অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৫৯ পিএম | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৩৭ এএম

যথেচ্ছ ব্যবহারে জীবাণুর বিরুদ্ধে উপকারী অ্যান্টিবায়োটিক আর আগের মতো কাজ করছে না। নামি-দামি অ্যান্টিবায়োটিকের কর্মক্ষমতা কমে ৫০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে।

যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে রোগ সারিয়ে তুলতে আর নতুন কোনো ওষুধ পাওয়া যাবে না। ফলে অকাতরে প্রাণ হারাবে মানুষ। স্বজন আর চিকিৎসকদের চোখের সামনেই মারা যাবে, কিন্তু কিছুই করার থাকবে না! জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যথেচ্ছ ব্যবহার না করার জন্য ইতোমধ্যে চিকিৎসকরা সাবধানবাণী দিয়েছেন।

তারা বলছেন, নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে ব্যবহারের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ ব্যবহার না করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার অথবা অপ্রয়োজনে ব্যবহারের কারণে সামনের দিনগুলোতে কী বিপদ নেমে আসতে পারে মানব সভ্যতার জন্য, এ বিষয়ক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে গবেষকরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষ মারা যাবে নতুন ধরনের কোনো অ্যান্টিবায়োটিক না থাকায়। কারণ বিরাজমান অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে আবার কিছু অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে কেবল ক্যান্সারেই মারা যাবে ৮২ লাখ মানুষ। কলেরায় মারা যাবে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার, ডায়াবেটিসে মারা যাবে ১৫ লাখ, ডায়রিয়ায় মারা যাবে এক লাখ ৪০ হাজার, হামে ভোগে মারা যাবে এক লাখ ৩০ হাজার এবং টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে ৬০ হাজার মানুষ।

দিন যত যাচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিকও শেষ হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এই ১০ বছরে ৪২টি অ্যান্টিবায়োটিক আসলেও, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মাত্র এসেছে ২১টি। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এসেছে মাত্র ছয়টি এবং ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৯টি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এসেছে।

কেন অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক রোগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারলে এমনটা হয়ে থাকে। আবার চিকিৎসকদের নির্দেশিত পরিমাণের কম ব্যবহার করলে অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে যায়। যেমন কোনো একটি জীবাণুর বিরুদ্ধে ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট ব্যবহার করার নির্দেশনা থাকলেও যদি কেউ পাঁচটি ব্যবহার করে তাহলে দেহের মধ্যে থাকা জীবাণু বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া কিছু সময়ের জন্য দুর্বল হয়ে পড়বে, কিন্তু এর বিনাশ হবে না। ব্যাকটেরিয়া নিজের মধ্যে ওই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ফলে ভবিষ্যতে ওই একই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। এভাবেই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগ তত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালর মধ্যে রক্ত, মনুষ্য মল ও প্রস্রাবের ১৪ হাজার ৬৬৯টি নমুনা পরীক্ষা করে অ্যান্টি মাইক্রোবায়াল সারভেইলেন্সের ফলাফল তুলে ধরে গত ২৪ নভেম্বর। আইইডিসিআর স্যাম্পল পরীক্ষা করে দেখেছে, ১০টি পরিচিত জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা (রেজিস্ট্যান্ট) গড়ে উঠেছে। ফলাফলে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী পাওয়া গেছে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে। এই বিভাগে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে জীবাণু ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। অপরদিকে হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ১১ শতাংশ এবং আইসিইউ বিভাগে ১১ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধী হয়ে গেছে জীবাণু। অন্যান্য বিভাগে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়েছে ১২ শতাংশ। 

১০ ধরনের জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে বয়স ভেদে বিভিন্ন রকম প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যেমন পুরুষের বিরুদ্ধে ৪৭ শতাংশ এবং নারীর বিরুদ্ধে ৫৩ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে গেছে। সবচেয়ে প্রতিরোধী হয়েছে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের বিরুদ্ধে, ২২ শতাংশ। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৩ শতাংশ প্রতিরোধী হয়েছে। ০ থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে ১১ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে। ১৬ শতাংশ প্রতিরোধী হয়েছে ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের বিরুদ্ধে। 

আবার অস্ত্রোপচার করতে এসে রোগীরা ভয়ংকর রকমের ইনফেকশনের (সার্জিক্যাল সাইট ইনফেকশন-এসএসআই) শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালে অবস্থানকালে অথবা অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকা জীবাণু রোগীকে কাবু করে ফেলছে। সাধারণত ওষুধে যেসব রোগ ভালো হয় না, সেগুলো সারিয়ে তুলতে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের সুপারিশ করেন। কিন্তু অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকা জীবাণুর সংক্রমণে রোগী দ্রুত সুস্থ না হয়ে হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি অবস্থান করতে হয় এবং রোগী বাড়তি অর্থ খরচে বাধ্য হন। এমনকি হাসপাতাল অথবা অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকেই যে নতুন কিছু জীবাণু দ্বারা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, তা রোগীকে জানানোও হয় না।

এম নুর-ই-এলাহীর সঙ্গে আরো ৯ জন চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগসমূহের ৪৯৬ জন রোগীর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেন যে, এর মধ্যে ২০ শতাংশ রোগী অস্ত্রোপচারজনিত সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। যে ২০ শতাংশ সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, তাদের ৪৩ শতাংশ ই-কোলাই, ৩৩ শতাংশ স্টেফাইলোকোক্কাস অরিয়াস, ১১ শতাংশ স্যুডোমোনাস এরোজিনোসার মতো জীবাণু। এ গবেষণাটি জার্নাল অব দ্য বাংলাদেশ সোসাইটি অব এনাসথেশিওলজিস্টে প্রকাশিত হয়েছে। 

কেন সার্জিক্যাল সাইট ইনফেকশন হয়ে থাকে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের সাবেক ডিন ও শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্রোপচার করতে এসে নানা কারণে রোগীরা নতুন করে জীবাণু সংক্রমণের শিকার হয়ে থাকেন। কিছু জীবাণু অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকেই রোগীরা পেয়ে থাকেন। অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে প্রাপ্ত সংক্রমণের পরিমাণ খুব বেশি নয়। তবে বেশি জীবাণু সংক্রমণ হয়ে থাকে অন্য কারণে। এগুলোর অন্যতম হলো রোগী দেখে চিকিৎসকেরা ‘হ্যান্ড ওয়াশ’ করেন না, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারটিতে নজর দেন না। এটা করতে গেলে কিছু অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়, তা নেই হাসপাতালগুলোতে। এর সঙ্গে বাড়তি খরচের প্রশ্ন আছে। এ ছাড়া অস্ত্রোপচারের রোগী হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভর্তি থাকলেও রোগীর দেহে হাসপাতাল থেকে কিছু জীবাণু প্রবেশ করে। এসব জীবাণুর অনেকগুলো ওষুধ প্রতিরোধী (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) ধরনের হয়ে থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকারি কিংবা বেসরকারি বেশিরভাগ হাসপাতালেই মানসম্মত জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা (স্ট্যান্ডার্ড ইনফেকশন কনট্রোল ম্যানেজমেন্ট) নেই। খরচ বাড়ার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারটিতে দৃষ্টি দেন না।’ 

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সার্জিক্যাল সাইট ইনফেকশন বিশ্বব্যাপী একটা স্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং দিন দিন এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোস্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত ‘প্রিভেলেন্স সার্জারি সাইট ইনফেকশন ইন টার্শিয়ারি হসপিটাল ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় হুমায়ুন কবির শিকদার জানান, বিশ্বে প্রতি বছর ২৩ কোটি ৪০ লাখ অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। এর মধ্যে ২.৫ থেকে ৪১.৯ শতাংশ অস্ত্রোপচারের রোগী জীবাণু সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

তিনি তার গবেষণায় আরো দেখান, নাইজেরিয়াতে এসএসআই ৪১.৫ শতাংশ, সৌদি আরবে ২.৫৫ শতাংশ, ভারতে জেনারেল অ্যান্ড অর্থোপেডিক অস্ত্রোপচারে সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন ২০ শতাংশ। 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারের তালিকায় উঠতে একজন রোগীকে গড়ে ৩০ দিন হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রোগীদের হাসপাতালে অবস্থান কমিয়ে আনতে পারলে এবং অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন যথাযথ অনুসরণ করতে পারলে সংক্রমণের পরিমাণ কমানো যেতে পারে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগীদের মধ্যে যেসব রোগী অস্ত্রোপচারজনিত সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, তারা ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলেও সেফট্রিয়াক্সন নামক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

আইইডিসিআরের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত সাইভেইলেন্স রিপোর্ট বলছে, এখন সেফট্রিয়াক্সনও ৫০ পর্যন্ত জীবাণুর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে গেছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh