‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের’ সাংবাদিকতা

এটা বেশ তামাশার মনে হয়, যখন ভারতের কোনো সাংবাদিক অপর দেশের নেতাদের ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ বলে অভিযোগ করে নিন্দা করেন। বিশেষ করে ভারত যখন কংগ্রেস জমানা পেরিয়ে বিজেপি-মোদি জমানায় আরও উগ্র হিন্দুত্ব-জাতীয়তাবোধে আক্রান্ত হয়ে, সব কিছু নিয়ে ডুবে যেতে চাইছে। মোদির ভারতের দিনকাল এখন এতই খারাপ যে, নেপালের হুমকির মুখে ভারতকে বলতে হচ্ছে- ‘আলোচনার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি’ মিটিয়ে নিতে। 

পত্রিকার প্রতিনিধির সংজ্ঞা মোতাবেক কেউ যদি কোনো পত্রিকার ‘প্রতিনিধি’ হন, তাহলে তাকে তো সব পক্ষের বক্তব্য রিপোর্টে রাখতে হবে; কিন্তু তিনি যদি সংশ্লিষ্ট সবার ভাষ্য দূরে রেখে, শুধু নিজের ভিউজ দিতে থাকেন, তাহলে বলাই বাহুল্য, তখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বাংলাদেশে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি পরিচয়ে লিখছেন অনেকদিন ধরে; সম্ভবত যতদিন তিনি বাংলাদেশের পাঠকের ‘নিউজ জানার আগ্রহের’ কথা মনে রেখে লিখেছেন, তখন পর্যন্ত অসুবিধা হয়নি। যদিও মাঝে মাঝে ভারতের ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ের’ ওপর ভরসা করে লিখতে গেছেন, তখন বাংলাদেশে কিছু অস্বস্তি হলেও বড় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি; কিন্তু এবার হয়েছে এবং তা আগামী দিনের জন্য এলার্মিং বটেও।

কালাপানিসহ বিতর্কিত তিন সীমান্ত এলাকা আসলে কার? নেপাল না ভারতের তা আমাদের ফয়সালা করে দেয়ার কথা না; এবং আমাদের কোনো মাথাব্যথ্যর বিষয়ও না। তবে এ নিয়ে ইতোমধ্যে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জির বিবিসিকে দেয়া বক্তব্য মোদির বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখেছি। দেব মুখার্জি বলেছেন, ‘কালাপানি নিয়ে আলোচনা হবে বলে মোদি নেপালকে আশ্বস্ত করার পরও এক সুন্দর সকালে নিজ মন্ত্রী রাজনাথকে দিয়ে রাস্তা উদ্বোধন করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন যে, এটা কেমন আচরণ?’ এ ছাড়া এ দিকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা হলো যে, এখানে লোকজন যতটা সরকারবিরোধী, তারচেয়েও বেশি ভারতবিরোধী। দেশের ‘নিশীথ ভোটের’ সরকার শুধু না, খোদ জনসম্মতি নেয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে ফেলার জন্য মানুষ সরকারের চেয়ে ভারতের ওপর বেশি ক্ষিপ্ত। এগুলো প্রথম আলো বা সৌম্যের অজানা, এমন কথা নয়। 

অথচ এই পটভূমিতে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের প্রথম আলোয় সম্প্রতি ‘নেপাল প্রসঙ্গ’ নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একটা ‘ভিউজ’ লিখেছেন ‘দিল্লি প্রতিনিধি’ পরিচয়ে। এটা সবচেয়ে বড় অপরাধ। দ্বিতীয়ত, তিনি নিজেই নিজ দেশের ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ের’ উগ্রজাতীয়তাবাদ বোধের ওপর দাঁড়িয়ে লিখেছেন। আর উলটা নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয়তাবাদের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তামাশা আর কাকে বলে!

মোদি সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়া বাংলাদেশের কোনো পত্রিকার দিল্লি প্রতিনিধিরও কাজ কোনোভাবে এ রকম নয়। অথচ তিনি সব পরিচয়ের সীমা বা দেয়াল ভেঙে এক দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ভারতীয় যেন। তাই আর সহ্য করতে না পেরে মোদির পক্ষে সাফাই দিতে চোখ বন্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন; কিন্তু তবু ওমুকে উগ্রজাতীয়তাবাদী, নাকি আপনি না অন্য কেউ এসব বলে আমরা এই ইস্যুতে কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারব না। এর চেয়ে বরং প্রশ্ন করি একজন সাংবাদিক আসলে কে? তাহলে উগ্র না হোক জাতীয়তাবাদীও হতে পারবেন না? হলে কী সমস্যা? অথবা না হয়ে কী আর পথ আছে? এখান থেকে বের হতে আইডিয়ালি কী পথ খোলা ছিল এবং এখনো আছে?

অনেক প্রশ্ন, আসলে অনেক না। কারণ একভাবে সব উত্তর দেওয়া সম্ভব। এর একেবারে প্রাথমিক অবস্থানটা হলো- এমন রিপোর্টের কর্তা রিপোর্টার নিজে হতে পারবেন না। অথচ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় তাই হয়ে গেছেন। এমনকি তিনি যেন এমন এক গর্বিত ভারতীয়, মোদি সরকার যেন তাকে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠিয়েছেন! অথচ যার যার কথা তিনি আমাদের বলছেন, সে কথাগুলো তাদের নিজ নিজ বরাতেই আমাদের বলতে হতো। অথচ সৌম্য যেন কলামিস্ট, কোনো কলাম লিখেছেন। অর্থাৎ সৌম্য নিজের প্রতিনিধি পরিচয়ের মধ্যে থাকেননি। 

ভারতে একটা বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ বা জাতীয় স্বার্থ। এই শব্দের আড়ালে ভারতের সাংবাদিকতায় সমস্ত পাপ, জুলুম, অন্যায়, সরকারের কৃত অপরাধে আড়াল টানা, ন্যায়নীতি লঙ্ঘন সবকিছু ঢেকে ফেলা হয়ে থাকে। এর মানে সাংবাদিকতাও এই কথিত দানবীয় জাতীয় স্বার্থের অধীনে চালিয়ে দিতে হয়। কাজেই ভারতের সাংবাদিকতার সমস্যা আরও এককাঠি উপরে। এখানে এক হলো- ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’- এর আড়ালে রীতিনীতি, এথিকস এসব অকার্যকর ও ফালতু কথা? শুধু তাই না, আবার একটু খেয়াল করেন- মোদি সরকার তার আমলে তিনি যা করছেন, তা হিন্দুত্বের চিন্তার ওপরে দাঁড়িয়ে। মানে হলো, এই চোখে যা জায়েজ, সেটাই হলো ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’; আর তাই ভারতের সাংবাদিকতাতে অবশ্য পালনীয়! তাই কী?

এভাবে কোনো সাংবাদিকতা চলতে পারে? সেটা সাংবাদিকতা হবে? এক কথায় জবাব হলো, ভারতের কথিত ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের’ শর্ত মেনে এর অধীনে থেকে সাংবাদিকতা চলতে পারে না। 

তাহলে কী হবে? নিজের কথা যখন মিলবে না, তখন সৌম্যের মতো আবেগী ভাব ধরতে পারেন। সৌম লিখেছেন, ‘যে দুই দেশের সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নেই, সীমান্ত চিহ্নিতকরণের দায়িত্ব প্রকৃতির, মানুষের বিচরণ অবাধ এবং সামান্য কয়েকটি আঞ্চলিক ধোঁয়াশা ব্যতীত সম্পর্ক মোটের ওপর মসৃণ ও শান্তিপূর্ণ, সেখানে এই সীমান্ত বিবাদ অবশ্যই অনভিপ্রেত।’ 

অথচ এখনকার বাস্তবতা ঠিক এর উলটা। নেপাল-ভারত সীমান্ত ভিসা-পাসপোর্ট ওয়ালা আর পাঁচটা সীমান্তের মতোর দিকে যাচ্ছে। যার মূল কারণ, ১৯৫০ সালের চুক্তির রিভিউ রিপোর্ট বাধা দিয়ে রাখা হয়েছে। অচিরেই যা আর সম্ভব হবে না। বাধা দিয়ে রাখলে কী বিস্ফোরণ হবে তার নমুনা কলকাতার হিন্দুস্তান টাইমসের এ নিয়ে ছাপা হওয়া ক্ষুব্ধ সম্পাদকীয়তে এর ইঙ্গিত আছে।

এ ছাড়া সৌম্যের আরেকটা নতুন অভিমুখ দেখা যাচ্ছে। তা হলো, ফ্যাক্টস বেমালুম লুকিয়ে ফেলা, যেটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যেমন সৌম্য দাবি করেছে নেপাল-ভারত সীমান্ত ও তাদের সম্পর্ক ‘মোটের ওপর মসৃণ ও শান্তিপূর্ণ’। তার মানে একটা ল্যান্ডলকড রাষ্ট্র নেপাল থেকে ভারত তাকে ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে প্রায় ছয় মাস একটা সুচও আমদানি করতে দেয়নি। এটা সৌমের কাছে কোনো ঘটনা নয়। অথচ এই সময়ের নেপালের প্রতিটা গৃহবধূ জানে আর সব পণ্য আমদানি বন্ধ তো বটেই, গ্যাস ছাড়া রান্নার কী সুখ, আর তা সত্ত্বেও নেপালি রমণীসহ পুরুষ নিশ্চয় খুবই সুখী ছিল, আর তাতে নেপাল-ভারত সম্পর্ক একেবারে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নিশ্চয় ‘মোটের ওপর মসৃণ ও শান্তিপূর্ণ’ ছিল? তাই না?

আচ্ছা সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, এই জলজ্যান্ত ফ্যাক্টসটাকে তো ঢাকা দেয়া যাবে না- এটা লুকানোর চেষ্টা কি খুব দরকার ছিল? এটাও কি আপনার ভারতের জাতীয় স্বার্থের সাংবাদিকতা? 

আপনি লিখেছেন, ‘সংবিধান রচনার সময় যা হয়েছিল, ভারত-বিরোধিতার তীব্রতা যেখানে পৌঁছেছিল, ম্যাপ রাজনীতি সেই পুরনো দিন ফিরিয়ে আনুক, ভারত চায় না। ভারত বিলক্ষণ জানে, চীন কীভাবে চাদর বিছিয়ে রেখেছে এবং নেপালের রাজনীতি কতটা চীননির্ভর’। এই বাক্যগুলোর বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। একটা ল্যান্ডলকড দেশ নেপালের সীমান্তে ভারতের ওপর দিয়ে সমস্ত পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দেয়া হলে সারা নেপালের প্রতিটা মানুষ ভারতবিরোধী হবে এটা কি ভারত আশা করেনি? তাহলে ভারত-বিরোধিতার ওঠার দায় নেপালের ঘাড়ে দিচ্ছেন কেন? মুরোদ থাকলে ওই সময়ের রাজনীতিবিদ-আমলাদের জিজ্ঞাসা করেন। নাকি ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে তাদের জিজ্ঞাসা করা যাবে না! 

নেপাল-ভারতের সম্পর্ক ভেঙে পড়ার জন্য চীনকে দায়ী করে ‘চীন কীভাবে চাদর বিছিয়ে রেখেছে’ অথবা ‘চীন-নির্ভর রাজনীতি বলে দায় অন্যের ওপর চাপানো শতভাগ মিথ্যা ও অন্যায়।’ ফ্যাক্টস হলো, ভারতের আপত্তি পরোয়া না করে (কোনো রাষ্ট্রই করে না, করার কথাও না) ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নেপালি সংবিধানের ঘোষণা করা আর এরপর ওই অবরোধের প্রায় ছয় মাস চলার পর অর্থাৎ ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে প্রথম বিকল্প পথ খুঁজতে চীনের নাম সর্বপ্রথম দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিল। এর আগে নেপালের রাজনীতিতে চীন বলে কেউ ছিল না। এমনকি ভারতের বিকল্প হিসেবে চীন থেকে জ্বালানি আনার চুক্তি করার সময় চীন পালটা প্রস্তাব দিয়েছিল পুরা চাহিদা নয়, নেপালের ওয়ান-থার্ড চাহিদা চীন থেকে আনুক। কারণ নেপাল-ভারত সম্পর্ক চুকিয়ে দিতেই হবে, এতে চীনের স্বার্থ নেই। কারণ নেপালের কারণে ভারত-চীন সম্পর্কে দাগ দাগানো কোনো বুদ্ধিমান ও দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া চীনা নেতৃত্বের কাজ হতে পারে না। ভারতকে কেবল বাজার হিসেবে যদি দেখি তাতে ভারতের ভেতরে না হলেও পঞ্চাশটা নেপাল আছে এই কথা ভুলে যাবে কেন? এ ছাড়া সময়টা ছিল, আমেরিকার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে চীন-ভারতের প্রধান শেয়ার মালিকানার তাদের নতুন বিশ্বব্যাংক এআইআইবি ব্যাংকের জন্ম দেয়ার সময় ছিল সেটা, তাও আমরা মনে রাখতে পারি। 

কাজেই সৌম্যকে মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ চোখে ঘটনা দেখা বোঝা বন্ধ করতে হবে। 

আসল কথা হলো, সৌমকে ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের সাংবাদিকতা’ থেকে বের হতে হবে। ন্যূনতম এথিক্স, অবজেকটিভিটি ইত্যাদির মান সাংবাদিকতায় ধরে রাখতে হবে। আর প্রথম আলোকেও ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের সাংবাদিকতায়’ কোনো লেখাকে সম্পাদকীয় অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে। নইলে এটা প্রথম আলোর নিজের বিরুদ্ধে কাজ হবে।


গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //