ভিসি কেন যুবলীগের দায়িত্ব চান?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:১৬ পিএম | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:০৭ এএম

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান যুবলীগের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। যে কোনো নাগরিকের যে কোনো বিষয়ে আগ্রহ দেখানোর অধিকার আছে। আমিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগ্রহ দেখাতে পারি। তাতে মানুষ আমাকে পাগল বলবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও আগ্রহ দেখাতে পারি। তাতে কিছু লোক উন্মাদ ভাববে। কিছু লোক রাজনীতিতে নামতে বলবে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের ভাবনার সঙ্গে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ভাবনায় মৌলিক কিছু তফাৎ থাকবে এবং মানুষ সেটিই প্রত্যাশা করে। ড. মীজানুর রহমান যুবলীগের মতো একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান হওয়ার বাসনা বা আগ্রহ প্রকাশ করলেন, যে সংগঠনের নেতারা ক্যাসিনোবিরোধী সাম্প্রতিক অভিযানে বিতর্কিত হয়েছেন এবং অতীতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের যে সংগঠনটির খুব একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি জনমানসে গড়ে ওঠেনি। সুতরাং একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এরকম একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান হতে চাইলে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ ঠাট্টা-মশকরা বা সমালোচনা করবে এবং তার এই বক্তব্যে বিস্মিত ও হতাশ হবে, তাতে আর সন্দেহ কী!

যদিও যুবলীগের দায়িত্ব পেলে উপাচার্য পদ ছেড়ে দেবেন- এমন ঘোষণা দিয়েছেন বলেই ড. মীজানুর রহমানকে যুবলীগের চেয়ারম্যান বানিয়ে দেওয়া হবে, বিষয়টি এমন নয়। আবার তিনি এই পদের জন্য অযোগ্যও নন। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই তিনি যুবলীগের সঙ্গে যুক্ত। এতদিন যারা জানতেন না, তারাও এখন বিষয়টি জেনেছেন যে, ড. মীজানুর রহমান ২০০৩ সাল থেকে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার এবং ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক যখন পলাতক, তখন মিজানুর রহমান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও ছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টি নতুন নয়। তিনি মূলত যুবলীগ নেতা। শিক্ষক অথবা উপাচার্য তার দ্বিতীয় পরিচয়। ধারণা করা অমূলক নয় যে, তিনি জগন্নাথের ভিসি হয়েছেন এই যুবলীগ কোটায়। ফলে এখন যদি তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান হতে চান বা আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। 

কিন্তু তারপরও মানুষ বিস্মিত হয়েছে। যতটা না বিস্মিত তার চেয়ে বেশি হতাশ। কারণ একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চয়ই যুবলীগের চেয়ারম্যানের চেয়ে ঢের বেশি। একজন ভিসিকে মানুষ দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সম্মান করে। ভোটার হিসেবে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি তার সমর্থন থাকাটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ একজন উপাচার্যের কাছ থেকে দলনিরেপক্ষতা আশা করে। তিনি কোন প্রতীকে ভোট দেন, সেটি তার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু তিনি যখন কথা বলেন মানুষ প্রত্যাশা করে সেখানে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা থাকবে। কিন্তু তিনি যখন কোনো একটি রাজনৈতিক দলের বা সংগঠনের শীর্ষ পদে আসীন থাকেন, তখন তিনি যত ভালো কথা বা যত যুক্তিপূর্ণ কথাই বলুন না কেন, মানুষ তাতে ভরসা রাখতে চায় না বা বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ মানুষ জানে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট। ড. মীজানুর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার মূল কারণ এটিই।

অনেকে বলার চেষ্টা করছেন- যেহেতু সমাজের নানা স্তরের মানুষকে নিয়েই রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, সুতরাং সেখানে কেন শিক্ষকরা থাকবেন না? ছাত্ররা যদি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে শিক্ষকরা যুবরাজনীতিতে যুক্ত হতে পারবেন না কেন? আবার যে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক, তারাও তো রাজনীতি করছেন, বিভিন্ন দলের পদে আছেন, এমপিও হচ্ছেন- তাহলে শিক্ষকদের বাধা কোথায়? নিশ্চয়ই এ কথার যুক্তি আছে। কিন্তু এখানে বিষয়টা পারসেপশন বা ধারণা এবং বাস্তবতা। অর্থাৎ আর দশটি পেশার সঙ্গে শিক্ষকতা গুলিয়ে ফেলা যেমন ঠিক নয়, তেমনি শিক্ষকরা রাজনীতিতে যুক্ত হলে যে উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে সর্বস্তরে নির্লজ্জ দলীয়করণ তৈরি হয় এবং তার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত হয়, সেটি এরইমধ্যে প্রমাণিত। যে কারণে এখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারাও বলছেন, ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করা উচিত।

কেউ যদি সত্যি সত্যিই প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে চান, তাহলে আগে তার শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়া উচিত। তাছাড়া একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন কোনো একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধানের পদে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেন, তাতে শুধু উপাচার্য পদই নয়, বরং সমগ্র শিক্ষক সমাজকেই অসম্মানিত করা হয় বলে মনে হয়। তার চেয়ে বড় কথা, একজন শিক্ষক বা ধরা যাক ড. মীজানুর রহমান, তার ওপরে অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছেন কি না। অর্থাৎ নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি কি সত্যিকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন? যদি না পারেন, তাহলে তাকে যুবলীগের দায়িত্ব দিলে ওখানেও ব্যর্থ হবেন- এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। 

প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেখ করা অনুচিত হবে না যে, ড. মীজানুর রহমান ২০১৬ সালে ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং বিষয়টি নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। তখন তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিস্কার করে বলে দিয়েছিলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটাই তাদের বিশেষ যোগ্যতা।’

যদিও এই দফায় যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার আগ্রহের বিষয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমে একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন! তিনি বলেছেন, টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনোসহ নানা দুর্নীতিতে যুবলীগের এক শতাংশ জড়িত। বাকি যে লাখ লাখ নেতাকর্মী আছেন, যারা করার মতো কোনো কাজই পাননি, তাদের সহযোগিতায় দেশ গড়ার দায়িত্ব পেলে তিনি সেই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। 

ব্যাখ্যা তিনি যা-ই দিন না কেন, ঘুরেফিরে অর্থ একই দাঁড়ায় যে, তিনি একইসঙ্গে যুবলীগ নেতা ও ভিসি। সে কারণেই প্রশ্ন উঠছে, একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কী করে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হন? আইনত বাধা না থাকলেও প্রশ্নটা নীতির। প্রশ্নটা আদর্শের। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠনের শীর্ষ পদে থাকেন, সেখানে যুক্তি যতই থাকুক, সাধারণ মানুষ এটিকে ভালো চোখে দেখে না। দেখে না বলেই ড. মীজানের ইস্যুটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। যারা এ বিষয়ে মন্তব্য করছেন, তার বড় অংশই সমালোচনা। অর্থাৎ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধানের পদ পেলে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন- এরকম বক্তব্য দেশের মানুষ আশা করে না। তাতে মি. রহমান যে ব্যাখাই দিন না কেন!

তাছাড়া নানা কারণে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন যে বড় সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি এবং ক্যাম্পাসে দলীয় দাসত্ব ইস্যুতে যেসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেসব সংকট সমাধানে কী করা যায় এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজে করতে পারেন, ড. মীজান যদি সে বিষয়ে কথা বলতেন, দেশের মানুষ বরং তাতে খুশি হতো। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। তাছাড়া দেশের ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনগুলো কীভাবে চলে, তাদের মূল কাজ কী, মূল দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের কী কী করতে হয় এবং দলের সাইনবোর্ড ভাঙিয়ে নেতারা কী পরিমাণ লুটপাট করেন, সেটি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। এরকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মীজানুর রহমানকে যদি যুবলীগ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়াও হয়, তারপরও তিনি এই খাতে খুব বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন বলে মনে হয় না। তবে বিষয়টা যদি এমন হয় যে, শিক্ষকতা করে তার পোষাচ্ছে না বা তিনি কাজটা এনজয় করছেন না; অথবা তিনি যা চাচ্ছেন তা শিক্ষকতা বা উপাচার্যগিরি করে পাচ্ছেন না কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলেও তার মন পড়ে থাকে রাজনীতিতে, তাহলে শিক্ষকতা থেকে সরিয়ে তাকে রাজনীতিটাই করতে দেওয়া উচিত।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh