বিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ কি কেবল কথার কথা!

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২০, ০৯:৪২ পিএম

বদি থেকে সম্রাট হয়ে পাপিয়া। মাদক থেকে ক্যাসিনো হয়ে নারী কেলেঙ্কারি। পাপিয়া-সুমন নারী কেলেঙ্কারি নিয়ে যখন দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে, তখনই ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির দুই সহযোগী এনামুল-রুপনের বাড়িতে টাকা-সোনার খনি আবিষ্কৃত হলো। বিস্মিত-হতবাক হওয়ার মতো কাণ্ড-কারখানা বটে। অন্ধকার জগতের সবকিছুর সঙ্গে নিঃসন্দেহে জড়িয়ে আছে ক্ষমতা। আর ক্ষমতায় যেহেতু রয়েছে সুদীর্ঘ- প্রায় বারো বছর ধরে আওয়ামী লীগ, তাই স্বাভাবিকভাবেই এ দলটি এসবের সঙ্গে বেশ গভীরভাবেই জড়িয়ে গেছে। এর শিকড় কতটুকু গভীর, তা এখনো রহস্যাবৃত বিষয়। সমাজ ও দলের যে কতটা পচন ধরেছে, এসব ঘটনা তার প্রমাণ।

এতদাসংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলেই ক্ষমতা-কেন্দ্রের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে বলে সমালোচনার ঝড় উঠছে। পাপিয়া-সুমন নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা উন্মোচিত হওয়ার পর ১১ জন মন্ত্রী ও ৩৩ জন এমপির সঙ্গে তাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ থাকার কথা প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে পাপিয়ার অন্তরঙ্গ ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। মন্ত্রী-নেতা কারও কারও নানা কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে আড্ডায়-কথাবার্তায় গুজব জমে উঠছে। যা একেবারেই অভিপ্রেত ছিল না এবং তা দেশের রাজনীতির জন্য গভীর শঙ্কার কারণ।

দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ। এই দল গণসমর্থন থাকায়ই ক্ষমতায় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণের একমাত্র ভরসা ও বিশ্বাস এই দলের ওপরই রাখতে পারে। কিন্তু অন্ধকার জগতের সব ঘটনায় তৃণমূল পর্যন্ত এ দলের জড়িত হওয়া এবং উচ্চাসনের গডফাদারদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনার জাল ক্রমে বিস্তৃত হওয়ার ঘটনায় মানুষ হতাশ ও শঙ্কিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগে হচ্ছেটা কী? রাজনীতিতে আর ভালো কিছু থাকল কী? বাস্তবে এসব ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, মানুষের জীবন-জীবিকার চলমান স্বাচ্ছন্দ্য, বিশ্ব পরিমণ্ডলে সাফল্যের সুখ্যাতি প্রভৃতি সব যেন ম্লান বা আড়াল হচ্ছে। দেশের ভেতর আওয়ামী লীগ প্রশংসার চাইতে সমালোচনার মধ্যে বেশি পড়ছে।

এটা তো কারোই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোনো বিষয়ে যদি সমালোচনা বাড়ে, তবে আরও নানা ছোট-বড় সমালোচনা এসে দ্রুততার সঙ্গে তাতে যুক্ত হয়। যেমন গাছের আগা ধরে টানলে গোড়ায় এসে টান পড়ে, তেমনটা রাজনীতির ক্ষেত্রেও হয়। জাতীয় চারনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নে আওয়ামী লীগ যথার্থ অবস্থানে আছে কি না, এভাবে চলতে থাকলে অবস্থানে আদৌ থাকতে পারবে কি না আর না থাকতে পারলে জন্মলগ্নের মর্মবাণী জাতীয় চার মূলনীতির বাস্তবায়নের কী হাল হবে প্রভৃতি সব প্রশ্ন কিন্তু এখন নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লিখিত বিষয় নিয়ে মানুষ যখন আলোড়িত, তখন বদি-সম্রাট-পাপিয়া কেলেঙ্কারি সামনে রেখে এবং সম্রাট-পাপিয়া গংদের ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে’ জানিয়ে ২৫ আক্টোবর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘তাদের নেতাকর্মীরা কত লুটপাট ও দুর্নীতি করেছে, কত অন্যায় করেছে কিন্তু কোনো অপকর্মের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কি কাউকে শাস্তি দিয়েছেন? এমন সৎ সাহস কি খালেদা জিয়ার আছে? অপরাধের জন্য তাদের নেতাকর্মীদের শাস্তি দিয়েছেন, এমন নজির নেই। এ সৎ সাহস তাদের নেই, এ সৎ সাহস একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই রয়েছে।’

এটা ঠিক, অতীতের সরকারগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বেশ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে অব্যাহত মজুদদারি-চোরাচালানি-লাইসেন্স বিক্রি, ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দমনে আর্মি নামানো হয়েছিল, কিন্তু দলীয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কারণে তা অগ্রসর হতে পারে নাই। বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল করে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা চালু করতে হয়েছিল। এর পরিণতিতে কী হয়েছিল সকলের জানা এবং একটি দল গঠনের সমালোচনার জের এখনও চলছে। এরপর খুনি মোশতাকের শাসনের স্বল্প সময়ে ছিল খুনিদেরই দৌরাত্ম্যের শাসন। জিয়াউর রহমান বিদেশ সফর বাতিল করে দুর্নীতি ও তা নিয়ে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সামলাতে চট্টগ্রামে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন। হত্যা মামলার আসামি ইমদুর মতো কুখ্যাত সন্ত্রাসী সামলাতে না পেরে রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে নত মস্তকে বঙ্গভবন থেকে বের হতে হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ নারী-মাদক-অর্থ কেলেঙ্কারী-দুর্নীতি নিয়ে নানা কেচ্ছা-কাহিনির জন্ম দিয়ে ক্ষমতা থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে অপসারিত হয়েছিলেন।

আর খালেদা জিয়া জামায়াতকে সঙ্গে রেখে হাওয়া ভবনের জন্ম দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। মোশতাক, জিয়া-সাত্তার, এরশাদ, খালেদা জিয়া সবাই এসব কারণে অবৈধ সামরিক হস্তক্ষেপে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। একমাত্র শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামল ছিল এর ব্যতিক্রম। তখন তেমন কোনো বিশেষ কেলিঙ্কারির কেচ্ছা-কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে তেমন কোনো অস্থিতিশীল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ায় সংবিধান মোতাবেক সরকার পরিবর্তন সম্ভবপর করে তুলেছিল। এটাই ছিল দেশের ইতিহাসের অনন্য এক ঘটনা। কেননা পাকিস্তানি আমলেও কোনো সরকার সংবিধান ও গণতান্ত্রিক পথে পরিবর্তিত হয় নাই। ১৯৫৪ সালে ৯২ (ক) ধারা, ১৯৫৮ তে আইয়ুবের সামরিক শাসন, ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার শাসন এর প্রমাণ।

এ কারণেই ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় বসে, ২০১৯ সালে যখন ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দিয়ে আবারো ক্ষমতাসীন হয়; বিশেষত ক্যাসিনো কেলেংকারি নিয়ে আওয়ামী লীগ দলটি সমালোচনার মধ্যে পড়ে; তখন ধারণা করা গিয়েছিল এবার আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই দলের ভেতরে গজিয়ে ওঠা অপরাধ জগত নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সম্মেলনগুলো এ লক্ষ্য পূরণের জন্যই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল সব প্রচেষ্টাই অকার্যকর হতে বসেছে। যারাই আওয়ামী লীগ মহলে কান পাতবেন তারাই শুনতে পাবেন, এসব অপরাধ জগৎ সম্পর্কে গালগল্প। দলের পরিমণ্ডলের বাইরে যেসব গল্প হয়, তার চাইতে দলের মধ্যে এসব নিয়ে গল্প হয় আরও গভীরে গিয়ে মুখরোচকভাবে।

আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে যখন কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দৃষ্টি গোচর না হওয়ায় দলের পক্ষের জনগণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ; তখন সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের বললেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পাপিয়া গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রেপ্তার কী প্রমাণ করে? দলের অকার্যকরিতা নয় কি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীইবা এইসব অন্ধকারের ঘটনা এতটা বাড়তে দিচ্ছে কেন? অন্ধকারের জগৎ গড়ে উঠবে না, বিদ্যমান বাস্তবতায় এমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু অঙ্কুরে কি তা বিনষ্ট করা সম্ভব নয়? এর জন্য কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের প্রয়োজন রয়েছে? আওয়ামী লীগ ও সরকার কি ঠিক করেছে, পদাধিকারিদের গ্রেপ্তার করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের প্রয়োজন?

আওয়ামী লীগ দল আর সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রীদের ভূমিকাকে আর কত খাটো করতে চাওয়া হচ্ছে, তা বুঝে উঠতে পারা কঠিন। এটাও তো ঠিক যে, সরকার ও দলের ভূমিকাকে খাটো করতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ভূমিকাও উন্নত ও প্রসারিত হবে না। কারণ সরকার ও দলের সঙ্গে তিনি রয়েছেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের বলেছেন ‘বিশুদ্ধ দল চাই’। এমনসব কথা মুখে বলে আর কোনো লাভ নেই। কথার সঙ্গে মিল রেখে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। এখন এসব প্রশ্ন ও দিকগুলো সামনে রেখে দল হিসাবে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিবে, এটাই মুজিববর্ষের কাউন্ট-ডাউন যখন শুরু হয়েছে, তখন জনগণের একান্ত কামনা।

শেখর দত্ত

কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh