বিসিকের শিল্প প্লট
হারুন-অর-রশিদ
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৫:২৬ পিএম
সারাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এ জন্য বিভিন্ন জেলায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দেয় সরকারি এ সংস্থা। কিন্তু প্লট বরাদ্দের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রকৃত উদ্যোক্তারা প্লট বরাদ্দ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্লট নিয়ে কারখানা করার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতাহীন প্লট বরাদ্দ প্রাপ্তরা শেষ পর্যন্ত কারখানা চালু করতে পারেননি। তারা ব্যাংকের টাকাও ফেরত দেননি। একদিকে বিসিকের প্লট শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে- অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণও খেলাপি হয়ে গেছে। অথচ অনেক প্রকৃত উদ্যোক্তা চেয়েও বরাদ্দ পাননি বিসিকের প্লট।
সূত্র জানায়, বন্ধ শিল্প-কারখানার দখলে থাকায় চাহিদামতো বিসিকের প্লট পাচ্ছেন না নতুন উদ্যোক্তারা। ঋণখেলাপি হয়ে অধিকাংশ প্লটই বন্ধ কারখানার দখলে। এ ছাড়া জ্বালানি সংযোগ, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় অনেক নগরীর শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার ৪৯২টি প্লটে এখন পর্যন্ত উৎপাদন হয়নি।
বিসিক দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে নিয়োজিত সরকারি খাতের প্রধান প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৭ সালে সংসদীয় আইনের মাধ্যমে বিসিকের জন্ম। এর মূল লক্ষ্য উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে সারাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠা করা। উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং ব্যাপকহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
বিসিকের তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠানটির মোট প্লটের সংখ্যা ৯ হাজার ৯২২টি, যার মধ্যে অনেকগুলো প্লট এখনো হস্তান্তরের উপযোগী নয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ১১৯টিতে বিভিন্ন কারখানা পণ্য উৎপাদন করছে। আর ৯০০টি প্লটে প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো নির্মাণ ও অফিস নিয়ে আছে। আর বরাদ্দের অপেক্ষায় আছে ৪১১টি প্লট। কিন্তু রুগ্ণ ও বাতিল রয়েছে ২৯৯টি প্লট।
বিসিকের প্লটের মাধ্যমে অনেকেই ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে তা খেলাপি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যার ফলে ব্যাংক প্লটে অবস্থিত কারখানা ও যন্ত্রপাতি নিলামে তুললেও তা কেউ ক্রয় না করায় প্লটগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে। সিলেট নগরীর গোটাটিকরের বিসিক-১ সূত্রে জানা যায়, ইআর এন্টারপ্রাইজের দখলে ৪টি প্লট, আল-ফাত্তাহ অয়েল মিলের দখলে ৩টি, প্রিমিয়ার ডাইং অ্যান্ড ক্যালেন্ডারিংয়ের ৪টি প্লট, মেসার্স বেগম প্যাকেজিং, সুরমা ইন্ডাস্ট্রিজ, কুশিয়ারা উইভিং ফিশনেট, মনসুর নিটিং অ্যান্ড হোশিয়ারি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, এনকেএফ টেক্সটাইল, কুশিয়ারা টেক্সটাইল ইন্ডান্ট্রিজ ১টি করে প্লট দখল করে আছে। এই ১৭টি প্লটের সব কারখানাই প্রায় এক যুগ ধরে বন্ধ করে প্লট দখল করে আছে। ব্যাংকঋণ শোধ করতে না পেরে অনেক ফ্যাক্টরি মালিকই লাপাত্তা।
একাধিক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিসিকের অনেক প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা। তাদের মধ্যে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, ইচ্ছাও নেই। তারাও প্লট বরাদ্দ নিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন। এরপর থেকেই লাপাত্তা। মূলত অর্থ আত্মসাতের জন্যই অসাধু প্রভাবশালী চক্র বিসিকের শিল্পপ্লট বরাদ্দ নিয়েছে।
গোটাটিকরের বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা শেখ ফজলুল হক বলেন, ‘বন্ধ হওয়া নয়টি শিল্প-কারখানার মধ্যে পাঁচটির ব্যাংকঋণ অনাদায়ী থাকায় এগুলোর দখলে থাকা প্লটগুলো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিলামে না তুললে আমাদের কিছু করার নেই। তবে আমরা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছি।’
সিলেট বিভাগে পাঁচটি অঞ্চলে বিসিকের শিল্পাঞ্চল অবস্থিত। এতে মোট প্লটের সংখ্যা ৪৩২টি। এর মধ্যে ডেভেলপ করা রয়েছে সবকটি। তবে বরাদ্দ করার মতো প্লট রয়েছে ৪২৮টি। আর বরাদ্দকৃত প্লটের সংখ্যা ৪২০। এর মধ্যে ২৪টি সম্প্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উৎপাদনকৃত কারখানা রয়েছে ২২টি প্লটে। কারখানা নির্মাণ অবস্থায় আছে ২৭টি প্লটে। অফিস রয়েছে ১১টি প্লটে। রুগ্ণ প্লট রয়েছে ১৭টি।
ময়মনসিংহ বিসিক শিল্পনগরীর সুপার ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানা করেও দীর্ঘদিন তা বন্ধ রেখেছে। শুধু সুপার ক্যাবল নয়, এ রকম ডজনখানেক কোম্পানি কোনো কার্যক্রমই শুরু করেনি। বছরের পর বছর পড়ে আছে এসব প্লট। অথচ নতুন উদ্যোক্তারা প্লটের আবেদন করেও পাচ্ছেন না। ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি অঞ্চলে বিসিকের শিল্পাঞ্চল অবস্থিত। এতে মোট প্লটের সংখ্যা ৩ হাজার ৯৩৬। আর এর মধ্যে ডেভেলপ করা রয়েছে ৩ হাজার ৭৮৪টি। বরাদ্দ করার মতো প্লট রয়েছে ৩ হাজার ৮৭৮টি। বরাদ্দকৃত প্লটের সংখ্যা ৩ হাজার ৮১২টি। এর মধ্যে ২৪৪টি সম্প্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দের জন্য প্রস্তুত প্লটের সংখ্যা ৬২। উৎপাদনকৃত কারখানা রয়েছে ২ হাজার ৭৯টি প্লটে। কারখানা নির্মাণ অবস্থায় আছে ২৯২ প্লটে। রুগ্ণ বা ব্যবহারের অযোগ্য প্লট রয়েছে ৯১টি। অফিস রয়েছে ৪৪টি প্লটে।
বন্ধ ও ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিসিকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, বন্ধ কারখানাগুলোকে নিয়মিত চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিসিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। শিগগিরই তারা প্লট অন্য মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেবে। তবে মানবিক কারণে বিসিক শুরুতেই প্লট বাতিলের উদ্যোগ নেয় না। কারণ, বাতিল করলে তো যে টাকা দিয়ে প্লট কেনা হয়েছিল, সেটি পাওয়া যাবে না। তাই প্রতিনিয়ত বিক্রি করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।