আগামী দিনে সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা

জাকির তালুকদার

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১০:১৬ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১০:১৭ এএম

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।

একথা বুঝে উঠতে উঠতেই আমাদের সময় লেগে গেছে প্রায় দুইশ’ বছর যে, আমরা যেসব কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস লিখছি এবং পড়ছি সেগুলোর অবয়ব আমাদের নিজস্ব নয়। 

বাংলা লিপি উদ্ভাবনের পরে আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই লিপি দিয়ে শুধু প্রয়োজনীয় কাজের কথাই লিপিবদ্ধ করেননি। তাদের মধ্যে যারা শিল্পী ছিলেন, তারা এটাও বুঝে নিয়েছিলেন যে ‘প্রয়োজনেরও অতিক্রান্ত যে প্রয়োজন’, যাকে আমরা নান্দনিকতা বলি, সেই নান্দনিকতার বাহন হিসেবেও এই নব আবিষ্কৃত লিপি নামক সংকেতগুলোকেও ব্যবহার করা সম্ভব। তারা সেগুলোকে সেই নান্দনিক কর্মে ব্যবহারও করেছিলেন।

প্রথমে সম্ভবত শ্রুতিসাহিত্যকে লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু হয়েছিল। মুখে মুখে প্রচারিত গল্পকথা, উপকথা, কাব্য, কিংবদন্তি, ধর্মীয় আখ্যান এবার এলো লিখিত অবয়ব নিয়ে। কোনো কৌমের হয়তো একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধারণ এবং বহন করতেন সেই আখ্যান- এতদিন আশঙ্কা ছিল উপযুক্ত ছাত্রের কাছে সেই গাথা হস্তান্তরিত করতে পারবে না। তার আগেই হয়তো তিনি নিজের বুকে ধারণ করা আখ্যান বা কাব্য নিয়েই লোকান্তরিত হবেন। হয়তো বা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে কৌমের প্রধান সম্পদ সেই গাথাটিও।

এবার মুক্ত হলো সেই আশঙ্কাটি। উপযুক্ত শিষ্য তৈরির পাশাপাশি লিখিত সংকেতে ধরা রইল সেই অমূল্য সম্পদ। ধরা রইল এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে শুরু করল। কেননা আখ্যান বর্ণনাকারী মূল আখ্যানের সঙ্গে জুড়ে দিতে শুরু করলেন নিজের তৈরি কিছু উপ-আখ্যানও। মূল সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করল নিজস্ব সৃষ্টিশীলতাও।

তারপরে একসময়, যারা এই উপসৃষ্টিতেই নিজেদের সীমিত রাখতে অনিচ্ছুক, তারা নিমগ্ন হলেন নিজস্ব সৃষ্টিকর্মে। প্রথম দিকে হয়তো এই সৃষ্টিকর্ম একেবারে মৌলিক ছিল না, ছিল হয়তো প্রচলিত আখ্যান-গাথারই অনুরূপ আরেকটি আখ্যান। কিন্তু সেটাও তো সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তিরই পরিচয়।

তারপরে হয়তো অনেক পরে এলেন সেইসব শিল্পী, যাদের আখ্যান, যাদের কাব্য অন্যদের থেকে একেবারেই পৃথক। সেগুলো একেবারেই মৌলিক সৃষ্টি। আর মৌলিক সৃষ্টি, সব সময় না হলেও, অনেক সময়ই জন্ম দেয় মৌলিক অবয়বও। এভাবেই একে একে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষায় কাব্য, কাহিনিকাব্য, আখ্যান, কথকতা, ভাসানযাত্রা, মুখাযাত্রা, ব্রতকথা এবং পাঁচালির মতো বাঙালির নিজস্ব সাহিত্য-অবয়ব।

কৈবর্ত শাসনের ৩৭ বৎসর বাদ দিলে ১৯৭১ সালের আগে আজকের বাঙালি এবং বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন ছিল না। নিজেদের ভাষার কোনো শাসনকর্তা ছিল না বাঙালির। কখনো সংস্কৃত, কখনো ফারসি, কখনো তুর্কী, কখনো ইংরেজি ছিল রাজভাষা। ফলে রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা সেই অর্থে পায়নি বাংলাভাষা। হোসেনশাহী আমলে গৌড়ে এবং আরাকান রাজসভায় কিছু সময় বাংলাভাষার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার তথ্য জানা গেছে।

কিন্তু সেগুলো ছিল মূলত অন্য ভাষা থেকে মহাকাব্য ও বিখ্যাত কাব্যগুলোকে বাংলায় রূপান্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বড়জোর তা ছিল ক্ষমতাসীন শাসকের গুণকীর্তনমূলক প্রশস্তিকাব্য। সত্যিকারের সৃজনশীল বাংলাসাহিত্য কখনোই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। সেগুলো গড়ে উঠেছিল রাজসভার বাইরে গৌড়, পুন্ড্র, বরেন্দ্র, সমতটের জনপদগুলোতে। এর ফলাফল হিসেবে ভালো কিছু সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়।

যেহেতু এগুলো ছিল একেবারেই মাটিলগ্ন মানুষের সৃষ্টি, তাই সেই শিল্পরূপগুলোতে বাংলার সোঁদামাটির গন্ধ বরাবরই প্রধান উপাদান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। চর্যাপদ তার প্রমাণ। ব্রিটিশ আমলে ছেদ পড়ে গেছে সেই ধারাটির। ব্রিটিশ আমলেই। কারণ এর আগে বাংলায় অসংখ্য আগ্রাসী জাতি এসেছে, তারা কেউ ব্রিটিশের সমকক্ষ ছিল না আগ্রাসন-দক্ষতায়।

বাঙালির জীবনের সর্বস্তরে হস্তক্ষেপের মতো দক্ষতা ও শক্তিমানতা তাদের ছিল না। কিন্তু ইংরেজদের ছিল। সেই সঙ্গে ছিল তীব্র সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধা। ছিল এটুকু বোধ যে, শুধু রাষ্ট্রীয় শাসন দিয়ে উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন মনোজগতে এবং সাংস্কৃতিক জগতে উপনিবেশ স্থাপন করা। তাদের শুধু উন্নত অস্ত্রশস্ত্রই ছিল না। ছিল আলোকায়নের নামে উপনিবেশ বিস্তারের যৌক্তিকতার অস্ত্রটিও। যা তাদের দার্শনিক ভিত্তি দিয়েছিল। অর্থাৎ তাদের হাতে ছিল এমন সব হাতিয়ার যা ইতিপূর্বে এদেশের মানুষের কাছে একেবারেই অভূতপূর্ব এবং অচিন্ত্যনীয় বিষয় ছিল।

এইসব হাতিয়ার এবং সেইসঙ্গে প্রয়োগকুশল জনশক্তি ছিল বলেই ইংরেজরা ভেঙে দিতে পেরেছিল বাঙালির সব নিজস্ব সংগঠন। বাঙালিকে অভ্যস্ত করে তুলতে পেরেছিল ইংরেজদের অনুসরণে চলতে, বলতে, লিখতে এবং ভাবতেও। সেইভাবে ভাবতে ও লিখতে শিখলেন রামমোহন-বঙ্কিমচন্দ্ররা। তাদের সবার সামনে ইংরেজ আদর্শ। এমনকি যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন স্যার ওয়াল্টার স্কটের চাইতে অনেক বড় মাপের লেখক, তাকে ‘বাংলার ওয়াল্টার স্কট’ অভিধা দিয়ে শ্লাঘাবোধ করত এদেশের মানুষ।

বঙ্কিমও যে আত্মশ্লাঘা বোধ করেননি, এমন প্রমাণ নেই। মধুসূদন এসেছেন। তাকে আবার বানানো হলো ‘বাংলার মিল্টন’ উপাধিতে। এইভাবে বাংলা সাহিত্য নিজের অজান্তেই পুরোপুরি গ্রহণ করে ফেলল ইউরোপীয় অবয়ব।

আর আমরা যে অন্যের জামাটিকেই নিজের জামা ভেবে পরে বেড়াচ্ছি সেই সত্যটি বুঝে উঠতে আমাদের লেগে গেছে প্রায় দুইশটি বৎসর। এখন বুঝতে পারার পরে করণীয় ঠিক করতে যে আরও কত বছর লাগবে তা আমরা জানি না। কেননা ব্যাপারটি যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতার মতো চোখে দেখার ব্যাপার হতো, তাহলে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসকদের এদেশ থেকে বিদায় করার মতো করে গল্প-কবিতার ইংরেজি আঙ্গিকটিকে বিদায় করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত।

কিন্তু এই ব্যাপারটি অত সরল নয়। তার কারণ শুধু এই নয় যে, এই আঙ্গিক অবলম্বন করে রচিত বাংলা সাহিত্য বিশ্বজুড়ে আমাদের স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য অমর কবিতা-গল্প-নাটক-গান রয়েছে এই আঙ্গিকে। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দসহ ত্রিশের প্রধান কবিবৃন্দ রচনা করেন মহৎ সব কাব্য।

আরো সব কবিরা রচনা করে চলেছেন অসংখ্য উন্নতমানের কবিতা। এই আঙ্গিকেই গল্প-উপন্যাস লিখে বাংলা কথাসাহিত্যিকে উচ্চতার শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে গেছেন মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি-সতীনাথ। রম্যরচনায় বিশ্বমানকে অতিক্রম করে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো লেখক। শিশুসাহিত্যে অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এগুলো এখন শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বের সাহিত্যভা-ারেরই অমূল্য সম্পদ। 

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ব্রতকথার বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিজের সাহিত্য সৃষ্টির অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছেই নিয়েছিলেন। চিত্রশিল্পে তিনি যে ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট’ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তার পটভূমিতে ছিল এই দেশীয় আঙ্গিকের সন্ধানলাভের সৌভাগ্যে।

জীবনানন্দ দাশ বাংলার সব দেশজ শব্দকে তো তার সাহিত্য কর্মে প্রয়োগ করলেন, একই সঙ্গে আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও ইংরেজি সনেটের অবয়বকে পাশ কাটিয়ে আশ্রয় নিলেন মহাপয়ারের। তবে একই সঙ্গে এই দেশজ উপলব্ধি আবার অন্য একটি বিপদ ডেকে এনেছিল। তা জন্ম দিচ্ছিল স্বাজাত্যাভিমানী উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জাতীয় সাহিত্য শিরোনামের বক্তৃতাগুলোতে তার লক্ষণ পরিস্ফুটিত হলে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে আমাদের এই বাংলাদেশ ভূখন্ডে যারা সাহিত্যের প্রধান পুরোধা হিসাবে আবির্ভূত হলেন, তাদের অধিকাংশেরই ছিল ইউরোপীয় আঙ্গিকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। এরাই ছিলেন মূলধারার লেখক। ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন বা সৈয়দ আলী আহসানরা পাকিস্তানি সাহিত্য সৃষ্টির নামে আরব-ইরান-তুরানের ভাবজগতটিকে বাংলাভাষায় রূপায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন মূলধারার বাইরে গিয়ে। সঙ্গত কারণেই সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের সাহিত্য পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আরও বেশি পশ্চিমমুখী হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল এই ধারায় উৎকর্ষ অর্জন করাই হবে কবি-সাহিত্যিকদের চরম লক্ষ্য। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ এখানে ঘটে গেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো যুগান্তকারী ঘটনা। একটি জাতি মুক্তিযুদ্ধের পরে আর কোনোক্রমেই হুবহু আগের মতো থাকতে পারে না। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সাহিত্যও তাই আগের মতো থাকেনি। আগের মতো করে পথ চলতে চায়নি। বেশিরভাগ নতুন পথসন্ধান অবশ্য কানাগলিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু তাতে করে অভিযাত্রার প্রবণতা থেমে যায়নি। নতুন করে আবার পথসন্ধানের পালা শুরু হয়েছে।

আগামী দিনের বাংলা সাহিত্য যে পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে তার লক্ষণ এখনই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কবিতার, গল্পের, উপন্যাসের, নাটকের বর্তমান আঙ্গিক এবং অবয়ব যে চিরস্থায়ী নয়, তার অঘোষিত ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। বাঙালির আবহমান চিন্তা-আকাক্সক্ষা-কল্পনা-স্বপ্ন-বাস্তবতা যে পুরাতন আঙ্গিকে পুরোপুরি সার্থকতার সঙ্গে রূপায়িত করা যে সম্ভব হবে না, তা বুঝে গেছেন বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা। সেই কারণেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসে দেশীয় আঙ্গিক নতুন করে ফিরে আসার দাবি জানায়।

শওকত আলী ডুব দেন প্রদোষ বাংলার সন্ধানে। এই যুগপৎ আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ী পথই বাংলা সাহিত্যকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়। আর একমাত্র তখনই, সেই রূপায়ন পূর্ণমাত্রায় শস্যায়িত হয়ে উঠলেই, সেই সাহিত্য হয়ে উঠবে সত্যিকারের বাঙালি-রচিত সত্যিকারের বাংলা সাহিত্য। বাংলাভাষায় বাংলাদেশের সাহিত্য। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh