জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অবিনশ্বর

দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম, কলঙ্কময় এবং শোক ও মর্মবেদনার দিন রক্তাপ্লুত ১৫ আগস্ট। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন। এ বছর ১৫ আগস্ট তাই আরও অনেক বেদনা ওই শোককে গভীরতর করছে। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে আছে সারাবিশ্ব। এ মহামারির কারণে অর্থনীতি এখনো অনিশ্চিয়তার মধ্যে আছে। এর মধ্যে আবার দেশের অনেক অঞ্চল বন্যাকবলিত। 

বন্যা হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য ঘাটতির মতো ১৯৭৪ সালের ভয়াবহতম বন্যা ও দুর্ভিক্ষাবস্থার চিত্র। নীলনকশা কার্যকর করতে একাত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য জাহাজ পাঠানো বন্ধ করা, জালপড়া বাসন্তীর সাজানো ছবি প্রকাশ, কিসিঞ্জারের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, ওই ধুরন্ধর শত্রুর সফর ও চরম বিপদের দিনে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কটাক্ষ করা আর একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথিত সরকার ও দলের ভেতরে ‘চাটার দল’-এর চোরাচালানি-মজুতদারি-মুনাফাখোরদের বাড়বাড়ন্ত প্রভৃতি ঘটনা ঘটেছিল। 

সংসদীয় গণতন্ত্রের সব সুযোগকে গ্রহণ করে জাতিকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার দিকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ঠান্ডা যুগের সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্রের বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অভিমুখী দেশকে পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে দ্বিতীয় বিপ্লবে জনগণকে শামিল করতে উদ্যোগ নেন; কিন্তু দেশি-বিদেশি কুচক্রি ঘাতকরা সেই সুযোগ বঙ্গবন্ধুকে দেয়নি। প্রশ্ন হলো ঘাতকরা কেন হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে? পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের দাম কি কমেছিল? ঘুষ-দুর্নীতি, নৈতিকতায় ধস? গণতন্ত্র বন্দি হয়ে পড়েছিল ক্যান্টনমেন্টে। হত্যা-খুন-ক্যু-পাল্টা ক্যুর মধ্য দিয়ে দেশ চলছিল। পঁচাত্তর পরবর্তী শাসকরা চেয়েছিল, রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে সুবিধাবাদী-সুযোগসন্ধানীদের দিয়ে রাজনৈতিক দল করে রাজনীতিকে কলুষিত ও হাতের পুতুল করতে। বাঙালি জাতিসত্তাকে ধ্বংস এবং সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয় জীবন প্রতিষ্ঠা করতে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর বিপরীতে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’-এর অর্থনীতি চালু করতে; কিন্তু পারেনি। প্রতিক্রিয়াশীলতা সবসময়েই স্থান করে নেয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এরই মধ্যে জাতীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অযৌক্তিক-অশুভ-অন্তহীন লড়াই, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদের উত্থান, নৈতিকতায় ধস ও লোভ-লালসার বাড়বাড়ন্ত প্রভৃতিতে বিশ্ব পরিমণ্ডল আজ পরিব্যপ্ত। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে লক্ষ্য অর্জনের পথ সংকটপূর্ণ। করোনা-বিপর্যয়ের মধ্যে পথ আরও বিপদ সংকুল। আঁকাবাঁকা, চড়াই-উৎরাই, আগু-পিছু পথে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশকে আজ অগ্রসর হতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে এবারের জাতীয় শোক দিবস পালন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

রাজনীতির একটা স্বতঃসিদ্ধ প্রবাদ রয়েছে যে, বিপ্লবের পিছু পিছু আসে প্রতিবিপ্লব। কখনওবা দ্রুতই প্রতিবিপ্লব বিজয়ী হয়; নেতাদের করা হয় হত্যা এবং বিপ্লবের মর্মবাণী ও আদর্শকে করা হয় পদদলিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের, সাম্প্রদায়িতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার, শোষণের বিরুদ্ধে শোষণ মুক্তির, অমানবিকতা বিরুদ্ধে মানবতার লড়াই, গণহত্যার বিরুদ্ধে গণবিপ্লব। বিদেশি শক্তি ও দেশীয় গণবিচ্ছিন্ন দালালদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের সাফল্যের পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। আর পঁচাত্তরের কালরাত্রে প্রতিবিপ্লবী শক্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। পরে বঙ্গবন্ধুর সহযোগী মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ইতিহাস কি প্রমাণ করেছে? প্রমাণ করেছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অবিনশ্বর। কোনো অপশক্তিই তা ধ্বংস করে দিতে পারেনি, পারবেও না। কারণ মূলত চারটি। প্রথমত, এই আদর্শ দেশজ, আবার বিশ্বজনীন। মানব সভ্যতা ও এই মানচিত্রের জনগণের হাজার বছরের চলমান ইতিহাসের সুকৃতির নির্যাস নিয়ে বাংলার মাটি ও মানুষ থেকে এর সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত, ’৪৮-’৫২ ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফূরণ হয়, সুদীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সে চেতনা পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করে, সেই চেতনারই ধারক ও বাহক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তৃতীয়ত, ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালির স্বপ্ন-প্রত্যাশা-আকাঙ্ক্ষাকে ওই আদর্শ ধারণ করে আছে। চতুর্থত, চিরায়ত মানবিক মূল্যবোধে তা সমৃদ্ধ। তাই এই আদর্শকে ধ্বংস করার ক্ষমতা কারও নেই। এই আদর্শকে তিনি ধারণ করেছিলেন বলেই তিনি জাতির অবিসংবাদিত মহানায়ক, জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। একই সঙ্গে বিশ্বের রাজনৈতিক নায়কদের মধ্যে রয়েছেন সামনের সারিতে। 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চারটি স্তম্ভ বা খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন প্রবাসী সরকার ছিল, তখন এ সরকার জাতীয় মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুক্ত করলেন চতুর্থ মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ। তিনি বললেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি না থাকে, তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রকৃত বিচারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা জাতীয় চারনীতির অর্থ ব্যাপক ও বহুমুখী। 

কিন্তু তিনি চার জাতীয় মূলনীতির একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। শর্তমুক্তও করেননি। চারটি পরস্পরের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত এবং একটাকে অপরটা থেকে পৃথক করার কোনো উপায় নেই। গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটিয়ে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা ছিল তার আদর্শের বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত নবোজাত দেশে যখন তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন যেমন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল- গোষ্ঠীগুলোকে বেআইনি করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে অগ্রসর করে নেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি রোধ করতে, মজুদদারি-মুনাফাখোরী-কালোবাজারী বন্ধ করতে, উগ্র দলগুলোর নাশকতামূলক কাজ নির্মূল করতে, দুঃখী মানুষের হাসি ফোটাতে সমাজতান্ত্রিক ধাচের রাজনীতি ও অর্থনীতি চালু করেন। চারটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়াই ছিল এ শ্রেষ্ঠ বাঙালির লক্ষ্য।

দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যে ছিল তার আদর্শের মূলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগ দল গঠন সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে জমিদার, জায়গীরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। জনগণ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ সমর্থন দেয়।’ আওয়ামী লীগের আদর্শ ও অবস্থানের গতিপথ দলের জন্মলগ্নেই দলের তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো তিনি কি এটা দলিলপত্রের পাতায় বা মঞ্চের বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন। তা আদৌ নয়। তিনি ওই আদর্শ বাস্তবায়িত করতে বাস্তব ‘গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন এবং পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেছিলেন; কিন্তু দেশি-বিদেশি পরাজিত শত্রু এবং দল ও সরকারের মধ্যে স্বার্থান্বেষী মহল বঙ্গবন্ধুকে সংসদীয় পথে অগ্রসর হতে দেয়নি। 

কিছুই করতে দেয়নি প্রতিহিংসাপরায়ণ ঘাতকচক্র। বঙ্গবন্ধুতে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জাতীয় চার মূলনীতিকে পদদলিত করতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র; কিন্তু ইতিহাস কি প্রমাণ করেছে? প্রমাণ করেছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অবিনশ্বর। কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কোনো অপশক্তিই তা ধ্বংস করে দিতে পারেনি, পারবেও না।

আমরা যদি পঁচাত্তর ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, সামরিক কর্তারা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে একে একে নস্যাৎ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী জাতি কখনো ভয় করে না। গণমুখী-দেশমুখী আদর্শের শক্তি প্রতিক্রিয়ার শক্তির চাইতে অনেক শক্তিশালী। বাংলার মাটি-সিক্ত বঙ্গবন্ধুর রক্ত ওই আদর্শকে সমাজ জীবনের গভীরে প্রোথিত করে আরও শক্তিশালী করছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাংলার মানুষের সঙ্গে আছে। জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //