ফিরে দেখা ’৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলন

ফয়জুল হাকিম

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২০, ১১:২৬ পিএম

সামরিক ক্যুদেতা করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা এবং পরবর্তীকালে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এ ঘটনার মাঝে কোনো যোগসাজশ আছে কি না সে প্রশ্ন আজকের দিনেও সামনে চলে আসে। সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সেদিনের জনগণ যেমন সহজভাবে মেনে নেয়নি, তেমনি মেনে নেয়নি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসহ সমাজের সচেতন অংশ। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলনকে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে। 

রাষ্ট্র ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব প্রকাশ্যে দাবি করে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর যে হস্তক্ষেপ করেছিলেন, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, দেশে শিগগির সেনাশাসন জারি হতে চলেছে। সেই সময় সেই চিন্তা থেকে কয়েকটি প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র সংগ্রাম গঠনের প্রস্তুতি ভেতরে ভেতরে চলছিল। রাষ্ট্রপতিকে উৎখাত করে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে বামপন্থী কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সমাজের সচেতন অংশ রাজপথে সামরিক শামনের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে প্রতিরোধ গড়বার আহ্বান জানিয়েছিল। যদিও সে-সময় প্রধান বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো ছিল নীরব দর্শক। কেউ কেউ ‘উই আর নট আনহ্যাপি’ বলে কার্যত সামরিকবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানিয়েছিল। প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার সম্পাদকীয়র শেষ লাইন ছিল এমন যে, সামরিকজান্তা প্রধান জেনারেল এরশাদকে একজন ‘কবি’ বলে ‘রক্তপাতহীন সামরিক ক্যুদেতাকে’ অভিনন্দিত করেছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় পূর্ব বাংলায় ষাটের দশকে সৃষ্ট সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের থেকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশে আশির দশকে সংগঠিত সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের উত্থানের গুরুত্ব ছিল একাধারে ভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ। তা উপলব্ধির ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল।

শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করা ও সাম্প্রদায়িক মোড়কে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে সামরিকজান্তা প্রণীত মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী অংশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুল পর্যায়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে সমবেত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের এই প্রচারণা, সামরিক শাসনের অবরুদ্ধ সময়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য আকাক্সক্ষা সংগ্রামে এক স্বতঃস্ফূর্ত গতি সঞ্চারিত করেছিল।

স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে প্রথম থেকেই শাসকশ্রেণির শোষণ-নির্যাতন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টাকে দমন করবার যেসব ঘৃণ্যনীতি সরকারি মহল থেকে নেওয়া হয়েছিল ’৮০ দশকেও তার ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। ’৮৩- এর মধ্য ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলন সামরিক শাসনের গতিরোধ করবার কারণে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছিল। প্রথমে ঘরোয়া রাজনীতি এবং পরে প্রকাশ্যে রাজপথে সভা-সমাবেশ করার ক্ষমতা জনগণ অর্জন করেছিল। শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠনসমূহ, সাংবাদিকদের সংগঠনসমূহ, সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ, নারী সংগঠনসমূহ, কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনসমূহসহ শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক প্রভৃতি শ্রেণিপেশার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষা রাজপথে নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে উঠে। এ ধরনের নানা পেশার আন্দোলন স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার শাসন পতনের শর্ত তৈরি করেছিল। 

বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি নিজ শ্রেণিস্বার্থ অক্ষত রাখতে সামরিকজান্তার সঙ্গে আপোষ ও আত্মসমর্পণ করেছিল। এই সুবিধাবাদী নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজসহ শ্রেণি-পেশার জনগণের সচেতন প্রতিরোধ ও উদ্যোগের কারণে ১৯৯০ সালে নতুন করে ছাত্র সমাজের উত্থান ‘স্বৈরাচার উচ্ছেদ না করে ঘরে ফিরব না’ প্রতিজ্ঞাকে স্বার্থক করেছিল। আলাপ-আলোচনার পথ বাতিল করে রাজপথেই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক বলপ্রয়োগ-গণঅভ্যুত্থান সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতনকে নিশ্চিত করেছিল। এভাবে গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক জান্তার সরকারের পতন হলেও জনগণের হাতে ক্ষমতা গঠন করার যেসব শর্ত জরুরি ছিল, কার্যত তা বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের হাতে ছিল না। কেননা এই অস্থায়ী সরকার গণঅভ্যুত্থানের চাপে গঠিত হলেও কার্যত তা দাঁড়িয়েছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের খুঁটিতে। যে খুঁটি মূলত লুটেরা, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ শাসকশ্রেণি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সেবায় নিয়োজিত ছিল। শাসকশ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদের সেবায় এবং শোষণমূলক ব্যবস্থার শৃঙ্খলা আনতে নির্দলীয় এই অস্থায়ী সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানই ছিল প্রধান বিবেচ্য। ফলে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নানা শ্রেণিপেশার গণতান্ত্রিক দাবিসমূহকে পাশ কাটিয়ে একটি নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানই শুধু অগ্রাধিকার পেল। 

আজকের দিনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে ’৮০ দশকের ছাত্র গণআন্দোলনের সারসংকলন করলে এটা বোঝা সহজ হয় যে, জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের শক্তি কেন্দ্রীভূত করে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির সামনে ভিন্ন কোনো পথ খোলা নেই। এই রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা-চিকিৎসা, অবসর প্রভৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনকে সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সে কাজ করতে বর্তমানে জনগণের অংশগ্রহণহীন নির্বাচনে ও জনগণের অসম্মতিতে গঠিত জাতীয় সংসদ এবং সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রাম বেগবান করতে হবে। জনগণের ক্ষমতার পথে বাধা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত দেশীয় শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধেই সংগ্রামের বর্শাফলক স্থাপন করতে হবে। 

বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য ধনিক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্থবির হয়ে আছে। তাই আজকের দিনে বুর্জোয়া দলগুলোর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে পারে না। একমাত্র শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারে। বর্তমান অবরুদ্ধ সময়ের হাত থেকে তাই মুক্তি পেতে সমাজের সর্বস্তরে জনগণের ভেতর যে পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে তাকে কাজে লাগাতে হবে। একদলীয় শাসনের অধীনে নির্বাচনে মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা যে পূরণ হওয়ার নয় তা জনগণ বুঝে গেছে। জনগণ এই দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য যে সংগ্রামের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সে পথের সন্ধান দেওয়াই আজকের দিনের গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক, জোট, শ্রেণি-গণসংগঠনের দায়িত্ব। কত দ্রুত এই দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক শক্তি ভূমিকা নেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ফয়জুল হাকিম 

সাধারণ সম্পাদক

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh