খালেদা জিয়ার শর্তসাপেক্ষ মুক্তিতে স্বস্তি বিএনপির

দীর্ঘ ৭৭৫ দিন পর কারামুক্তি পেয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজা স্থগিত করে নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। 

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক দিক বিবেচনায় সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেয়। তবে দুটি শর্ত যুক্ত থাকছে এ মুক্তিতে। শর্ত অনুযায়ী, এই সময়ে বিদেশ যেতে পারবেন না খালেদা জিয়া। নিজ বাসায় থেকে তাকে চিকিৎসা নিতে হবে। 

দুই বছরের বেশি সময় ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে আসছে বিএনপি। কারাবন্দি খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ দাবি করে তার মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে দল ও পরিবার। তার মুক্তির দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করলেও কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি সরকারের ওপর। নিম্ন আদালতের পর উচ্চ আদালত থেকেও মেলেনি জামিন। শেষ পর্যন্ত মানবিক দিক বিবেচনায় নির্বাহী আদেশে মুক্তি চেয়ে আবেদন করে তার পরিবার। এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎও করেছেন। অবশেষে এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তযুক্ত মুক্তি পেলেন খালেদা জিয়া। 

তবে এমন শর্তযুক্ত মুক্তির ব্যাপারে নানা প্রশ্ন, হতাশা, আপত্তি ও আতঙ্ক রয়েছে দলটির নানাপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঝে। শর্ত নিয়ে আপত্তি থাকলেও সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তে স্বস্তি প্রকাশ করেছে বিএনপি। 

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পরিবার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দীর্ঘ পঁচিশ মাস পর খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের জন্যই তা স্বস্তির। বিএনপি নেতারা প্রত্যেকেই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। 

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে এটি অবশ্যই আনন্দ ও স্বস্তির খবর। সন্তান হিসেবে এ জন্য আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।’ 

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা কিছুটা আবেগাপ্লুত তো বটেই, কিছুটা স্বস্তিও বোধ করছি। সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন ছিল। ছয় মাসের জন্য হলেও তিনি কারাগারের বাইরে, সেটাই স্বস্তির।’ 

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে সরকারের।’ 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুটি শর্তের মধ্যে একটি- ‘চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ না থাকা’। বর্তমান সময়ের জন্য কঠিন নয়। কারণ এখন সার্বিক পরিস্থিতিতে তিনি চাইলেও বিদেশে যেতে পারবেন না। তবে দ্বিতীয় শর্তটি অত্যন্ত কঠিন। কারণ প্রশ্ন থাকছে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন কিনা? উত্তরটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। 

যে ধারায় মুক্তি দেয়া হয়েছে, সেখানে কেবল চিকিৎসার কথা উল্লেখ থাকলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। তখন সেটাকে শর্তভঙ্গ বিবেচনার সুযোগ পাবে সরকার এবং চাইলে কারাগারে ফিরিয়ে নিতে পারবে। ৪০১(৩) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘যে সকল শর্তে কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছে তার কোনোটি পালন করা হয়নি মনে করলে সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা মওকুফ করা হয়েছিল সে মুক্ত থাকলেও যেকোনো পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন এবং তার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করার জন্য তাকে জেলে প্রেরণ করা যাবে।’

সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া রয়েছে দলটির নানা পর্যায়ে। সিনিয়র নেতারা বলছেন, বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী জামিন প্রাপ্য ছিল খালেদা জিয়ার; কিন্তু তাকে জামিন দেয়নি হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ। অথচ শর্তযুক্ত মুক্তির সিদ্ধান্তটি শেখ হাসিনা নিয়েছেন। এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে সরকারের তরফে যে বয়স বিবেচনা, মানবিক কারণ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার কথা বলা হচ্ছে তার কোনোটিই নতুন নয়। 

নেতারা অভিযোগ করেন, সরকার আগেই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় তাকে মুক্তি দিতে পারত; কিন্তু দেয়নি। সব কিছুর ঊর্ধ্বে আছে একজনের ইচ্ছা। উচ্চ আদালতও সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারে না। 

এদিকে দলটির তৃণমূল নেতারা এমন মুক্তির পেছনে দেখছেন দলের সিনিয়র নেতাদের ব্যর্থতা। তারা বলছেন, নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার শর্তযুক্ত মুক্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে রাজনৈতিকভাবে সরকারের কৌশল মোকাবেলায় ব্যর্থ বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরাম। যে কোনো ইস্যুতেই তারা সরকারের সঙ্গে কৌশল-পাল্টা কৌশলের মাঠে নামার আগেই হজম করছে গোল। 

পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক সক্ষমতা। যে কাজটি আন্দোলন বা আলোচনার যেকোনো কৌশলে দলের তরফে আদায় হওয়া উচিত ছিল, সেটা করেছে খালেদা জিয়ার পরিবার। আইনি লড়াইয়ের কথা বলে বরং দলের সিনিয়র নেতৃত্ব বিলম্বিত করেছেন তাদের সে উদ্যোগ। 

বিএনপি নীতিনির্ধারণী মহল বলছে, আজকের এই মহামারির সময় হিংসার রাজনীতির অবসানে সরকারের এই সিদ্ধান্ত আগামী দিনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারি আক্রান্ত নানা দেশে সাধারণ ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিচ্ছে ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে। বাংলাদেশে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী এখনো কারাবন্দি। সরকারের নির্বাহী আদেশে তাদের মামলা প্রত্যাহার বা অন্তত নির্দিষ্ট মেয়াদে মুক্তি দেয়া হলে সে ইতিবাচক মনোভাব আরো অর্থবহ হবে। 

যুক্তরাজ্য থেকে এক ভিডিও বার্তায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এই দাবি করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে দারুণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে মুক্তির সময় নির্ধারণে। সদ্ব্যবহার করেছে দুঃসময়ের। তারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে খালেদা জিয়া যেকোনো বিবেচনায় মুক্তি পেলে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিপুল সমাবেশ ঘটত রাজপথে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এখন সেই সুযোগ নেই। মহামারি প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বাস্তবতায় নেতা-কর্মীসহ দেশের মানুষ ঘরবন্দি। কাছাকাছি সময়ে কোনো সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনসমুদ্র তৈরির সুযোগও পাবে না বিএনপি। বলতে গেলে রাজনৈতিকভাবে দারুণ একটা মার খেয়েছে বিএনপি। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে যে, হাসপাতাল ও খালেদা জিয়ার বাসার সামনে ভিড় না করার জন্য বিবৃতির মাধ্যমে বিএনপি মহাসচিবকে অনুরোধ জানাতে হয়েছে দলের নেতা-কর্মীদের। 

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারে নীরবে ঝুঁকি এড়িয়েছে সরকার। এছাড়া সংকটময় পরিস্থিতিতে বিরোধী নেত্রীকে কারামুক্তি দিয়ে বিশ্বের কাছে নিজেদের ইতিবাচক ইমেজ তৈরির একটি সুযোগও তৈরি হয়েছে সরকারের সামনে। আগামী দিনে প্রচার-প্রচারণায় সে সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে পুরোমাত্রায় চেষ্টা করবে তারা। 

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সরকার যখন সমালোচনার মুখে পড়েছে, তখন খালেদা জিয়ার মুক্তিকে কেন্দ্র করে আপাতত সে সমালোচনার তীর থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা মিলবে তাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুক পোস্টে খালেদা জিয়ার মুক্তির সিদ্ধান্তটি স্বস্তিকর উল্লেখ করে সরকারকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। 

তিনি লিখেছেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। সাজা স্থগিত রেখে তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই, সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। বেগম জিয়ার মরণাপন্ন অবস্থা হয়েছে বলে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কিনা এ নিয়ে সমাজে সন্দেহ থাকতে পারে। এমন ধারণাও থাকতে পারে যে, করোনা পরিস্থিতির কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাধ্য হয়েছে। যে বিবেচনায় উনি সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাচ্ছেন একই বিবেচনায় কেন উনি জামিন পাননি কিছুদিন আগেও এই প্রশ্ন তুলতে পারে কেউ। আমি তবু সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কারণ উনার মুক্তির পেছনে যে বিবেচনা থাক না কেন, মুক্তির সিদ্ধান্তটি বেগম জিয়ার জন্য ভালো। আমাদের নেতা-নেত্রীরা একে অন্যের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত নিলে তা দেশের জন্যও ভালো। বেগম জিয়ার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। কামনা করছি বড় দুই দলের সম্পর্কের সুস্থতার।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //