আমি নিজেকে বিশ্বজনীন লেখক বলেই মনে করি: ওলগা তোকারচুক

থিওডোরা ড্যানেক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২০, ০২:০৪ পিএম | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০, ০২:০৬ পিএম

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখক ওলগা তুকারচুক।

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখক ওলগা তুকারচুক।

ওলগা তোকারচুকের প্রথম পরিচয়-তিনি বর্তমান সময়ের বহুমাত্রিক ও ক্ষুরধার লেখকদের মধ্যে অন্যতম। তার নিবাস মধ্য-ইউরোপীয় দেশ পোল্যান্ড। তাঁর লেখা উপন্যাস ‘ফ্লাইটস’ সম্মানসূচক ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার ২০১৮’ লাভ করে এবং এ বছরেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পান তিনি।

পুরস্কারজয়ী উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন জেনিফার ক্রফট। একজন মধ্য-ইউরোপীয় লেখক হিসেবে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পোল্যান্ডের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং সর্বশেষ বইটি লিখতে গিয়ে তিনি যেসব বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন- সেগুলোই ছিল আমাদের আলাপচারিতার মূল বিষয়বস্তু।

মূল সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন থিওডোরা ড্যানেক। ভাষান্তর করেছেন জয়ন্ত বিশ্বাস। 

রাজনৈতিক সংজ্ঞা নিরুপণ বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সাহিত্য কি আসলেই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম? নাকি এই নির্দিষ্ট গন্ডি থেকে সাহিত্য বিচ্ছিন্ন? আপনার কী মনে হয়?

যদি এক্ষেত্রে সাহিত্য ভূমিকা রেখেও থাকে, আমার মতে সেটা হয়ে থাকে অবচেতনভাবে। একজন লেখক যদি শুধু রাজনৈতিক সক্রিয়তার কারণে উপন্যাস লিখে থাকেন, তাহলে তাঁর লেখার শৈল্পিক আবেদন ক্ষুণ্ণ হবেই। আপনারা অবশ্যই জানেন, আমার বেড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আমলে-খুবই শক্তিশালী প্রোপাগান্ডার আওতার মধ্যে। প্রোপাগান্ডা জিনিসটাই এমন- এটা একটা বই বা একটা চিত্রকর্ম থেকে সমূহ শৈল্পিক নির্যাসটুকু শুষে নিতে পারে। 

আপনি কি এরকম অনুভব করেন যে, এখনো প্রোপাগান্ডার আওতার মধ্যে থেকেই আপনি কাজ করছেন?

 বর্তমান সময়ে পোল্যান্ডে খুবই শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা বিদ্যমান। এমনকি আমার বাল্যকালে, কমিউনিস্ট আমলেও এরকমটা দেখেছি বলে স্মরণ হয় না। এখনকার প্রোপাগান্ডা আগের চাইতে আরও বেশি বাস্তবধর্মী। কারণ এখানে ধুর্ততার সঙ্গে ইন্টারনেট কিংবা মিথ্যা খবরকে কাজে লাগানো হয়। আমাদের সরকার একটা ‘প্রোপাগান্ডা মেশিন’ নির্মাণ করতে চায়। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের অতীতের স্মৃতি থেকে যাবতীয় অন্ধকার দিকগুলোর অস্তিত্ব মুছে ফেলার। তারা চাইছে নতুন করে ইতিহাসকে বিনির্মাণ করতে। আমার অভিজ্ঞতা বলে যে আধুনিক পোল্যান্ডে একজন লেখকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখক হিসেবে সবার আগে আমাদের সৎ থাকতে হবে। আমরা সারা পৃথিবীর সামনে অকপট সত্যটাই তুলে ধরার সাধনাই করে যাব। 

আপনার সর্বশেষ বইয়ের নাম ‘দ্য বুক অব জ্যাকব’। এই বই পাঠ করলে দেখা যায়- একক ভাষাভাষী, একক জাতিসত্তার একটি পৌরাণিক বা কাল্পনিক আখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। এটা কি বর্তমানকালে নির্মাণাধীন পোল্যান্ডেরই প্রতিফলন?

আমি মনে করি, আমার বইয়ের মূল বিষয় হচ্ছে এমন একটি পোল্যান্ড, যে ভূখন্ড বহুসংস্কৃতির মিলনে ঋদ্ধ। এই ধারণাটি বিকৃত নব্য ইতিহাসের প্রবক্তাদের কাছে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। বইটি দেশে বয়কট করা হয়। বর্তমান যে স্রোতে গা ভাসানোর প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে আমার বইটি গা ভাসাতে পারেনি। আমার কাছে আশ্চর্য লাগে, জানেন? সমসাময়িক যুদ্ধ-বিগ্রহগুলো আর রাজপথে, অস্ত্র হাতে নিয়ে সংঘটিত হয় না। এগুলো পরিচালিত হয় শব্দ আর বয়ানকে পুঁজি করে। বর্তমানে রাশিয়া আর পুতিনের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাবেন। সবশেষে একটা প্রশ্নই থেকে যাবে- গল্পটা মূলত ভালোভাবে বলতে পারছেন কে। 

আপনার কাজগুলোকে পোলিশ সরকারের কর্মকান্ডের মুখোমুখি দাঁড় করালে একটা ব্যাপার নজরে পড়ে। প্রশ্নটা বেশ জটিল- আসলে কে পোল্যান্ডের ইতিহাস বুঝতে পারে, আর কেই-বা ইতিহাসের এ আখ্যানটাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। 

‘দ্য বুকস অব জ্যাকব’ বইটার ক্ষেত্রে সমষ্টিগত আত্মপরিচয়ের একটা ভঙ্গের প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে নতুন বয়ান হচ্ছে- জাতীয়তাবাদী পরিভাষার নিরিখেই আমাদের আত্মোপলব্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই কথাগুলো যে বেমানান, সেটা তো জানা কথা। কারন আমরা অনুভব করি, ‘জাতি’ বা ‘রাষ্ট্র’ নামক ধারণাটাই কিছুটা পচে গিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী মানুষের সমসাময়িক পরিচয়কে বর্ণনা করার ক্ষমতা রাষ্ট্র রাখে না। নিজেদেরকে সামষ্টিক, গোষ্ঠীগত কিংবা সামাজিক পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে আমাদের অন্য পন্থাও খুঁজে বের করতে হবে। 

তবে মানুষ এখনও ‘রাষ্ট্র’ ধারণায় বিশ্বাস রেখে এর কাছেই ফিরে আসে। অবশ্যই পোল্যান্ডের অবস্থান মধ্য-ইউরোপে এবং আমরা এই অধিত্যকার বাসিন্দা। আমাদের আবাসস্থলে বারবার সেনাবাহিনী অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশভাগের কারণে আমরা জাতীয় আত্মপরিচয়-সংকটে ভুগছি। যেকোনো কিছু নৃ-গোষ্ঠীগতভাবে পোলিশ-ই হতে হবে, এই আশা আপনি করতে পারেন না। এই ধারণাটাই তো বিপদজ্জনক। 

এভাবেই তো মানুষের অস্তিত্ব ইতিহাস থেকে কেবল কলমের খোঁচায় মুছে ফেলা হচ্ছে। 

 হ্যাঁ, অবশ্যই। আর মধ্য-ইউরোপে রক্তের পরিচয়ের প্রসঙ্গ টানাটাই উন্মাদের প্রলাপ। আমার বইতে দেখানো হয়েছে- পোল্যান্ড বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করে গিয়েছে। পার্শ্ববর্তী অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে সীমান্তরেখা বিদ্যমান থাকায় এর সঙ্গে ইসলামিক সংস্কৃতিও জড়িত হয়েছে।

আমার বইটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো মূলত ইহুদি; পরবর্তীতে তারা ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় বদল করে ‘খাঁটি পোলিশ’ হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন পোলিশ আচার-সংস্কৃতির আদি উৎসের উপরেও আলোকপাত করার চেষ্টা ছিল। যেমন, এখানে পোলিশ মসীহাবাদ-এর উল্লেখ রয়েছে। বইটিতে মধ্য-ইউরোপের একটা পাত্রের সঙ্গে আমাদের তুলনা করা হয়েছে, যে পাত্রটি কিনা গলে গলে পড়ছে। প্রক্রিয়াটা খুব সরল, বাস্তবসম্মত। 

আপনার ‘ফ্লাইটস’ উপন্যাসটি খুব সম্প্রতি ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়েছে। পাঠকদের মতামত হচ্ছে- এখানে আধুনিক মানুষের ঘর বাঁধার অক্ষমতা ও সর্বক্ষণ ছুটে বেড়ানোর প্রবণতাই এই বইয়ের সারকথা। আপনার সব লেখায় কি এই বিষয়টাকেই সারকথা বলবেন?

 হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে একমত পোষণ করবো। ‘হাউস অব ডে, হাউস অব নাইট’ নামে আমার একটি উপন্যাসে রয়েছে। এটাকে ঘর বাঁধার উপলক্ষে একটা ‘হাইম’ গানের মতো ধরে নিতে পারেন। এখানে নায়িকা চরিত্রটি একটা বাড়ি কেনে। এক জায়গায় ঘর বাঁধা বা শিকড় গাঁড়তে পারাটা কত চমৎকার, সেই বিষয়টাকে আপাতভাবে গানের মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে আমার মনে হয়, উপন্যাসটি আমি স্বপ্নের মধ্যে লিখেছিলাম। এমন একটা স্বপ্ন, যেটা একই সঙ্গে সুন্দর, আবার পীড়াদায়ক। এই শিকড়বিহীন, ঘরছাড়া যাযাবর জীবনের ধারণাই আমার মননকে প্রভাবিত করেছে। একটা প্রলম্বিত সময় ধরে এটা বারবার আমার মস্তিষ্কে ফিরে ফিরে এসেছে। দেখবেন, আমার প্রথম উপন্যাসের শিরোনামেও এই ‘ভ্রমণ’ শব্দটি রয়েছে। 

পূর্বেই আপনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন একজন মধ্য-ইউরোপীয় লেখক হিসেবে। এ ছাড়াও মধ্য-ইউরোপের ‘সাইলেন্সিয়া’তে নিয়মিতভাবে একটা উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। এই ‘মধ্য-ইউরোপীয় লেখক’ পরিচয়টা আপনি কীভাবে দেখেন? এখানে কি স্থানটা মুখ্য বিষয়, নাকি ধারণাটা? 

 এই ধারনার শেষ পরিণতি সম্পর্কে আমি এখনো পুরোপুরি অবগত নই। তবে এই বিষয়ে আমার কিছুটা আগাম আন্দাজ রয়েছে। আমি মনে করি, ঐতিহাসিকভাবেই পশ্চিমের চাইতে মধ্য-ইউরোপে সাহিত্য ভিন্ন ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পশ্চিম ইউরোপে অবসরযাপন বা আনন্দের উদ্দেশ্যেই সাহিত্য বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যবিত্ত সমাজ এর দ্বারা তাঁদের জৈবনিক অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করতে পেরেছে। 

প্রথমত, মধ্য-ইউরোপে সাহিত্যের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্ত্রের মতো। পোল্যান্ডে দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যই মানুষের পরিচয়ের বড় নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন ধরুন, নির্দিষ্ট একটা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে এটা সহায়তা করেছে। সাহিত্যের ওপরে যেসব দায়িত্ব ছিল, তা রাজনীতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তার পুরোটাই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। 

দ্বিতীয়ত, একটা দীর্ঘ সময় আমাদের এখানে ‘মধ্যবিত্ত সমাজ’ বলে কোনো কিছুর আলাদা অস্তিত্ব ছিল না। দেশভাগের সময় পোল্যান্ড তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। তখন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ জার্মান আর রাশিয়ান ভাষা ব্যবহার করতো; কিন্তু এগুলো তো অন্য সমাজের অংশ। মধ্যবিত্ত সমাজ না থাকলে সেখানে পাঠকও গড়ে ওঠে না। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিরক্ষতার অভিশাপের মধ্যে দিন কাটায়, সেখানে বইয়ের বাজারের চিন্তা আসাটাই তো বাতুলতা। পূর্বে পোল্যান্ডে কবিতা খুব জনপ্রিয় ছিল। আমাদের নোবেলজয়ী দু‘জন কবি রয়েছেন। আমরা কারা, পৃথিবী কী- এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যার জন্য কবিতাই প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কবিতা আত্মস্থ করাও তুলনামূলক সহজ। মঞ্চে উঠে আবৃত্তি করাও সম্ভব। কিন্তু উপন্যাসের ধারা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে অনেক সময় নিয়েছে। 

অন্যদিকে পোলিশ উপন্যাসের জন্য একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এগুলোতে ইতিহাস জড়িত থাকবে; মূল উদ্দেশ্য থাকবে মানুষের মনোবল বাড়িয়ে তোলা। তাঁরা দেখিয়েছেন যে পোল্যান্ডের ইতিহাস মানেই চেতনা-উদ্দীপক বীরত্বগাঁথা। তাঁদের মিশনই ছিল একটা সুন্দর রূপকথার গল্প সৃষ্টি করা। আপনারা জানেন যে সাহিত্যের ভূমিকা কখনোই এককেন্দ্রিক নয়। পশ্চিমে আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়, মধ্য-ইউরোপীয় একজন লেখক হয়ে আমি ভিন্নধারার পরীক্ষামূলক লেখার দিকে কেন ঝুঁকেছি।

আমার মনে হয়, বাস্তবতার বোধ বা অনুভূতি আমাদের কাছে ভিন্ন। যুক্তরাজ্য যেমন দ্বীপরাষ্ট্র, সেখানকার বাস্তবতার মতো এখানকার বাস্তবতা সুস্থিত নয়। সবকিছুই একই রকম, সব সময়। সেই একই পুরনো বিল্ডিংগুলো, পুরনো শুঁড়িখানাগুলো- বৈচিত্র্যহীন। একঘেয়ে সংস্কৃতির সঙ্গেই আপনি বাঁধা পড়ে যাবেন। কিন্তু ধরুন, আপনার দেশের রাজধানী ওয়ারশ। এই শহরটা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখানে যে কোন কিছুই পরিবর্তনীয়, গতিময়। তাই সাহিত্যেও যে কোনো কিছু আপনি আপনার মত পরিবর্তন করে লিখতে পারেন; সুনির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে থাকার দায়বদ্ধতা আপনার থাকবে না। বাস্তবতার এই যে গতিময়তা, এটার অনুভূতি খুবই শক্তিশালী। 

‘চিরায়ত সাহিত্যের প্রথা অনুযায়ী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা গল্প বলার প্রক্রিয়ায় আমরা বিশ্বাস করি না। কারণ এটা মূলত সত্যি নয়। এরকম নান্দনিক একরৈখিক উপায়ে আসলে কোন কিছুই ঘটে না।’

একটা গল্প বলা, তারপরে তার মর্মোদ্ধার করা-প্রক্রিয়ার প্রতিটি বাঁকেই আসলে কূটাভাসের সম্মুখীন হতে হয়। এটা আসলে অস্থিরভাবে হাতড়ে বেড়ানোর মতো; সম্ভবত লেখার বিন্যাসেও এই বিষয়টা প্রভাব রাখে। 

এটা অবশ্যই ইতিহাসকে আরও সূচারুভাবে প্রতিফলিত করে। কারণ, ইতিহাস যে কেবলই একটা একরৈখিক বয়ান, সেই ধারণাটাই আমার কাছে অলীক বলে মনে হয়। আপনার মতে মধ্য-ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে অন্যান্য স্থানের সাহিত্যের বড় পার্থক্য কি তাহলে এটাই? এখানকার সাহিত্য কি আসলেই মনোরঞ্জনের পরিবর্তে একটা নৈতিক উদ্দেশ্য লালন করে; সমাজের অসঙ্গতিগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করাই এর উদ্দেশ্য?

হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি অস্ট্রিয়ান সাহিত্যের কথাই চিন্তা করুন। আপনার নিজের শরীরে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে, সেই কষ্টটাই অনুভব করার মতো ব্যাপার। এটা কি যন্ত্রণাদায়ক না? এর পেছনে মনোঃসমীক্ষণও একটা বড় কারণ- কেননা এই বিষয়ের উৎপত্তিস্থলও কিন্তু এই মধ্য-ইউরোপ। মধ্য-ইউরোপীয় সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটা অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন।

এখানে মানবজাতির অন্ধকার দিকেই বেশি আলোকপাত করা হয়েছে। মধ্য-ইউরোপীয় সাহিত্যে ইহুদি পরম্পরাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি জুড়েই এই ঐতিহ্যের জীবন্ত অস্তিত্ব ছিল। পোলিশ মসীহাবাদের বিষয়টিই ধরুন। খাঁটি পোলিশ আত্মপরিচয় প্রচেষ্টার কি রোমান্টিক ইঁদুর-দৌড় চলছে! এটাই তো বড় একটা কূটাভাস- আপনি ইহুদিদের চিন্তার ওপরে ভর করে নিজের ‘পোলিশ’ পরিচয় গড়ে তুললেন; আবার তারপরে দাম্ভিকতাভরে সেই ইহুদিদেরকেই বিতাড়িত করলেন। আমার কাছে ইহুদিদের উপস্থিতি, তাঁদের অবদান সবসময়ই অর্থবহ। 

আপনার কাছে সর্বশেষ একটা প্রশ্ন করব। রাষ্ট্রসীমানার পরিবর্তনশীলতা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। একজন ‘পোলিশ লেখক’ হিসেবে পরিচিত হতে আপনার কেমন লাগে? রাষ্ট্রীয় পরিচয়ও কি আপনার কাছে তাৎপর্য বহন করে, নাকি রাষ্ট্রের মত একটা কাঠামোবদ্ধ স্থান সাপেক্ষে এই ‘পোলিশ লেখক’ ধারণাও আপনার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়?

 আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি যে সাহিত্যের কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা থাকতে পারে না। সাহিত্য একক বিষয়; বিভিন্ন ভাষাগুলোকে এটা যন্ত্রাংশের মতো কাজে লাগায়। এই কারণেই অনুবাদকদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ভাষার ভেতরে মেলবন্ধনের জন্য সেতু হিসেবে তাঁরাই কাজ করে থাকেন। তাঁদের কারণেই সাহিত্যের এই একক পরিচয়টা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

চীনের একটা বই পড়ার সময়েও কোনো কিছু আমার ব্যক্তিমননকে স্পর্শ করলে, আমাকে আপ্লুত করলে সেই জায়গাটা আমি চিনে নিতে পারি। এটাকে অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আপনি আর কী বলবেন? আমরা সবাই কিন্তু শেষমেশ সাধারণ একটা অবচেতনই ভাগ করে থাকি। এই সাধারণ বা যৌথ অবচেতন থেকেই সাহিত্যের জন্ম হয়। ভাষা আর সংস্কৃতির বিচারে আমার পরিচয় হতে পারে- একজন পোলিশ লেখক। কিন্তু নিজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আমি নিজেকে একজন বিশ্বজনীন লেখক বলেই মনে করি। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh