বাংলাদেশের বাজেট ও করোনা অর্থনীতি

করোনাত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতির যে ভয়াবহ চিত্র ভেসে উঠবে, তা ভাবলে এখনই শিউরে উঠতে হয়। নীতিনির্ধারকরা হয়তো এ কথা বলে পাশ কাটিয়ে যাবেন, কভিড-১৯-এর কারণে তো সারাবিশ্বই থমকে গেছে। সারাবিশ্বের অর্থনীতিই স্থবির হয়ে গেছে। বাংলাদেশ তো ভিন্ন গ্রহের কোনো দেশ নয় ইত্যাদি, ইত্যাদি। এতদিন কিন্তু আমাদেরকে ঘুমপাড়ানি গান শোনানো হয়েছিল এই বলে যে, এদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সাড়া জাগিয়েছে, আমাদের জিডিপি প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরিণতিতে আমরা কি দেখলাম? সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে না করতেই খাদ্যের অভাবে, অর্থের অভাবে হাজার থেকে লাখ লোক অভুক্ত অবস্থায় খাদ্য চাই, ভাত চাই বলে রাস্তায় নেমে পড়ল। বেগতিক অবস্থায় রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও খাদ্যভাণ্ডার থেকে রিলিফের নামে যে কয়েক ট্রাক চাল, ডাল, তেল, চিনি দুর্গত এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে, তার বেশ কিছু অংশ সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা লুটপাট করল। কিছু এলাকায় রিলিফ না পেয়ে কর্মহীন অভুক্ত লোকজন ত্রাণ বহনকারী গাড়ি থামিয়ে রিলিফ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছে। 

এ দুর্যোগকালীন সময়ে ব্র্যাক একটি জরিপ করেছে। এ জরিপ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের উন্নয়নের ‘রোল মডেলে’র ফাঁকা বুলির সারমর্ম স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দরিদ্র লোকের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে প্রায় ২.১০ কোটি লোকের আয় প্রচ-রকম কমে গেছে, প্রায় ১.৫০ কোটি লোকের জীবন-যাপনের ব্যয় অনেক হ্রাস করতে হয়েছে। আর অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হওয়ায় কর্র্মহীন হয়ে পড়েছে আরও প্রায় ২ কোটি লোক। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, সব মিলিয়ে যাদের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি, এ শ্রেণির ওপর জরিপটি না চালালেও সংবাদ মাধ্যম ও টেলিভিশনের নানা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে এরা প্রচণ্ড রকম ঝুঁকিতে আছে। এদের অধিকাংশই এক দারুণ শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাহলে প্রশ্নটা আসে উন্নয়নের ‘রোল মডেলে’র দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী এ দেশে বসবাসকারী লোকজনের আর্থিক দৈন্য এমনই যে, মাত্র ২-৩ মাসের সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে বিরাটসংখ্যক লোকজনই কপর্দকহীন হয়ে গেছে! অনেকের খাবার ক্রয়ের সামর্থ্য ছিল না। 

বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রথম থেকেই আমরা এ গোলমেলে অর্থনীতির হিসাবটা দেখে আসছি। আসলে আমাদের অর্থনীতি ওপরের ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ লোকের জন্যই সাজানো হয়। মনে হয় ওই লুটেরা পুঁজিপতিদের জন্যই এদেশটা স্বাধীন হয়েছে। মনে হয় এদের আয় উপার্জন বাড়াবার জন্যই যেন বাকি লোকজন ওদের ফাই-ফরমাশ খেটে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকে। এবার করোনাভাইরাসে আমাদের কাছে এ বিষয়টা খুব স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এদেশের প্রায় ১৪-১৫ কোটি লোক কত অসহায়, ক্ষণে ক্ষণে দারিদ্র্য ওদের দুয়ারে হানা দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে জিডিপির ওপর একটু চোখ বুলাতে হয়। জিডিপির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফসল, ফলজ, পশু পালন, বনজ থেকে প্রত্যক্ষ আয় হচ্ছে ২২ শতাংশ, আর অপ্রত্যক্ষ যে আয়, কৃষি বন্ধ হলে সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে, অর্থাৎ সামগ্রিক কৃষি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড যথা কৃষি খাতের জন্য নিবেদিত অন্য সব খাত থেকে মোট আয় দাঁড়ায় প্রায় ৬০ শতাংশ। এখন জিডিপিতে কথিত সবচেয়ে বড় যে খাত বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ‘পোশাক শিল্পের’ উত্থানের খাতটি অন্যান্য ব্যবসার মতো বনেদি শ্রেণিগত ব্যবসায়ীদের দ্বারা গড়ে ওঠেনি। এটা গড়ে উঠেছে হঠাৎ সৃষ্ট শূন্য স্থানের দ্রুত পূরণের মতো চারদিক থেকে অপ্রতিষ্ঠিত, নবীন, এমনকি সুযোগ-সন্ধানী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে, যাদের নিজেদের কোনো পুঁজি ছিল না বা যাদের পুঁজি থাকার কথা নয় এমন সব লোক দিয়ে। যারা ব্যবসা শুরু করেই অতি দ্রুত পুঁজি বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা দেদার মুনাফা অর্জন করেছে এবং জ্যামিতিক হারে পুঁজি সঞ্চয় করেছে। 

এই পোশাক শিল্প, যাকে নিয়ে এত হই চই প্রকৃত জিডিপিতে তার সংযোজন কত? বিদেশি ক্রেতা এবং আমাদের মালিকরা যৌথভাবে আমাদের শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত মূল্য শুধু নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠনই করছে না, শর্তানুযায়ী বিদেশি ফ্যাব্রিক্সসহ আরো অনেক মালামাল, যা মোট রফতানি মূল্যের ৭৫ শতাংশ, বিদেশ থেকে আনার ফলে আমাদের ওইসব মৌলিকশিল্প ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। শেষ অর্থ বছরে গার্মেন্টসের রফতানি মূল্য ছিল ২, ৮৯, ০০০ কোটি টাকা কিন্তু এর মালামাল আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ২, ১৬, ৭৫০ কোটি টাকা। জিডিপিতে প্রকৃত সংযোজন মাত্র ৭২, ২৫০ কোটি টাকা। জিডিপিতে যা দেখানো হয়েছে শতকরা ১৬.৩৭%। আসলে জিডিপিতে প্রকৃত সংযোজন হবে ৪.১০%!

আসলে দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে রূপান্তরিত হয়ে অর্থনীতির ও জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তিকে মজবুত করার মূল স্তম্ভ হলো- তিন ‘জ’ যথা- জমি, জল এবং একদল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এককালে নদী ও উর্বর জমিকে কেন্দ্র করেই এদেশে ভিন্ন ভিন্ন এলাকাভিত্তিক স্বয়ম্ভু অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক এক বিস্তৃত নিবিড় শিল্পায়ন। এগুলো হলো শিল্পের মৌলিক ভিত্তি; কিন্তু তার জন্য দরকার বিনিয়োগ, পরিকল্পনা, নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও তার ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়ন। কৃষি অর্থনীতির আধুনিকীকরণ তথা যান্ত্রিকীকরণের পথে অগ্রসর হয়ে শিল্পায়নের দিকে এগোতে হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ রাখা হয়েছে- ১৫ হাজার ৪৪১ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২ দশমিক ৭২ শতাংশ।

কৃষক তার পণ্যের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না। আবার মানুষের চাহিদা কমে যাওয়ায় কৃষিপণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। দেড় মাসেরও কম সময়ে শস্য খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং মৎস্য খাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মোট ৮ হাজার কোটি টাকার দুটি পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প চালু করতে চলেছে, যা ক্ষতির তুলনায় অত্যন্ত অল্প। তবে কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে কৃষি খাতের পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না। খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক কৃষিপণ্য ও বীজ আমদানিনির্ভর হওয়ায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে বার্ষিক ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন গম, ৫ থেকে ১০ লাখ টন ভুট্টা, প্রয়োজনীয় তেলের ৮০ শতাংশ এবং চিনি, ডাল, মসলা ও বিভিন্ন জাতের বীজ আমদানি করতে হয়। গত ছয় বছরে কৃষিতে ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে আটকে আছে, যার অর্থ বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছর অনুদানের অনুপাত হ্রাস পাচ্ছে। চাষাবাদে বৈচিত্র্য না থাকায় সমস্যা প্রকট হচ্ছে। কৃষি এককেন্দ্রিক শস্য চাষাবাদে আটকে আছে। কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ঘাটতি রয়েছে। এ অর্থবছরে সরকার ভর্তুকিতে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে, তবে বিশ্বব্যাপী মহামারির মুখে এই বৃদ্ধি স্থিতিশীল খাদ্য সুরক্ষা তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। কৃষি খাতে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার বর্ধিত বরাদ্দ রয়েছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত ব্যয়ের চেয়ে ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা বেশি। করোনাকালেও কৃষিতে বাজেটের মাত্র জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে এগুলোর কিছুই করা সম্ভব হবে না। 

আর সরকার কৃষির উন্নয়নে তাকাচ্ছেই না। করোনার প্রণোদনাতে আমরা কি দেখলাম? করোনা মহামারিতে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে ‘চাঙ্গা’ করার নামে প্রণোদনার অর্থ কোথায় ঢালছি? গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনের নামে মাত্র ২ শতাংশ সুদে মালিকদের ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা করা হয়েছে। এত হাজার লাখ টাকার ব্যবসা করার পরও বেতনের টাকা সরকার দিল কেন? 

অর্থ লোপাটের কত কৌশল! অন্যান্য প্যাকেজ নিয়েও বিশ্লেষণ করলে অবাক হতে হবে দেখে যে অর্থ লুট ও পাচারের কত সুন্দর একটা সুযোগ নিয়ে এলো এই ‘করোনা’। লোন প্রদানের কৌশল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও লোন গ্রহীতার সঙ্গে সম্পর্ক ও ব্যাংকের বিবেচনা অনুযায়ী লোন প্রাপ্যতা নির্ধারিত হবে। কি চমৎকার? এ সম্পর্কের সুবিধাইতো আমরা ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণে খালি হতে দেখেছি। আরো মজার ব্যাপার যে, এ ঋণের সুদের ৫০ শতাংশ সরকার বহন করবে। এবার আসা যাক, কৃষি ঋণ প্রণোদনার বিষয়ে। এক্ষেত্রে সুদ ধরা হয়েছে ৫ শতাংশ। কাদের দেয়া হবে? ধনী কৃষক, খামারি, পোলট্রি, ডেইরি, হ্যাচারির মালিককে। অর্থাৎ যাদের ব্যবসায় বিপর্যয় ঘটলেও উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্য আছে। আমরা এটাতে আপত্তি করছি না; কিন্তু আপত্তি হচ্ছে কৃষির নামে পত্তন, লিজ নেয়া, ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষিদের কী হবে? যারা সারাটি বছর খেটে ফসল ফলিয়ে এদেশের ৯০ ভাগ লোকের খাদ্য সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রেখেছে। যাদের পরিশ্রম ও খাটুনীতে জিডিপি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। উৎপাদনের পরে যে কৃষক ভাইরা মহাজনের, ব্যাংকের, দাদনের ঋণ পরিশোধ করে ২ বেলার ভাত টেনেটুনে ৪ বেলায় খেয়ে দিন গুজরান করেন। এরা কি ঋণ পাবে? না। যে কৌশলে ঋণ প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তাতে প্রকৃত কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর, গ্রামীণ মজুরদের ঋণ পাওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। আমরা তো ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস করি। তাহলে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ করে কেন আমরা পত্তন, লিজ নেয়া, ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষি, জেলে, কামার, কুমোর, গ্রামীণ মজুরদের ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ টাকা দিতে পারি না!

করোনা মহামারির এ বিধ্বস্ত অর্থনীতি যদি বেঁচে যায় তা বাঁচবে কৃষির জন্যই, যেখানে বিদেশি পুঁজিনির্ভর ‘দর্জি শিল্প’ তাকে আরও সংকটে ফেলছে।


বি ডি রহমতুল্লাহ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //