মিলটন সফির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিভৃতে নির্বাসনে’

মিলটন সফি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত হওয়া একজন কবি ও কথা সাহিত্যিক। মূলত কবি হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসলেও সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে রয়েছে তার সাবলীল বিচরণ। 

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কালোপুরুষ’ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। পরের বছরই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘একটি স্বপ্নস্নাত নারীর জন্যে প্রার্থনা’। অতঃপর হঠাৎ করেই নির্বাসন। যখন শব্দে-ছন্দে, চিত্র-কল্পে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। কবির এই নির্বাসিত জীবনের গল্প জানতে বসেছিলাম এক সন্ধ্যায়। 

এর আগে একটু বলে নিই, এ বছর তার নতুন কবিতার বই ‘নিভৃতে নির্বাসনে’ আসছে একুশের বইমেলায়। বইটি প্রকাশ করেছে শিখা প্রকাশনী। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছে চারু পিন্টু। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত না হলেও বইয়ের ছাপা বাঁধাই শেষ হয়েছে। কবিতা প্রাণ এই মানুষটি শুধু কবিই হতে চেয়েছিলেন, কবিতাকে ভালোবেসে হেটেছেন যোজন যোজন দূর। হাতের মুঠোয় নিয়েছেন ভালোবাসা, সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলো এঁকেছেন কবিতার রঙে। সেই মানুষটাই ১৫ বছর ছিলেন কবিতা থেকে অনেক অনেক দূরে। 

কেনো এই নির্বাসন, জানতে চাইলে তিনি জানান, মনের মধ্যে অনেক কথা জমা, সেই জমে থাকা কথাগুলো কখনো যেনো কবিতা হয়ে থরে থরে জমতে থাকে পড়ার টেবিলে। এর মধ্যে কিছু লেখা পত্রিকায়ও ছাপা হতে লাগলো। ছাপার অক্ষরে মনের কথাগুলো ছুয়ে দেখি আর বিস্মিত হই। যে কথাগুলো মনের মধ্যে জমতে জমতে এক সময় চাপা পড়ে যাচ্ছিলো অথবা বলবো বলবো করেও বলা হয়ে উঠেনি কিংবা পারিনি, সেই কথাগুলো বলতে পারার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিলো এবেলা না বলতে পারলে হয়ত আর কখনোই বলা হয়ে উঠবে না। সে কথাগুলো জানাতেই বই করার সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং দুই বছর চেষ্টার পর বইটা প্রকাশিত হয়েছিলো ২০০৪ সালে এবং পরের বছরই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটা এসেছিলো। জানি না এই শহরের মানুষ আমার সেই গোপন কথার খোজ নিয়েছিলো কিনা। জানি কেউ জানেনি, অথবা জানবেও না। তারপর থেকে আর প্রকাশ হতে ইচ্ছে হলো না। পরে রইলাম নিভৃতে নির্বাসনে, তার এবং সাবার চোখের আড়ালে। এভাবেই দিন মাস বছর চলে গেছে এক লহমায়। তাই ১৫ বছরের যাপিত জীবনের গল্পটা আমার কাছে খুব দীর্ঘ নয়। 

জানতে চাই, নিভৃতে নির্বাসনের এই দীর্ঘ সময়ের যাপিত জীবনের গল্পটা এবং কেনো ফিরে আসা? 
গত দু’ তিন বছর যাবৎ মনের মধ্যে কোথায় যেনো একটা শূন্যতা, কি যেনো হারিয়ে ফেলেছি বোধ করছিলাম। ভেঙেচুরে নিজেকে গড়তে চেয়েছি বারংবার, পারিনি। শেষ অব্দি কবিতার জয় হয়েছে। তাছাড়া খুব বেশী কবিতা আমি লিখতে পারি না। নিয়ম করে কখনো আমার লেখা হয়ে উঠে না। তাই চাইলেও হয়ত অনেক বই আমি বের করতে পারতাম না। হৃদয়ে যে কবিতার বাস তাকে মস্তিস্ক দিয়ে বুঝতে চাইনি কখনো। কবিতার জন্যে এই জন্ম মেনেছিলাম, নিজের কাছে দেওয়া সে প্রতিশ্রুতি আমি রাখতে পারিনি। আমি সরে গেছি। একটা সময় ছিলো যখন একদুপুরে দশ-বারটা কবিতা লিখে ফেলতে পারতাম। এখন তা পারি না। 

জীবন ও জীবিকার অর্থ-অনর্থ দাড় করাতে না করাতেই চলে যায় দিন-মাস-বছর, বড় অবহেলায়। কখনো সংসারে অথবা ভিড়ের মধ্যে নিঃসঙ্গ লাগে, বোধে টের পাই না রহস্যময় সেই হাতছানি, স্মৃতিতে ও অবচেতনায়, স্তবকে। স্বতঃসিদ্ধ ছন্দোনৈপুণ্যে আঁকতে পারি না ভালোবাসা, নিজের মধ্যে খুজে বেড়াই নিজেকে। একদিন যে কলমে ছন্দ পোষ মেনেছিলো নিঃশর্ত, সে আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে যেতে চায় আকাশের ওপারে। তাকে বেধে রাখার দড়ি আমার কই?

শ্রেণীসংগ্রাম, প্রকৃতি-জীবন, প্রেম ও নারী আপনার কবিতার মূল বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে বারবার। এবারের কবিতাগুলো কোন ঘরনার এবং কতগুলো কবিতা আছে বইটিতে?
শ্রেণীসংগ্রাম, প্রকৃতি-জীবন, প্রেম ও নারী- এগুলো সবইতো জীবনের এক একটি দিক। আমি নির্দিষ্ট কোনো ঘরনার কবিতা চিন্তা করে কবিতা লিখতে পারি না। ভালো কবিতা বা মন্দ কবিতাতেও আমার বিশ্বাস নেই। এই যে আমরা বলি ভালো কবিতা অথবা মন্দ কবিতা। এটা কে বলে দিতে পারে কোনটা ভালো কবিতা? এখনতো অনেক ছোট ছোট কবিতা আসছে, দু’চার লাইনের অনু কবিতা আসছে। অস্থির সময়ে এই অনু কবিতাগুলোই কিন্তু জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বেশী। বইটিতে মোট ৬৮টি কবিতা আছে এবং এর বেশীর ভাগই অনেক পুরনো সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, সাবধানী, একটানা সংসারী, নিরাপদ নির্বিঘ্ন জীবনই কি আমি চেয়েছিলাম? কবিতার মধ্যে ডুবে থাকার যে স্বপ্ন, সেটা কখন কর্পূরের মতো উড়তে লেগেছিলো তা জানতেও পারিনি। এবং এই ব্যর্থতা আমাকে পোড়ায় সকাল বিকেল। তবুও বলতে চাই, কবিতারা বেচে থাকুক, ভালো থাকুক। কবিতার রঙে সাজাই দুনিয়া।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : মিলটন সফি

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //