বিপ্লবী চে’র ইমেজ এসে ঠেকেছে ব্র্যান্ড-প্রোমোটারের ভূমিকায়

দুঃখজনক হলেও চে’র ছবি আঁকা টি-শার্ট গায়ে অধিকাংশ তরুণই জানে না, কিউবার মুক্তি সংগ্রামে তার বুকে আঁকা ছবির মানুষটির ভূমিকা ছিলো কতোখানি। চে নিছকই আজ ফ্যাশান-প্রতীক মাত্র। খুব বেশি হলে তাদরে কেউ হয়তো তাকে চেনে একজন বিদ্রোহী হিসেবে ।

চে’র আদর্শ-সংগ্রাম আজ বিস্মৃত-প্রায়। বিপ্লবীর চেয়ে বিজ্ঞাপনে চে’র কদর আজ অনেক বেশি। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার মুদ্রিত ছবিটি চে’র। এ ছবিটি  তুলেছিলেন ফ্যাশন ফটোগ্রাফার আলবার্তো কোরদা। ছবিটিতে তিনি চেয়েছিলেন একজন আত্নবিশ্বাসী, নিজ লক্ষ্যে দৃঢ়চেতা মানুষকে ফ্রেমবন্দি করতে। কিন্তু হায়, ইতিহাস তাকে বহুল পরিচিতি দিয়েছে বিদ্রোহী হিসেবেই।

আলবার্তো কোরদার ছবির চে আজ বহুল ব্যবহৃত, নিছকই বাণিজ্যিক স্বার্থে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাড়াতে, ব্র্যান্ড প্রোমোতে ছবির চে আজ সবচেয়ে আদৃত ইমেজ। ব্যাকপ্যাক, বিকিনি, বেল্ট, ওয়ালেট, মাউস প্যাড, লাইটার, কী চেইন, ক্যাপ, টি-শার্টের খুচরো ব্যাবসায়ে তো চে’র ইমেজ আছেই। কর্পোরেট ব্যবসাদারদের কাছেও চে’র কদর পৃথিবীর অন্য যে কোনো ইমেজের চেয়ে বেশি।

জায়ান্ট কর্পোরেট-হাউসগুলো তাদের যে কোনো উচ্চাভিলাসী-পণ্য বাজারজাত করার আগে পণ্যের পরিচয় তুলে ধরতে চে’র ইমেজকেই মনে করে সবচেয়ে ঝুঁকিমুক্ত, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। তা সে মার্সিডিজ বেঞ্জ হোক বা স্মিরনঅফ। ইউনিলিভারের চেরি ফ্লেভার আইসক্রিম হোক বা লাইকার ক্যামেরা। চে স্নিকার্স হোক বা এল চে কোলা।

বিপ্লবী চে’র ইমেজ যেনো এসে ঠেকেছে ব্রান্ড-প্রোমোটারের ভূমিকায়। আলবার্তো কোরদার তোলা চে’র ইমেজ এখন ব্যবসা বাড়ানোর লোগো। একজন সাহসী যোদ্ধার মুখ এখন কেবলই ফ্যাশন আইডলের মুখচ্ছবি। রকস্টার ক্লাশ তাই গেয়ে ওঠেন “…You think it’s funny, turning rebellion into money?”।

সাউথ-ওয়েস্টার্ন রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক এরিক সেলবিন বলছেন, ‘চে’র পণ্যায়ন, বাস্তবতাবতা ও কল্পজগতের সংমিশ্রণ’। পুজিঁবাদীদের খণ্ডিত-বিকৃত মুনাফামুখী উপস্থাপনের বিপরীতে আমরা চে’র বিপ্লবী প্রতিচ্ছবিটি দেখেছি ১৯৬৮ তে পশ্চিম তীর গাজায়, ১৯৭৯ তে দেখেছি তেহরানে, সম্প্রতি ২০১১’র আরব-বসন্তে। তেহরির স্কয়ারে, তিউনিসিয়ায়, বাহরাইনের দেয়ালে আঁকা লড়াকু চে গুয়েভারার ছবিটি।

সেলবিন বলছেন, ‘চে ইতিহাসের প্রতিনিধি। তাকে এভাবে বাজারের কাছে একচেটিয়া বন্ধক দিয়ে দেয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে ক্ষীণ হলেও প্রতিবাদ হচ্ছে’। স্মিরনঅফ ভোদকার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চে’র ইমেজ বিকৃতির জন্য।

এ মামলার আইনজীবী রাজী মিরেসকান্ডারী তার বলেছেন, ‘চে মদ্যপান করতেন না। স্মিরনঅফ ভোদকায় তার ছবি ব্যবহরের ফলে কিউবার জনগণ আহত হয়েছেন। তার ইমেজকে স্মিরনঅফ ভোদকার বিক্রি বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে’।

চে গুয়েভারার পরিবারও তার বিপ্লবী ইমেজকে সংরক্ষণ করতে চায়। প্রতিরোধ করতে চায় চে গুয়েভারার বাণিজ্যিক ব্যবহার। চে গুয়েভারার কন্যা এলেইডা গুয়েভারা নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা টাকা চাই না…আমরা চাই না তাকে অপব্যবহার করা হোক।

ব্রাজিলে একটি ফ্যাশন শোতে তার পরিবারের সদস্যরা বিকিনিতে চে’র ছবি ব্যবহারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। নিউইয়র্ক টাইমসে মেরি লেসি লেখেন, কোনো মেসেজ ছাড়াই চে’র ছবি ব্যবহৃত হয়েছে …তিনি যেনো অসম্ভব রকম দামি বিকিনিতে শুধুমাত্র একটি প্যাটার্ন-একটি ডিজাইন। একজন বিপ্লবীর ছবির এ ধরনের বিকৃত ব্যবহরের বিরুদ্ধে তার পরিবারের সদস্যরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

মেক্সিকোতে চে গুয়েভারার সাথে ফিদেল কাস্ত্রোর দেখা ১৯৫৯ সালে। ফিদেল চে গুয়েভারাকে আমন্ত্রণ জানালেন কিউবায় বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে যোগ দেয়ার। চে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, ফিদেলের সাথে যোগ দিয়ে কিউবায় বিপ্লব সফল করেন। কিন্তু চে’র বিপ্লবী হয়ে ওঠার প্রণোদনা তার জন্মস্থান আর্জেন্টিনা থেকে একটি মোটরসাইকেলে যাত্রা শুরু করে ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণের সময়কাল। 

কিউবান বিপ্লবের পর ফিদেল তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু চে’র রক্তে বিপ্লবের উন্মাদনা। তিনি তখন স্বপ্ন দেখছেন বিশ্ব-বিপ্লবের। বেরিয়ে পড়েন কিউবা থেকে। বেছে নেন গেরিলা যোদ্ধার জীবন। ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় মার্কিন গোয়েন্দাদের দ্বারা নৃশংসভাবে খুন হন।

চে আমৃত্যু যোদ্ধা। দৃঢ়চেতা। লক্ষ্যে স্থির । আপোষহীন। লড়াকু। পুঁজিবাদীদের কাছে এ চরিত্র বাস্তবের নয়, কল্পজগতের। তাই বিপ্লবী চে’কে তারা পণ্য বিক্রির কাজে লাগায়। তাকে কল্পজগতের চরিত্র বানাতে চায়। চে’র অনুরাগীরাও পুঁজিবাদীদের পাতা এই ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হন।

চে বিপ্লবী। কল্পজগতের বীর নন। ভেনিজুয়েলা, কঙ্গো, বলিভিয়ায় তাঁর পরাজয় আছে। ফিদেলের নেতৃত্বে তিনি কিউবায় জয়ী। বিপ্লবী চে’র মূল্যায়ন বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে যদি শুধু বীর পূজায় সীমিত হয়ে পড়ে, তাহলে তার দ্বারা ব্যবসাদাররাই লাভবান হবেন।

আবারও সেলবিনের কথা ধার করে বলি, চে’কে পরিণত করা হয়েছে একটা শূন্য অবয়বে, যে যেমন ইচ্ছা তাতে অর্থ আরোপ করতে পারে।


আরশাদ সিদ্দিকী

লেখক-গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //