‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়’

বিশিষ্ট সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী আর নেই। দেশের এই প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকের পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। রাজনীতিতে তুমুল প্রভাবিত ও মার্কসবাদের অনুসারী এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছাত্রজীবনেই বহুবার বরণ করেছেন কারাবাস।

১৯৫২ সালের কথা। স্বাধীকার আন্দোলনের প্রথম সোপান। ভাষা আন্দোলনের দাবিতে গর্জে ওঠে বাঙালি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিপরীতে কোনো আপসরফা হবে না। মূল নেতৃত্বে ছাত্ররা। পাবনায় যেসব ছাত্র তখন বুকের রক্ত ঢেলে দিতে অকুণ্ঠ ছিল, তার অন্যতম কামাল লোহানী। বরেণ্য সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক ও বার্তা সম্পাদক। 

এ সংগ্রামী শিল্পী ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা থাকাকালীন টের পেয়েছিলেন, মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনো অঘটন ঘটাবে। কারণ ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটছিল। তিনি বাংলাদেশের সংবাদপত্রে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কোনো ধরনের সংবাদ না ছাপতে নির্দেশ দেন ২২ মার্চ। 

কামাল লোহানী নামের এ শিল্পী সংগ্রামী সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। কামাল লোহানী নামেই সমধিক পরিচিত হলেও পারিবারিক নাম তার আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী।

কামাল লোহানী কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা শুরু করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনায় চলে এলেন। ভর্তি হলেন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এ কলেজ থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন তিনি। 

শুধু কি তাই? তার জীবন সংগ্রাম যা শুরু হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, যা আজও শেষ হয়নি। সূচনাটা হয়েছিল পরিবারের সাথে রাজনৈতিক দ্বিমত থেকে। ১৯৫৫ সালের জুলাই, রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর কামাল লোহানী ফিরে এলেন পাবনায়। কিন্তু অভিভাবকদের সাথে শুরু হলো রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। অভিভাবকরা চাইছিলেন, লেখাপড়া শেষে রাজনীতি করো, আপত্তি নেই। কিন্তু কামাল লোহানী তখন রীতিমতো রাজনীতি প্রভাবিত ও মার্ক্সবাদের অনুসারী। চোখে তার বিপ্লবের ঐশ্বর্য। আর তাই ছোট চাচা শিক্ষাবিদ তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ালেন। ঢাকায় এসে তিনি তার চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ১৯৫৫ সালের আগস্টে দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় সহসম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। হাতেখড়ি হলো সাংবাদিকতায়। সেই থেকে তার কলমের আঁচড়ে তৈরি হতে লাগল একেকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সেইসাথে শুরু হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রাম।

কামাল লোহানী ‘দৈনিক আজাদ’, ‘সংবাদ’, ‘দৈনিক পূর্বদেশ’, ‘দৈনিক বার্তা’সহ বিভিন্ন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর ফিরে দেখতে পান, পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সর্বত্র নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে। পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিরোধিতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় রবীন্দ্রচর্চার বাতিঘর ছায়ানট। কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এ দায়িত্ব পালন করার পর মার্ক্সবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন গণসাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। পাকিস্তানি শাসনবিরোধী সংগ্রামে ক্রান্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর যতদিন তিনি পূর্ব বাংলায় ছিলেন, সামরিক শাসক চক্রের নানা দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। এ সময় তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কয়েকটি অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন রচনা করেন। অবশেষে এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সব সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘবদ্ধ করে ‘বিক্ষুদ্ধ শিল্পী গোষ্ঠী’ গঠনে তৎপর ছিলেন। কিন্তু অবস্থার অবনতিতে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা চলে যান। সেখান থেকে ট্রেনযোগে কলকাতা। ওই সময় সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী তাকে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় নিয়ে যান। সেখানে কাজ করতে করতে আমিনুল হক বাদশার সাথে দেখা হয়। তিনি তাকে নিয়ে যান বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের। বালীগঞ্জের এ বাড়িতে মন্ত্রীরা (অর্থাৎ প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীরা) বাস করতেন। তারা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। সেখানেই চালু হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সৈয়দ হাসান ইমাম ‘সালেহ আহমদ’ নামে সংবাদ পাঠ শুরু করেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু বিপ্লবী বেতারে কি আর বসে থাকা যায়। যখন যে দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন সেটা পালন করতেই হবে। তিনিও সংবাদ বিভাগ সংগঠন করা ছাড়াও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, স্লোগান দেয়া ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। 

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকায় চলে আসবে। এজন্য কামাল লোহানী চলে এলেন ঢাকায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী।

১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নিলেন ঢাকা বেতারের। দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে ব্রতী হন। দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে অনেকটা নীরব প্রতিবাদেই ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে বেতার ত্যাগ করেন। ১৯৭৩ সালে ২০ জানুয়ারি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন ‘দৈনিক জনপদ’ নামে একটি নতুন পত্রিকায়। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন।

১৯৭৪ সালে ‘জনপদ’ ছেড়ে ‘বঙ্গবার্তা’ প্রকাশ করেন। মওলানা ভাসানী সমর্থিত এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ। প্রায় তিন মাস পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে কামাল লোহানী ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই পুনরায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আবেদ খান রচিত ‘জ্বালামুখ’ নাটক পরিচালনা ও নিপীড়নে বিধ্বস্ত এক মানুষের চরিত্রে অভিনয়ও করেন এবং এ বছরই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া সফর করেন। 

বাকশাল সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র অ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগদানেও অস্বীকৃতি জানান। এ সময় চাকরিহারা কামাল লোহানী খুবই অর্থকষ্টে পড়েন। এ রকম ক্রান্তিকাল তার জীবনে বারবার এসেছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, লড়েছেন প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে।

১৯৭৭ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত করে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয় তাকে। ১৯৭৮ সালে তাকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে ‘বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট’-এর ‘ডেপথ নিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কয়েক মাস পরই তিনি পিআইবির অ্যাসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন। 

চোখে গ্লুকোমার মতো জটিল রোগ নিয়ে লিখে চলেছেন অবিরাম। যে কেউ গেলে দিঘল বুকে আশ্রয় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে দরাজ কণ্ঠে এগিয়ে গিয়েছেন কামাল লোহানী। সবার লোহানী ভাই বা কাকা, মানুষের প্রতি সমর্পিত জীবনের এ মানুষটির ঘরবাড়ির প্রতি লোভ ছিল না। ছিল না আয়েশি জীবনের প্রতি গোপন স্পৃহা। তিনি চেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। তাই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় শৈশবে মা হারানোর বেদনায় ক্লিষ্ট মানুষটি সব ছাড়িয়ে হলেন গণমানুষের প্রতিনিধি। এ প্রাপ্তি তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে সহায়-সম্পদ-ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনেক ওপরে।

১৯৮৩ সালে কামাল লোহানী আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সরাসরি জড়িত হয়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন ও সভাপতি হন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি নির্বাচিত হন ২০১৬ সালে। তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টাও ছিলেন। 

তার এ সংগ্রামী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেছেন ক্রান্তিস্মারক-২০০৩, ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক, ১৯৯১ সালে কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, ২০০৮ সালে জাহানারা ইমাম পদক, একুশে পদক। রাষ্ট্রীয় আরও কত শত পদক কত শত লোক পায়, পান না মাটির সন্তানেরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ বার্তা সম্পাদক তাই স্বাধীনতা পদক পান না, এত বড় মাপের কলামিস্ট, লেখক, এত বই লিখলেও বাংলা একাডেমি পদক পান না। দুই দফায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। 

১৯৬০ সালে বিয়ে করেছিলেন চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে। কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। প্রতিদিনের বিপ্লবী কামাল লোহানী তখন তার সংগ্রামী অবস্থান থেকে নড়েননি। তার সংগ্রামী জীবন ও কর্মের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন। প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী আলোকিত এ মানুষটির চলে যাওয়া দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //