সাইফুল ইসলাম তানভীর
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫২ পিএম
উন্নয়ন আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু এ জন্য কোটি কোটি মানুষের জীবনের যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার; কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রায়ই এ ব্যাপারগুলোকে উপেক্ষা করা হয়। যেমন রাজধানী ঢাকা শহরে এখন মেট্রোরেলের কাজ চলছে। কিন্তু এ কারণে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে প্রচণ্ড বায়ুদূষণ হচ্ছে। ধুলার জন্য চোখ বন্ধ হয়ে আসে। যদিও ঢাকা শহরে অনেক আগে থেকেই বায়ুদূষণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে মেট্রোরেলের কাজের জন্য সেটা বহুগুণে বেড়ে গেছে। নির্মাণকাজ চলতেই পারে। কিন্তু নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবেই তো কাজ করা উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকার দিকে যদি তাকাই, দেখব জলবায়ু, পরিবেশ নিয়ে বড় বড় সেমিনারে সুন্দর সুন্দর কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু কি কাজ হচ্ছে? সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ১০ কোটি টাকার মালামাল পাহারা দিতে ৪৬ কোটি টাকা খরচের কথা প্রকাশ করেছে। এই যদি হয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বৈশিষ্ট্য তাহলে তারা কীভাবে বায়ুদূষণ বন্ধ করতে কাজ করবে। তাদের দিয়ে কীভাবে একটি সুন্দর দেশ গড়া সম্ভব। যেমন ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) বিশাল একটি অফিস ভবন আছে। ভবনটির অধিকাংশ ফ্লোর ফাঁকা। কর্মরতদের বেশিরভাগকে অফিসেই পাওয়া যায়। রাস্তাঘাটে খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় বড় পাইপ ফেলে রেখে এরাও কম বায়ুদূষণ করছে না। কিন্তু সার্বিকভাবে এগুলো নজরদারি করার দায়িত্ব কার, সেটাই বোঝা যায় না। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যেমন বাড়ছে যানজট, অন্যদিকে বায়ুদূষণ।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি পত্রিকার খবরের শিরোনাম ছিল- ‘মাতৃগর্ভেই বায়ুদূষণের শিকার।’ গবেষকরা মনে করছেন বায়ুদূষণের কারণে গর্ভপাত, সময়ের আগেই শিশুর জন্মগ্রহণ এবং জন্মের সময়ে শিশুর কম ওজনের ঝুঁকি বাড়ছে। খবরটি থেকে প্রথম কয়েকটি বাক্য এখানে তুলে ধরছি- ‘প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলে অতিক্ষুদ্র কার্বণ কণার অস্তিত্ব পেয়েছেন গবেষকরা। নতুন এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভ্রুণের বেড়ে ওঠায় গর্ভফুলের যে অংশ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান সরবরাহ করা হয়, সেখানে অতিক্ষুদ্র কার্বন কণার অস্তিত্ব প্রথমবারের মতো গবেষকরা পেয়েছেন।’ তথ্যটি উদ্বেগজনক সন্দেহ নেই। কিন্তু এ থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কী করে? সমগ্র বাংলাদেশেই চরম পরিবেশ বিপর্যয়, পরিবেশদূষণ। বিশেষ করে বছরের পর বছর ধরে মহাসড়কগুলোতে যে নির্মাণ এবং সংস্কার কাজ চলে, তা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণও বটে। এগুলোর কারণে ব্যাপক পরিমাণে ধুলাবালির সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘ ২৩ বছর পর গত ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলাম। স্ত্রীকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করার সময় সেখানেও দেখেছি পরিবেশদূষণ। ধুলাবালির জন্য সেখানেও চারপাশ ঝাপসা হয়ে থাকে। যদিও আবার বৃষ্টির সময় পানিতে ভরে যায় শহর। আমার শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা চট্টগ্রাম শহরে কেটেছে। তখন এরকম বায়ুদূষণ দেখিনি। সিটি করপোরেশন, এলজিইডি, ওয়াসা, তিতাস, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে বায়ুদূষণ বাড়ছে। খোঁড়াখুঁড়িতো করতেই হবে, কারণ এর সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক। কিন্তু মাসের পর মাস গর্ত করে ফেলে রাখলে পরিবেশ নষ্ট হবেই। বায়ুদূষণও বাড়বে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, বিটিসিএল, রাজউকসহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বছরজুড়েই অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করে জনদুর্ভোগ ও বায়ুদূষণ বাড়িয়ে তোলে। একই সড়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতার কারণে কয়েকদফা খোঁড়া হয়। কর্তৃপক্ষের এসব ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। উন্নত ব্র্যান্ডের গাড়ি, ঘন ঘন বিদেশ সফর, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় ফ্ল্যাট, কি নেই তাদের? কিন্তু যে জিনিসটি নেই, সেটা হচ্ছে নীতি-নৈতিকতা। যে কারণেই হয়তো সাধারণ বালিশ, পর্দার কাপড়, বই, টিনের ভাউচার নিয়ে এত এত হইচই। অন্যান্য বড় বড় জিনিসের ভাউচারতো এখনো উন্মোচিত হয়নি। তখন বোঝা যাবে এদেশে আরও কি কি হচ্ছে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ সংগ্রামে নেমেছিল। এমন একটি দেশে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিরা নিজেদের অফুরন্ত চাহিদা মেটাবেন, অথচ জনগণ দূষণমুক্ত পরিবেশটুকুও পাবে না- এটাতো কথা ছিল না। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের ফলে শুধু গরিব লোকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং ধনী, গরিব, সরকারি, বেসরকারি, বিরোধী দল নির্বিশেষে সবারই ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণাও করছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ কেউ রামপালে ভারতীয় কোম্পানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবেশের কোনো ক্ষতি দেখছে না। কি মেধা নিয়ে তারা কাজ করছে- ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। যেখানে এই পরিবেশদূষণের ইস্যুতে এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন পাওয়া গেছে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে যার, ফলে পরিবেশ আইন ১৯৯৭-এ বেঁধে দেওয়া পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার সীমার (প্রতি ঘনমিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম) তুলনায় এইসব বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা অনেক বেশি হবে (প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি) যার ফলে এসিড বৃষ্টি, শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতিসহ গাছপালা জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে। এটি তো একটি মাত্র উদাহরণ। এ রকম অসংখ্য ক্ষতির তালিকা রয়েছে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তবে আজ সেসব নিয়ে আলোচনা নয়।
সামনে শীত মৌসুম। অন্য সময়ের চেয়ে শীতে বায়ুদূষণ আরও বেড়ে যায়। ঢাকা শহরে যে উন্নয়ন কর্মকা- চলছে তাতে যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করা যায়- সেটা এখনই চিহ্নিত করে সমাধান বের করা দরকার। নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর নয়, এ ক্ষতিটা সবারই। শিশু সন্তানকে নিয়ে আমরা আর রাস্তায় বের হতে পারছি না বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের কারণে। শিশুদের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে উঠুক আমাদের চারপাশের পরিবেশ।
সাইফুল ইসলাম তানভীর
লেখক