতি। ওষুধের দাম কমানোর জন্য তিনি দামি স্ট্রিপ-কভার ত্যাগ করেন। দামি কৌটার ব্যবহারও বন্ধ করেন। সেজন্য একই ওষুধ তিনি ১০ পয়সা দামে বিক্রি করতে পারলেও অন্য ফার্মাসিউটিক্যালগুলো বিক্রি করত ৫০ পয়সা অর্থাৎ ৫ গুণ বেশি দামে!

১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম। বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। মা-বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ডিএমসি)। ছাত্র ইউনিয়নের মেডিকেল কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্রাবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ডিএমসি থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; কিন্তু চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ বাকি, তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পরীক্ষা না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। 

ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএমএ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি।

আগেই পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করা জাফরুল্লাহ ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট জোগাড় করে দিল্লিগামী বিমানে চড়ে বসলেন। উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। বিমানটি ছিল সিরিয়ান এয়ারলাইন্সের। দামেস্কে পাঁচ ঘণ্টা প্লেন লেট, সবযাত্রী নেমেছে। জাফরুল্লাহ নামেননি। এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিলেন ওই ‘পলাতক পাকিস্তানি নাগরিককে’ গ্রেফতার করার জন্য। বিমানে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না, কারণ বিমান হলো আন্তর্জাতিক এলাকা। এমনিভাবে ওরা বিপদের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষে সেক্টর-২ রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হন জাফরুল্লাহ।

যুদ্ধ বিস্তার লাভ করলে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। হাসপাতালটির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। সে সময় প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল। 

জাফরুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। নাম ঠিক করার ইতিহাসটি বেশ মজার। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসপাতালটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়ার সময়, নাম নিয়ে আপত্তি এলো প্রশাসন থেকে। সেই সময় অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও রাষ্ট্রপতির কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন রাষ্ট্রপতির সাথে।

সেদিনের কথোপকথন- ‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেয়া হচ্ছে না।’ জানালেন ডা. জাফরুল্লাহ।

‘বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্য।’ বললেন শেখ মুজিবুর রহমান।

অনেক তর্কের পর শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করব। দু’জন বসে যে নামটি ভালো, সেই নামে হাসপাতাল হবে।’

তিনটি নাম ঠিক করে আবার শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

‘বল, কি নাম ঠিক করেছিস?’

জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, ‘এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।’

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে শেখ মুজিব বললেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।’

১৯৭৯ সাল থেকেই জাফরুল্লাহ জাতীয় শিক্ষা কমিটি ও নারী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশে শিক্ষা ও নারীনীতি প্রণয়নে। তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নেও। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্য খাতে যাকে বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। তার প্রচেষ্টায় আমদানি করা ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫টিতে। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে একটি ওষুধ রফতানিকারক দেশে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাকশালে যোগ দিতে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী থাকায় চার পৃষ্ঠার চিঠির মাধ্যমে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে উপেক্ষা করেছিলেন এরশাদের প্রস্তাব। তার পরামর্শেই এরশাদ আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, উপজেলাব্যবস্থা এবং জাতীয় ওষুধনীতি ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন হয়।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। যে কাজ নারী ‘পারে না’ বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বর্তমানে মোট কর্মীসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নারী।

চিকিৎসা ‘বাণিজ্য’ নয়, সত্যিকার অর্থেই ‘সেবা’ দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে, সেই সূচনালগ্ন থেকেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকার হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ ২ হাজার টাকা। সাভারে আরো কম। সিজারিয়ানের প্যাকেজ ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। ডাক্তার, ওষুধ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার নামে অন্য কোনো বাড়তি খরচ নেই। সাধারণ প্রসবকে উৎসাহিত করা হয়। জটিলতা দেখা না দিলে সিজার করা হয় না। অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে সাধারণ প্রসব নেই বললেই চলে। সিজারিয়ানের প্যাকেজ সর্বনিম্ন ৬০ হাজার থেকে দুই বা তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। সব প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার খরচ ঢাকার মাঝারি মানের হাসপাতাল, ক্লিনিকের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। সন্তান প্রসবের দক্ষ কারিগর ধাত্রীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নিয়েছে সূচনালগ্ন থেকেই।

ঢাকা শহরসহ সারাদেশে কিডনি ডায়ালাইসিস যে কতটা ব্যয়বহুল ও দুষ্প্রাপ্য চিকিৎসা, অভিজ্ঞতা না থাকলে অনুধাবন করা কঠিন। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল মিলিয়ে সারাদেশে প্রতিদিন যত কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস হয়, এককভাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রোগীর ডায়ালাইসিস সেবা দেয়। বাংলাদেশে সাধারণভাবে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ সাত থেকে আট হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার-ওষুধ মিলিয়ে আরো বেশি পড়ে যায়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ জন কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করে থাকে। এর মধ্যে ১০-১২ শতাংশ দরিদ্র রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় ২০ শতাংশ রোগীর কাছ থেকে নেয়া হয় ৮০০ টাকা। ১১০০ টাকা নেয়া হয় ১৫ শতাংশ রোগীর কাছ থেকে। সর্বোচ্চ নেয়া হয় ২৫০০ টাকা। তবে ২৫০০ টাকা দিয়ে যারা ডায়ালাইসিস করাতে পারেন, তারা গণস্বাস্থ্যে আসেন না। তারা অন্য নামকরা হাসপাতালে আট বা ১০ হাজার টাকা খরচ করে ডায়ালাইসিস করান। যদিও অন্য কোথাও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো সেবা পাওয়া যায় না। ওই রোগীর অন্য যেকোনো রোগের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় সার্বক্ষণিক, দক্ষ নার্স তো থাকেনই। এসবের জন্য আলাদা কোনো ফি নেয়া হয় না।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন ট্রাস্টি। প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন ১০ বছর আগেই। সম্প্রতি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মালিকানাধীন’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সঠিক তথ্যটি হলো, ডা. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক নন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো সম্পদের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক কোনো ব্যক্তি নন। মালিক বাংলাদেশের জনগণ। একজন রোগী বা অন্য ১০ জন মানুষের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর যে অধিকার, ডা. জাফরুল্লাহর অধিকার তার চেয়ে বেশি নয়।

তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। তারপর থেকে একের পর এক মামলা হচ্ছে। তিনি জমি দখল করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন, ফল চুরি করেছেন, মাছ চুরি করেছেন- এমন মামলাও হয়েছে!

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিশ্ববাসী, বিশেষ করে অপ্রস্তুত বাংলাদেশের জনগণ যখন জেরবার, আতঙ্কিত; সেই সময় আবারো সেই জাফরুল্লাহ চৌধুরী এগিয়ে এলেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস নির্ণায়ক ‘র‌্যাপিড ডট ব্লট’ কিট বানানো শুরু করলেন; কিন্ত এটি ‘কার্যকর হবে না’, ‘মানসম্মত নয়’ এরকম হাস্যকর যুক্তি তুলে সরকারের লোকজন গণস্বাস্থ্যের কিট গ্রহণ করল না। দিনের পর দিন তিনি ধর্ণা দিয়ে বসে থেকেছেন। সারাটা জীবন লড়াই করে আসা মানুষটা এবারে মুষড়ে পড়তে পড়তেও ফের ঘুরে দাঁড়ালেন। পণ করলেন তাদের বানানো কিটের কার্যকারিতা প্রমাণ করবেনই। কিন্তু কীভাবে? ওষুধ প্রশাসন তো তখন ‘ভানুমতির খেল’ দেখানো শুরু করেছে। পরীক্ষা শুরু করার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। সে অনুযায়ী কিট সরবরাহের প্রস্তুতি নিয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র; কিন্তু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে কোনো চিঠি দেয়নি বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ ও কিট নেয়ার জন্য কোনো লোকও পাঠায়নি।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সরকারের কাছে একটা আবেদন করতে চাচ্ছি আমি অন্তত যতদিন না পর্যন্ত এই তুলনামূলক অ্যাফেক্টিভনেস পরীক্ষার রিপোর্ট আসে, ততদিন আমাদের একটি সাময়িক সদনপত্র দেন। যাতে লোকের করোনাভাইরাস হয়েছে কি হয়নি, তা র‌্যাপিড ডট ব্লটের মাধ্যমে প্রতিদিন পরীক্ষা করে বলে দিতে পারি। এখন আমরা যদি শুরু করি, তাহলে বলবে যে, উনারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না, নিয়মনীতি মানেন না, প্যারালাল করছি। যেহেতু কমিটির কাজ পেন্ডিং আছে, সেহেতু এটা করা যায় কী না সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে এই আবেদন করছি।’

শেষ পর্যন্ত একটার পর একটা অজুহাত খাড়া করে ওষুধ প্রশাসন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের টেস্ট কিট গ্রহণ করেনি। ক্রয় করেনি। ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। এরই মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে নিজেদের উদ্ভাবিত অ্যান্টিবডি কিট দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন। এতে দেখা গেছে দুইদিনের মাথায় তার শরীরে সামান্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তিনি প্লাজমা থেরাপিও নিয়েছেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুটি কিডনিই প্রায় অকেজো। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করতে হয়। তাই নিয়মিত চিকিৎসার অংশ হিসেবে কিডনি ডায়ালাইসিসও করিয়েছেন।

এই রকম আক্রান্ত অবস্থায়ও তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান করোনাভাইরাস রোগী। কারণ করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক সচিব এন আই খান, কর্নেল সাজ্জাদ জহির ও তারিক সুজাতরা আমার চিকিৎসার জন্য খুবই তৎপর হয়েছেন। আমার চিকিৎসা যাতে ঠিক মতো হয় এর উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে আমার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০৯ নম্বর কেবিন বুকড করে দিয়েছেন। একই দিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমার জন্য ফল পাঠিয়েছেন।’

একজন জাফরুল্লাহ কতটা জনসম্পৃক্ত হলে বলতে পারেন- ‘আমি যদি হাসপাতালে গিয়ে কেবিনে উঠি, তাহলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে যে, শনাক্ত হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যেতে হয়। করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য আমি ভুল বার্তা দিতে চাই না। ফলে, আমার জন্য ঢামেকে কেবিন বুকিং দিয়ে রাখা সত্ত্বেও আমি হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় আছি। এটাই করোনাভাইরাস রোগের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি। সবার ক্ষেত্রে এটাই করা উচিত। এমনিতেই হাসপাতালে জায়গা নেই। যাদের দরকার নেই তারাও যদি হাসপাতালে চলে যাই, তাহলে তো সংকট আরো বাড়বে।’

প্লাজমা থেরাপি বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা একটি হাসপাতাল বানিয়েছি, সেই হাসপাতালে যদি আমাদের নিজেদের চিকিৎসাই করতে না পারি, তাহলে তা থাকারই কোনো অর্থ নেই। যে হাসপাতালে আমরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারব না, সেই হাসপাতাল রাখব কেন? সেই হাসপাতাল তৈরি করব কেন? আমি আমার সব রকমের চিকিৎসা আমাদের হাসপাতালে করি। আজ থেকে ১৮ বছর আগে যখন আমার চোখের অপারেশন করা দরকার হয়েছিল, তখন আমি তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে করিয়েছিলাম। তখন আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য ছিলাম। সেসময় পৃথিবীর যেকোনো দেশে, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশের উন্নত হাসপাতালটিতেও আমি বিনা পয়সায় চোখের অপারেশন করাতে পারতাম; কিন্তু আমি তা করাইনি। জনগণের মাঝে কখনোই কোনো ভুল তথ্য বা ভুল বার্তা দিতে চাইনি। চোখের অপারেশন আমি আমাদের হাসপাতালেই করিয়েছি এবং বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে চেয়েছি যে, এই অপারেশন বাংলাদেশেও করা যায় এবং তা খুবই মানসম্পন্ন। আমার আমেরিকা-ইউরোপের বন্ধুরা অনেকবার উদ্যোগ নিয়ে বলেছে, চলে আসো। বিনা খরচে আমরা তোমার কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করবো। রাজি হইনি। কারণ আমি একা সুবিধা নেব আর বাংলাদেশের সব মানুষ বঞ্চিত থাকবে, তা হতে পারে না।’

এই হলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আমরা যাকে মাপতে পারার মতো কোনো মানদণ্ডই তৈরি করতে পারিনি। অথচ তার যতটুকু মর্যাদা, সম্মান, পুরস্কার প্রাপ্য ছিল; আমরা তাও তাকে দিতে পারিনি। আমরা এই বাংলাদেশের নাগরিকরা সম্ভবত সেই বিরল প্রজাতির কোনো একটি অংশ; যারা তাদের সূর্য সন্তানদের বেঁচে থাকতে মূল্যায়নের বদলে মারা যাওয়ার পর মূল্যায়িত করতে পছন্দ করে!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //