করোনায় উন্মোচিত সমাজ-সভ্যতা ও উন্নয়নের গভীর ক্ষত

করোনাভাইরাসকে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে কিছুটা রসিকতার সঙ্গে ‘সাম্যবাদী’ চরিত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রূপে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কারণ এই ভাইরাস ধনী, দরিদ্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে সংক্রমিত করছে। আপাতদৃষ্টিতে কভিড-১৯ নামক এই ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো বাছবিচার নেই; কিন্তু ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশ থেকে যেসব উদ্বেগজনক তথ্য ও অভিজ্ঞতা বেরিয়ে এসেছে, তাতে এই ভাইরাসের সমতাধর্মী বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে আর জোর দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। এই ভাইরাস ইতোমধ্যে তার শ্রেণি পক্ষপাত যেমন স্পষ্ট করেছে, তেমনি বর্ণবাদ, ধর্মীয় ও জাতিবিদ্বেষের মতো বিদ্যমান সমাজ সভ্যতার গভীর সব অন্তর্বিরোধ, বৈপরীত্য ও সংকটকেও প্রকট করে তুলেছে, উৎকটভাবে বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা মহামারির বিরুদ্ধে ‘ফ্রন্টলাইন ফাইটার্স’ হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন সেই ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক, পুলিসসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন অনেকে। আশঙ্কা করা যায়, আগামীতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। ঝুঁকি জেনেও এই কঠিন দুঃসময়ে তাদের এই দায়িত্ব, সেবাপরায়ণতা ও আত্মোৎসর্গের কারণে যে লাখ লাখ মানুষ বেঁচে যাচ্ছেন, সুস্থ হয়ে উঠছেন, মহামারির কালো অন্ধকার সময় পার হয়ে জীবনের নতুন পর্ব শুরু করবেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এর মধ্যেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের গত তিন মাসের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষ তথা স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এটা নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো জরিপ ও গবেষণা এখনো সম্পন্ন না হলেও সামাজিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়া ও সরকারি সংস্থা থেকে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে সমাজের এই অংশের মানুষের সংক্রমিত হবার গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানেও করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বড় অংশ হচ্ছে শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ।

এটা স্পষ্ট যে, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অতি নিম্নমানের জীবনযাত্রার কারণে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) দুর্বল ও ভঙ্গুর থাকায় তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। এ পর্যন্ত বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাও মোটামুটি একই রকম। ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাস, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে স্বল্পআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শ্রেণির জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এরকম দেশগুলোতে খুবই কম। গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে কার্যকর কোনো কিছুই এসব দেশগুলোতে এখনো গড়ে ওঠেনি। এমনিতেই যে কোনো রোগব্যাধিতে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে, যেটুকু চিকিৎসা রয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তা নামেমাত্র। তারা মূলত আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেও সুচিকিৎসা করাতে পারেন না। আর করোনার চিকিৎসা জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় মেহনতি মানুষ আরো বেশি করে সংকটের মধ্যে পড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যু তাদের কাছে অবধারিত। এটা উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই যে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বে থাকা চিকিৎসাসেবীদের মনোযোগও তুলনামূলকভাবে কম। শিক্ষার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থাও পুরোপুরি মুনাফাকেন্দ্রিক বা বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ায় করোনা মহামারি শ্রমজীবী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরো বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। করোনা সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে ঘরে থাকাকে যখন প্রধান নিদান হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে, তখন এই মেহনতি, দিনমজুর আর প্রান্তিক কোটি কোটি মানুষের ঘরে থাকার অবকাশ কোথায়?

আসল সংকটটা কোথায়? দারিদ্র্য, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে এবং সর্বোপরি চরম শোষণ, বঞ্চনা ও গভীর অসাম্যের মধ্যে তাদের দিন গুজরান করতে হয়। এটাই যেন তাদের নিয়তি! বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক কথিত ‘নয়া উদারবাদী’ ব্যবস্থা এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অনেকটা স্থায়ীভাবে বেকার, ভবঘুরে, গৃহহীন, রুগ্ণ, শীর্ণকায় ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফেলে রাখে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের জৈব ক্ষমতার বলে কেউ যদি করোনা মহামারির মতো দুর্যোগ প্রতিরোধ করে টিকে থাকে ভালো। আর বাকি একটা অংশকে জীবনের ওপর অধিকার না থাকায় মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হয়; এবং অবহেলা ও অপরাধজনিত এই মৃত্যুকেই স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করতে হয়, নিয়তির মতো। এ ধরনের মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে মেনে নেয়ার জন্য বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণও তৈরি করে রেখেছে; যাতে এই ধরনের অপমৃত্যুর পেছনের সত্যটাকে লুকিয়ে রাখা যায়।

করোনা মহামারি অসাম্য ও অমানবিক চরম দারিদ্র্যের মৌলিক প্রশ্নসমূহকে যেমন আরও নগ্ন করে তুলেছে, তেমনি এই মহামারি আরও একবার বর্ণবাদ, ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষকেও উৎকটভাবে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। করোনা মহামারি অভিবাসী শ্রমিক, যারা আইনগতভাবে বিভিন্ন দেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থার বাইরে তাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। যৌনকর্মী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এই মহামারিতে চরম বৈষম্য ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। কেবল পেশা ও দৈহিক গঠনের কারণেই করোনা সংক্রমণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাদের অবহেলা, বিদ্রুপ ও অসহযোগিতার কবলে পড়তে হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা দুর্যোগের শুরুতে পুরনো বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ ও সাধারণ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিভেদ-বৈষম্য আবার সংকট হিসেবে উঠে এসেছে; প্রকাশ হয়ে পড়েছে অশ্বেতাঙ্গ বিশাল জনগোষ্ঠীর দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র। মাথাচাড়া দিয়েছে অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। করোনা চিকিৎসায় কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়রা যে বৈষম্যের শিকার, তা অনেক জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ শতাংশ আফ্রো আমেরিকানদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের দিক থেকে এরা প্রায় ৫০ শতাংশ। শিকাগোতে এরা ৩০ শতাংশ হলেও করোনায় মৃত্যুর দিক থেকে শ্বেতাঙ্গের তুলনায় এদের হার ৬ শতাংশ বেশি। যুক্তরাজ্যে এরা ১৫ শতাংশ; কিন্তু শেতাঙ্গদের তুলনায় মৃত্যুঝুঁকি এদের চার গুণ বেশি। খোদ লন্ডনেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে ৪০ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গই আফ্রো-ব্রিটিশ। যুক্তরাজ্যেও ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ এশীয়রা তুলনামূলকভাবে অধিক ঝুঁকিতে। ফ্রান্স ও ইতালির মতো দেশসমূহে এই বর্ণগত, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ প্রকট না হলেও মহামারিকালে তার নানা অভিপ্রকাশ ঘটেছে।

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে করোনাকেন্দ্রিক সময়ে মুসলমান বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা ও উগ্র সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়েছে। দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের ১৫০০ মুসল্লির সমাবেশ ও পরবর্তীসময়ে দিল্লিসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এদের ক’জনের করোনা সংক্রমণের খবর প্রকাশিত হলে, এটাকে কেন্দ্র করে দিল্লির বিজেপিদলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা মুসলমানবিরোধী প্রপাগান্ডা চরমে নিয়ে যায়। মামলা রুজু করা হয় তাবলিগ জামাতের প্রধান মাওলানার বিরুদ্ধে। করোনাভাইরাসকে ‘তাবলিগ ভাইরাস’সহ নানা অভিধায় আখ্যায়িত করে মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় নতুন মাত্রা যুক্ত করা হয়; হেনস্তার শিকার হতে হয় মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেককে। আমদানি করা হয় ‘প্রডিউসার আর ডিস্ট্রিবিউটর তত্ত্বকে; অর্থাৎ চীন এই ভাইরাসের উৎপাদক, আর ভারতের মুসলমানরা এর বিতরণকারী ইত্যাকার ঘৃণা আর বিদ্বেষজনক প্রচারণা চালানো হয় এবং হচ্ছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আর রাজ্য সরকারও পরোক্ষভাবে এসব প্রচারণায় ইন্ধন জুগিয়েছে। করোনাকালে দুনিয়ার দেশে দেশে এই ধরনের ধর্মীয় ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবাদী ‘বহুবিচিত্র’ প্রচারণা ও তৎপরতার নতুন মাত্রা দেখা যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস যে সহজেই ক্ষুধা আর অপুষ্টিতে ভোগা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর দেহে বাসা বেঁধে তাদের অধিকহারে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে, তা এখন আর লুকানোর কোনো বিষয় নয়। এই ভাইরাস বিদ্যমান কথিত সভ্যতা আর উন্নয়নের গভীর ক্ষত, বৈষম্য আর বঞ্চনা, সমাজের গভীর অসুখ আর জরাগ্রস্ততাকে যেভাবে প্রতিদিন নগ্ন করে দিচ্ছে তা রীতিমতো অভিনব; যে কারণে সভ্যতার আদুল দেহের এই লজ্জা নিবারণে পুরো ব্যবস্থা পরিবর্তনের আবশ্যিকতাকে প্রতিদিন সামনে তুলে ধরছে।


সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী, ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //