রোমের পাহাড়ি গ্রামে সৌন্দর্যের হাতছানি

ইমদাদ হক

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২০, ০৯:২০ এএম

রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার পরতে পরতে যে লুকিয়ে থাকতে পারে ভয়ংকর শীত, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যখন ইতালিতে পৌঁছে, ঘড়িতে সময় তখন বিকেল ৪টা। রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফিয়ামিসিনো বিমানবন্দরে তখনো রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল।

বিমানের জানালা দিয়ে তাকাতেই মুগ্ধতার বিস্ময়, যেন বসন্তকাল। বিমানের সিঁড়ি ভেঙে নামতেই ঘোর ভাঙে। মৃদু বাতাস, তবে বাংলাদেশের দক্ষিণা নয়, উত্তর মেরু থেকে বয়ে আসা আর্টিক বায়ু। মুহূর্তেই কেঁপে ওঠে পুরো শরীর, ইউরোপের তীব্র শীতেরই আভাস।

ঢাকায় থেকে গুগল করে জেনেছিলাম, রোমে দিনের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। রাতের বেলায় তা শূন্য বা মাইনাসে নামে। গুগলের তথ্য আর মাঘের হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে তফাৎটা টের পেলাম হারে হারে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শরীর ঠান্ডায় অবশ। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেও দেখি টাইবার নদীর তীরে গড়ে ওঠা বিমানবন্দরটি। জানালার পাশে সিট হওয়ায় ওপর থেকেই মন্ত্রমুগ্ধতার বিস্ময়ে চেয়ে দেখি নিচের সৌন্দর্য।

টাইবারের দু’তীরের পাশে গড়ে ওঠা আধুনিক রোমের নানা স্থাপত্য। নদীর পানি খানিকটা নীল, অদূরে সারি সারি নীলচে পাহাড়। মেলানোর চেষ্টা করি ভারতীয় উপমহাদেশের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে, স্বভাবতই মিলে না। বিমানবন্দর থেকে বের হতে সময় লাগেনি। ঝকঝকে তকতকে বিমানবন্দর।

এটি দেশটির ব্যস্ততম বিমানবন্দর, পুরো ইউরোপে ব্যস্ততার দিক থেকে যার অবস্থান ষষ্ঠ। পুরো বিমানবন্দর মসৃণ ও ঝকঝকে। এত স্বচ্ছ জায়গা আর নিরাপদ জায়গা পৃথিবীতে আর ক’টা আছে খুঁজে দেখতে হবে। দৌড় দিয়ে গিয়ে আমাদের জন্য রাখা প্রটোকলের গাড়িতে উঠলাম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে গাড়িতে ছিলাম ইতালির মিলানে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসের কনসাল জেনারেল ইকবাল আহমেদ আর আমি।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত চার দিনের এই সরকারি সফর ছিলো ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতের আমন্ত্রণে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান মিনিস্টার নিপোটেনসিয়ারি অব ইতালিয়ান ফরেন মিনিস্ট্রি ক্রিস্টিয়ানো কোস্তাফাবি ও ইতালিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মোটর শোভাযাত্রাসহ আমাদের গাড়িবহর ছুটে চলে রোমের পার্কো দেই প্রিন্সিপি গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড স্পায়। বিমানবন্দর থেকে হোটেলের দূরত্ব প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। আমাদের গাড়িতে সময় লাগে পৌনে এক ঘণ্টার মতো।  

আমাদের গাড়িতে দূতাবাসের কনসাল জেনারেল থাকায় নানান দিক থেকেই আমাদের সুবিধা। কর্মক্ষেত্রের সুবাদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর তার সখ্য বেশ আগের। নিউ  ইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন। মাঝে কয়েক বছরের বিরতির পর আবার তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকর্মী হিসেবে সঙ্গী হয়েছেন। রোমে পৌঁছার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সঙ্গী ছিলেন তিনি, বলা যেতে পারে আমাদের গাইড হিসেবেও কাজ করেছেন। সেই কবেকার কোন সম্রাট, সাম্রাজ্য, একেকটা ইতিহাসের একেকটা অধ্যায় শুনে মুগ্ধ হতে থাকি প্রাজ্ঞ এই দুই পন্ডিতের কাছ থেকে। 

বিমানবন্দর থেকে বের হলাম। গাড়ির স্বচ্ছ কাচের মধ্যে দিয়ে তাকালাম। দু’পাশে সবুজ। ভার্সিটিতে পড়ার সময় ট্রেন কিংবা বাসে করে বাড়ি যেতাম। সে সময়ে জানালার ধারে বসতাম। বেশিরভাগ সময় দিনেই ভ্রমণ করতাম, জানালা দিয়ে গ্রামের পরিবেশ আর ব্যস্ত জনজীবন দেখা যাবে বলে। ইতালিতে এসেও তাই অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে ফেলে আসা সেই অভ্যাস। নতুন জায়গায় যাবার আগে একটু পড়াশোনা করে যাবার চেষ্টা করি। পরে তা মিলিয়ে নেই বাস্তবে।

জাহাঙ্গীরনগরের এক বড় ভাই কাজ করেন স্থানীয় হোটেলে। তার মতে, ইতালিতে কৃষকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগেরই বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। ক্ষেতে খামারের জমির এক-তৃতীয়াংশে ফসল ফলানো যাচ্ছে না লোকের অভাবে। কৃষিতে ইউরোপের মতো এত ভর্তুকি মনে হয় অন্য কোথাও দেওয়া হয় না। মোট কৃষি খামারের এক-তৃতীয়াংশই প্রান্তিক। হয়তো বা আবাদের অভাবে এক সময় ঘন জঙ্গল বা বনে ভরে যাবে সব এলাকা। 

কনসাল জেনারেল গাড়িতে মজা করে বলছিলেন, ইতালির মেয়েদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে বাঙালি ছেলেরা। কারণ, বাঙালি ছেলেরা বাচ্চার বাবা হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। কনসাল জেনারেল মজা করে বলে উঠলেন, আমাদের দেশের সব তরুণকে আমরা ইতালিতে পাঠিয়ে দিই। আমাদের গাড়ির ইতালিয়ান ড্রাইভার ঘাড় বাঁকা করে আমাদের দিকে তাকালেন, সে কি বাংলা বোঝে?

রাতের বেলায় হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম বাইরের হোটেলে খেতে। কনসাল জেনারেল টাইবারের তীরে একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন। ইতালির খাবার বলতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিস্তা আর পিৎজা। এর বাইরেও যে হরেক রকম মজার খাবার আছে, ইতালির নানা প্রান্তজুড়ে।

রঙ, গন্ধ আর উপস্থাপনা দেখে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। লেবুর রস, অলিভ অয়েল, রসুন-গোলমরিচ আর তিল দিয়ে বানানো তিলে টুনার স্বাদ এখনো মুখে। সাদা চকলেট গলিয়ে ডিমের কুসুম, ফ্রেশ ক্রিম  জেলাটিন ও চকলেট দিয়ে তৈরি সিসিলির সূর্যটাও ছিল আকর্ষণীয়। বিফ কারপাচ্চো, স্প্যাগেটি, স্প্যাগেটি আলফ্রেডো, পিৎজা মারগারিটা, রতোলো অল চকলাতো, তিরামিসু, আরও কত কি, নাম মনে নেই। বাঙালি ছেলেগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কত আন্তরিকতার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করল।

মজার ব্যাপার হলো, ইতালিতে প্রয়োজনের তুলনায় এখনো লোকজন কম। ইউরোপের নানা দেশেই শরণার্থী আশ্রয়ের ব্যাপারে কঠিন নীতিমালা হচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো, ইতালিতে এখনো খানিকটা সুযোগ আছে। এটাকে কাজে লাগাতে পারলে অনেক বাংলাদেশিরই কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নিরাপদ আবাসন গড়ে উঠবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh