রইসউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২০, ০১:৩৪ পিএম
বিজেপি সরকারের ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইন’ (সিএএ) ও ‘জাতীয় নাগরিক তালিকা আইন’র (এনআরসি) বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে একমাস যাবত লাগাতার গণবিক্ষোভ চলছে। “নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের কারণে মুসলমানরা বাদে অন্যরা ভারতের নাগরিক হতে পারবে, আর ‘জাতীয় নাগরিক তালিকা’ আইনের বলে ভারতীয় মুসলমান গরিবদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করে প্রকারান্তরে তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা হবে।”
আন্দোলনরত জনগণের ওপর বিজেপি সরকারের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের জবাবে, সরকারের এই ফ্যাসিবাদী আইন কতটা রাষ্ট্রের ‘সংবিধান বিরোধী’ তা প্রমাণের জন্য আন্দোলনকারীরা এখন সাধারণ জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন ভারতীয় সংবিধান। সরকারের এই নতুন আইন প্রকৃতই ভারতীয় সংবিধান বিরোধী হওয়ায়, খোদ সংবিধানই এখন দাঁড়িয়েছে আন্দোলনের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে। বিজেপির দুঃশাসন বিরোধী আন্দোলনের নীতি-কৌশলের এই মেরুকরণকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার ‘নবউন্মেষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সে হিসেবে এ আন্দোলন তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে হয়।
তবে সম্ভবত তার চেয়েও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ও ‘আকর্ষণীয়’ বিষয় হলো- সংবিধানকে আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশলটিকে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার নবউম্মেষ বলে মনে করা হলেও, এর পাল্টা আন্দোলন হিসেবে শাসক দল বিজেপি উচ্চকিত করে তুলেছে সংবিধানের চেয়েও মূল্যবান বস্তু ‘দেশপ্রেম’কে। আর দেশপ্রেম নিয়ে কথা বললে বলতে হয়, স্বাধীন ভারতে দেশপ্রেম হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে ’হিন্দু জাতীয়তাবাদ’। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের দীর্ঘকালের ইতিহাস হলো সংকীর্ণ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অনুশীলনের ইতিহাস। এক্ষেত্রে বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কংগ্রেসের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মৌলিক কোনো ফারাক নেই।
ব্রিটিশ ভারতে (১৯৩৮ সালে) এরূপ হিন্দু জাতীয়তাবাদের ‘তত্ত্ব’ দিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। তিনি বলেছিলেন- ‘ভারতবর্ষে শুধু একটিই জাতি আছে, সেটি হলো হিন্দু’। সাভারকরের ঘোষিত সেই হিন্দু জাতীয়বাদের তত্ত্ব ব্রিটিশ-পরবর্তী স্বাধীন ভারতের মাটিতে এমন শক্ত ভিত তৈরি করে যে, প্রায় চার দশকের শাসক কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার ফাঁকা বুলিকে তুলাধোনা করে হিন্দুত্ববাদ আজ মহীরূহের আকার ধারণ করে দেশপ্রেমের মহোৎসব করছে।
এর দায় শুধু বিজেপি-কংগ্রেসের নয়। এ দায় ভারতের জনগণের ওপরও বর্তায়। এমনকি ১৯৯২ সালে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কংগ্রেস শাসিত ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে মহাউৎসব করে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও ভারতবাসীর সম্বিৎ ফিরে আসেনি। সম্বিৎ ফিরে না আসার মনস্তাত্ত্বিক কারণও আছে। আধুনিক ভারতে হিন্দুত্ববাদ শুধু বিজেপির লোকদের মধ্যেই নয়, গোটা হিন্দু-ভারতীয় জনগণের মধ্যেও হিন্দু-জাত্যাভিমানের ‘অহিফেন’ হিসেবে সবসময় বিরাজ করেছে, অদ্যাবধি তা চলমানও। অতঃপর হিন্দুত্ববাদ আজ সর্বগ্রাসী ও সর্বধ্বংসী হয়ে উঠলে- সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে সত্তর বছরের ব্যর্থতার পর, ভারতীয় জনগণ আজ বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংবিধানের পাতা উঁচিয়ে তুলে ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমেছেন।
এই ‘সংবিধান’ ও ‘দেশপ্রেমের’ মধ্যকার লড়াইয়ের ফলাফল কী হবে আমরা জানি না। তবে চলমান আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বশেষ যে অশনিসংকেত শুনতে পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো, হিন্দুত্ববাদী দেশপ্রেমিক বিজেপির যুগপৎ ঘৃণা ও আক্রোশের চাঁদমারি (নিশানা) এখন সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের শক্তিশালী কেন্দ্র দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে শাহিনবাগ। শাহিনবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ভুয়া কুৎসা রটিয়ে সম্প্রতি নয়া দিল্লিতে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এ ঘটনায় কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় ৪০ জন মানুষ মারা গেছে। আর শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের ধুয়া তুলে ভারতের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা হয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি সরকার এখন এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এবং তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য দেশপ্রেমের রাজনীতির তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এ জন্যই এ আন্দোলনকে বিজেপি এখনকার লড়াইটা তাদের ভাষায় ‘দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহীর লড়াই’ বলে প্রচার চালাচ্ছে।
সেই অতিপরিচিত কৌশল। এই কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ ভারতে সাম্প্রদায়িক ভেদবৃদ্ধি অনুশীলনের শ্রেষ্ঠ পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সাতচল্লিশে এই কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমেই তারা দেশভাগ করেছেন এবং আজীবন রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহারের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করেছেন। সেই ইতিহাস আজ ভারত ও বাংলাদেশের নির্মোহ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখির মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে।
ভারতজুড়ে আজ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে লড়াই শুরু হয়েছে তা ‘বহুমাত্রিক’ সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এবং তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আজ শাহিনবাগকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটির বানিয়ে এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার যে পাঁয়তারা করছে, তাতে ভারতীয় জনগণ যদি আবারও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ফাঁদে পা দেয় তাহলে পশ্চিম বাংলার প্রয়াত নকশাল নেতা কমরেড আজিজুল হকের ‘ভেদবুদ্ধিমুক্ত ভারতের’ স্বপ্ন আবারও পর্যুদস্ত হবে। তারপরও দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ আশাবাদী।
রইসউদ্দিন আরিফ
লেখক ও গবেষক