বুলিসর্বস্ব পশ্চিমা বাধা: সিরিয়ায় তুর্কি অভিযান

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:২২ পিএম

৯ অক্টোবর সিরিয়ার উত্তরে বিমান হামলার মাধ্যমে সামরিক অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলছেন, এ অভিযানের উদ্দেশ্য হলো সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে মার্কিন সমর্থিত সিরিয়ার কুর্দিদের সরিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ৩২ কিলোমিটার পর্যন্ত একটি ‘সেইফ জোন’ তৈরি করা- যেখানে তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া ২০ লাখ সিরীয় শরণার্থীর থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। হামলা শুরু হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র উত্তর সিরিয়া থেকে তার সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এর ফলে সেখানকার কুর্দি মিলিশিয়াদের এখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই যুদ্ধ করতে হবে। সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নামে পরিচিত কুর্দিদের এই গ্রুপটাকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দেবার পেছনে যুক্তি ছিল আইএস মোকাবেলা করা। তবে তা তুরস্ক ভালো চোখে দেখেনি। কারণ তুরস্কের ভাষ্য অনুযায়ী, এই গ্রুপটা তুরস্কের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রুপগুলোকে সহায়তা দেয়। এসডিএফ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করেছে উত্তর সিরিয়ার উপর ‘নো-ফ্লাই জোন’ তৈরি করার জন্য, যাতে তুরস্ক সেখানে বিমান হামলা চালাতে না পারে- যে অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্র রাখেনি। 

অনেকেই বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার তুরস্ককে সিরিয়ায় হামলা চালাতে ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছে। তবে পিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অসত্য। তিনি এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত না বললেও তুরস্কের দক্ষিণে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডরে ব্যাপারে তুরস্কের দুশ্চিন্তাটা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তার সরকার তুরস্কের সঙ্গে কাজ করছে যাতে তুরস্কের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা ঠেকানো যায় এবং একইসঙ্গে সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়। তিনি আরও দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর সিরিয়া থেকে তাদের সেনাদের সরিয়ে নিচ্ছে, কারণ সেখানে আইএসের হাত থেকে বেশিরভাগ এলাকা পুনর্দখল করা গেছে। 

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তুরস্ককে সাবধান করে বলেছেন, তুরস্ক যদি কুর্দিদের ধ্বংস করতে চায়, তবে তিনিও তুরস্কের অর্থনীতিকে ধ্বংস করবেন। সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন, তুরস্কের এমনটা করার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা, তখন ট্রাম্প উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, সেটা ঘটার আগেই তিনি তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করবেন। তবে ট্রাম্পের এই কথায় এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তুরস্ক কতটা পর্যন্ত এগুলে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন। সিএনবিসি বলছে, ট্রাম্প এসডিএফকে সমর্থন করার খুব বেশি চেষ্টা করেননি। ট্রাম্প বলেছেন, কুর্দিরা এখন তাদের নিজেদের ভূমির জন্যে লড়াই করছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তো তারা মিত্রবাহিনীকে সহায়তা দেয়নি। তারা যেহেতু তাদের ভূমি পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থেকেছে, তাই সেটা অন্য একটা ইস্যু।

ভূরাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা স্ট্রাটফর তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, এই মিশনের প্রথম কয়েকদিনই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক চাইবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মিশন শেষ করে ফেলতে। তারা পথিমধ্যে কোথাও থামতে চাইবে না; আটকা পড়তে চাইবে না। যত দ্রুত সম্ভব তারা লক্ষ্যবস্তু দখল করে ফেলতে চাইবে। 

তুরস্ক চাইছে উত্তর সিরিয়ার সীমানার ঠিক মাঝ বরাবর হামলা শুরু করে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পাড়ের অংশটাকে পূর্ব-পশ্চিম দুই অংশে ভাগ করে ফেলতে। সীমান্তবর্তী তাল আবাঈদ থেকে রাস আল-আঈন শহর দুটির মাঝামাঝি অঞ্চলেই তুরস্ক তার কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত করেছে। এরপর তারা পূর্ব-পশ্চিমে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এম-৪ হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে সেটার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল হওয়ার কারণে তাদের মিশন ২০১৮ সালের আফরিনের মিশনের চেয়ে সহজতর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তুর্কি সেনাবাহিনীর দ্রুতগামী মেকানাইজড ইউনিটগুলোর সক্ষমতা রয়েছে এসডিএফের ইউনিটগুলো ঘিরে ফেলার। তুর্কিদের ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে মোতায়েন করার মতো এসডিএফের তেমন কিছু নেই। তাই এসডিএফ যদি সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বা রাশিয়ার কাছে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী অস্ত্র চেয়ে থাকে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে এই সহায়তার বিনিময়ে সিরীয় সরকারি বাহিনী এসডিএফের কাছ থেকে দেইর আল-জোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল চেয়ে বসতে পারে। 

অপরদিকে তুরস্কের মিডিয়া আহভাল আভাস দিচ্ছে যে, তুরস্ক চাইছে সিরিয়া সরকার এই মিশনের সময় যাতে তাদের বিপক্ষে না যায়, অথবা এসডিএফকে সহায়তা না করে। মিশন শুরুর একদিন আগেই এরদোয়ান বলেছেন, ‘উত্তর সিরিয়ার আকাশের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিৎ সিরিয়ার হাতে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নয়।’ মিশন শুরুর আগে আগে তুরস্ক এক কূটনৈতিক নোটের মাধ্যমে সিরিয়া সরকারকে মিশন সম্পর্কে অবহিত করে।

এরদোয়ান আরও বলেছেন, ‘ইউরোপীয়রা যদি তুরস্কের সিরিয়া মিশন পছন্দ না করে, তাহলে তুরস্ক ৩৬ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে ইউরোপের দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।’ সিএনবিসি বলছে, ইউরোপীয় কূটনীতিকরা সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক মিশনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, তুরস্কের এই মিশন সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করবে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাসেলসে ১৭-১৮ অক্টোবরের বৈঠকে ইইউ নেতারা তুরস্কের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ না করে বলেছেন, তিনি এরদোয়ানকে আলোচনার জন্যে আহ্বান জনিয়েছেন। ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, তারা তুরস্ককে ইউরোপের বিরুদ্ধে শরণার্থীদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেবেন না। 

তবে এটা পরিষ্কার যে, সিরিয়ায় কালক্ষেপণে এরদোয়ান ইউরোপের শরণার্থী-ভীতিকেই কাজে লাগাতে চাইছেন। সিরীয় শরণার্থীদের চাপে ইউরোপে ডানপন্থী শক্তির উত্থান দেখতে চান না তারা। নিশ্চিতভাবেই, পশ্চিমা বিশ্ব এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্ন্দদ্বীদের চাপ থেকে উদ্ধার পেতে তুরস্ক চাইবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিরিয়া অভিযান শেষ করতে। আর শরণার্থী-ভীতিতে ইইউ বড় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh