ইতিহাসের পাতায় সংবাদপত্রে কৃষকের লড়াই

জাকির তালুকদার

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২০, ০২:১০ পিএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২১, ০১:০৩ পিএম

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন ১৮৭২ সালে। প্রথমে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। তারপর পুস্তিকা আকারে। কিন্তু কিছুকাল পরে তিনি নিজেই উপরোক্ত প্রবন্ধের বক্তব্য অস্বীকার করেন। সুদীর্ঘকাল প্রবন্ধটি তার কোনো গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়নি। প্রথম প্রকাশের প্রায় কুড়ি বছর পরে বঙ্কিমচন্দ্র এ প্রবন্ধটির পুনর্মুদ্রণ করেন একটি ভূমিকাসহ। পাঠক ও গবেষকদের জন্য ভূমিকাটি যথেষ্ট আগ্রহসঞ্চারি এবং কৌতূহলউদ্দীপক।

কেননা ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ এবং সমজাতীয় রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের যে শ্রেণিচরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, এই প্রবন্ধের পুনর্মুদ্রণের ভূমিকাংশটিতে তা আরও স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন- ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ এ দেশীয় কৃষকদিগের যে অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, তাহা আর নাই। জমিদারের আর সেরূপ অত্যাচার নাই। নতুন আইনে তাহাদের ক্ষমতাও কমিয়া গিয়াছে। 

কৃষকদিগের অবস্থা অনেক উন্নত হইয়াছে। অনেকস্থলে দেখা যায় প্রজাই অত্যাচারী জমিদার দুর্বল। এই সকল কারণে আমি এতদিন এই প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত করি নাই। এক্ষণে যে আমি পুনর্মুদ্রিত করিতেছি, তাহার অনেক কারণ আছে।

১. ইহাতে পঁচিশ বৎসর পূর্বে দেশের যে অবস্থা ছিল তাহা জানা যায়। ভবিষ্যৎ ইতিহাস বেত্তার ইহা কার্য্যে লাগিতে পারে।

২. ইহার পর হইতে কৃষকদিগের অবস্থা সমাজে আন্দোলিত হইতে লাগিল। এক্ষণে যে উন্নতি সাধিত হইয়াছে ইহাতে তাহার প্রথম সূত্রপাত, সুতরাং পুনর্মুদ্রিত হইবার এই প্রবন্ধ একটু দাবি দাওয়া রাখে।

৩. ইহাতে কৃষকদিগের যে অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, তাহা অনেক প্রদেশে অপরিবর্ত্তিতই আছে। যতগুলি উৎপাতের কথা আছে তাহা এখনও অনেক প্রদেশে অপরিবর্ত্তিতই আছে। যতগুলি উৎপাতের কথা আছে, তাহা সব কোন স্থানেই এখনও অন্তর্হিত হয় নাই।

৪. এ প্রবন্ধ যখন প্রকাশিত হয়, তখন কিছু যশোলাভ করিয়াছিল, এবং

৫. আমি ‘বঙ্গদর্শন’ এ সাম্য নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করিয়া পশ্চাৎ তাহা পুনর্মুদ্রিত করিয়াছিলাম। বঙ্গদেশের কৃষক আর পুনর্মুদ্রিত করিব না, বিবেচনায় তাহার কিয়দংশ ‘সাম্য’ মধ্যে প্রক্ষিপ্ত করিয়াছিলাম। এক্ষণে সেই ‘সাম্য’ শীর্ষক পুস্তিকাখানি বিলুপ্ত করিয়াছি। সুতরাং ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ পুনর্মুদ্রিত করার আর একটি কারণ হইয়াছে। 

উপরাক্ত ভূমিকালিপিতে বঙ্কিমচন্দ্র যেসব মন্তব্য করেছিলেন, বিশেষত কৃষক প্রজাদের সুদিন সম্পর্কে, তার সত্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি দীর্ঘদিন। যদিও বঙ্কিমকল্পিত প্রজা-

কৃষকদের সুখ-শান্তিতে বসবাস নিতান্তই নগরবাসী শিকড়চ্যুত মানুষের কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়; তবুও এ ব্যাপারে কেউ প্রতিবাদ জানাননি। প্রতিবাদ এসেছে। তবে তা কোনো নন্দিত বুদ্ধিজীবী বা সাহিত্যিক বা রাজনীতিবিদের কাছ থেকে নয়। এসেছে উত্তরবঙ্গের একজন মাঝারি কৃষক ও কৃষক-সংগঠক শ্রী মহছেনউল্লা সরকারের কাছ থেকে। সেই প্রতিবাদকেও ধারণ করেছে ‘মিহির ও সুধাকর’ নামে একটি পত্রিকা।

১৯০৭ সালে শ্রী মহছেনউল্লা সরকার ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কৃষক-প্রজার দুর্দশার যে প্রত্যক্ষচিত্র তুলে ধরেন, তার মাধ্যমে অনায়াসেই প্রমাণিত হয়ে যায় বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত দাবির অসারতাগুলি। বিশেষত ‘অনেক স্থলে এখন দেখা যায় ‘প্রজাই অত্যাচারী, জমিদার দুর্ব্বল’ জাতীয় মন্তব্য নিতান্তই হাস্যকর মনে হয়। ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় শ্রী মহছেনউল্লা সরকারের লেখা গদ্য ও পদ্যভাষ্যগুলি পরবর্তীতে ‘বুড়ীর সুতা’ নামের পুস্তিকায় রূপলাভ করে। সেই পুস্তিকা প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হবে পরবর্তীতে। তার আগে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধটির পুনঃপাঠ প্রয়োজন। 

কী আছে ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে

নিজেকে সর্বপ্রকারের ক্ষমতাশালীদের রোষানল থেকে আড়াল করে নির্যাতিতদের বিষয়ে শিরোনাম দিয়ে রচিত একটি প্রবন্ধ হলো- ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। নিজের গা বাঁচানোর এমন টেকনিক বঙ্কিমের পূর্বে আর কোনো বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আয়ত্তে ছিল বলে জানা যায় না। যে সময়ে বঙ্কিম ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ লেখেন, সেই সময় কৃষকের ওপর নির্যাতনকারী হিসাবে জমিদার-ভূস্বামী শ্রেণি এবং ইংরেজ শাসক ও তাদের শাসনরীতি ছিল প্রধান ভূমিকা পালনকারী।

কিন্তু প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র সুকৌশলে আড়াল করেছেন এদের সবাইকে। বিশেষত যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল সব কৃষক নির্যাতনের মূল পটভূমি, সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সব কুফল জানা সত্ত্বেও বঙ্কিম লেখেন- ‘১৭৯৩ সালে যে ভ্রম ঘটিয়াছিল এক্ষণে তাহার প্রতিকার সম্ভব না’। কারণ বঙ্কিম জানতেন যে, ‘সেই ভ্রান্তির ওপর আধুনিক বঙ্গসমাজ নির্মিত হইয়াছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাহারা এই ভারতম-লে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমন কুপরামর্শ আমরা ইংরেজদিগকে দিই না। যে দিন ইংরেজের অমঙ্গলাকাক্সক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাক্সক্ষী হইব, সেইদিন সে পরামর্শ দিব।’ 

অর্থাৎ কারণ তিনি চিহ্নিত করছেন বটে, কিন্তু সেই কারণ দূরীকরণের কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। কেননা তাতে নিজের ও নিজের শ্রেণির নিশ্চিত ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অভিশাপে এদেশের প্রাণভোমরা বাংলার কৃষি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেও সেই আইনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও উচ্চারণে নারাজ ছিলেন বঙ্কিম ও তার স্বশ্রেণির সুবিধাভোগীরা। এই শ্রেণির সুবিধাবাদী বৈশিষ্ট্যকে পরিষ্কারভাবে চিনিয়ে দিয়েছেন বিনয় ঘোষ। তার ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন-‘১৮৭২-৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারীর সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লক্ষের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারীর সংখ্যা পাঁচশ’র কিছু বেশি, বিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারী প্রায় ষোল হাজার এবং পঁচিশ একর ও তার কম ছোট জমিদারীর সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার পত্তানিদার জোতদারদের গোমস্থা নায়েব তহশিলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যদের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে উনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্বনীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রামসমাজে কমপক্ষে সাত-আট লক্ষ লোকের এমন একটা শ্রেণি (সামাজিক স্তরায়ন) তৈরি হয়েছে যে শ্রেণি ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভ স্বরূপ’। যারা নিজেরা ব্রিটিশ শাসনের স্তম্ভস্বরূপ, যারা ব্রিটিশ শোষণের দেশীয় সহযোগী তারা ব্রিটিশের বিরোধিতায় নামবে, এটা আশা করা অন্যায় শুধু নয় চরম বোকামিরও পরিচায়ক বটে।

তাই বঙ্কিমচন্দ্র নির্দ্বিধায় কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে নিজেদের জন্য সামাজিক মঙ্গল খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন এভাবে- ‘ইংরেজরা যে ভূমিতে স্বত্ব ত্যাগ করিয়া এ দেশীয় লোকদিগকে তাহাতে স্বত্ববান করিয়াছেন এবং করবৃদ্ধির অধিকার ত্যাগ করিয়াছেন, ইহা দুষ্য বিবেচনা করি না। তাহা ভালোই করিয়াছেন এবং ইহা সুবিবেচনার কাজ, ন্যায়সঙ্গত এবং সমাজের জন্য মঙ্গলজনক’। উল্লেখ্য বঙ্কিম-কথিত ‘এ দেশীয় লোক’ জমিদার। কৃষক নয়।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এভাবে শুধু লর্ড কর্ণওয়ালিস কিংবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণগানই করেননি বরং এই বন্দোবস্ত সৃষ্টির পেছনে ইংরেজদের মহৎ চিন্তাও খুঁজে বের করেছিলেন ‘জমীদারদিগের জমীদারীতে চিরস্থায়ী স্বত্ব নাই বলিয়াই জমীদারীতে তাহাদিগের যত্ন হইতেছে না। জমীদারীতে তাহাদের স্থায়ী অধিকার হইলে পর, তাহাদের যত্ন হইবে। সুতরাং তাহারা প্রজাপীড়ক না হইয়া প্রজাপালক হইবেন। এই ভাবিয়া তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃজন করিলেন। ধন্য চিন্তা!’

বঙ্কিমের এই উক্তি অনুসারে-

কৃষক-পীড়নের জন্য ইংরেজ দায়ী নয়! তাহলে দায়ী কে? জমিদার-জোতদার-মহাজন? বঙ্কিম এই শ্রেণিকেও তার প্রবন্ধে আড়াল করেছেন সুকৌশলে। তিনি বলেছেন, বটে যে ‘জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য; বাঙ্গালী কৃষকের শত্রু বাঙ্গালী ভূস্বামী’ কিন্তু পরক্ষণেই নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে শুধরে নিয়ে বলেছেন ‘আমরা জমীদারদের দ্বেষক নহি। কোন জমীদার কর্তৃক কখন আমাদিগের অনিষ্ট হয় নাই।

বরং অনেক জমীদারকে আমরা বিশেষ প্রশংসাভাজন মনে করি। যে সুহৃদগণের প্রীতি আমরা এ সংসারের প্রধান সুখের মধ্যে গণনা করি, তাহাদিগের মধ্যে অনেকে জমীদার। জমীদারেরা বাঙ্গালী জাতির চূড়া, কে না তাহাদিগের প্রীতিভাজন হইবার বাসনা করে? কিন্তু আমরা যাহা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, তাহাতে প্রীতিভাজন হওয়া দূরে থাকুক, যিনি আমাদের ভাল করিয়া না বুঝিবেন, হয়ত তাহার বিশেষ অপ্রীতিপাত্র হইব। তাহা হইলে আমরা বিশেষ দুঃখিত হইব’। যদিও প্রবন্ধে এক পর্যায়ে বঙ্কিমচন্দ্র স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, জমিদাররাই প্রধানত বাংলার কৃষকদের দুরবস্থার জন্য দায়ী, তারপরেও তিনি সুবিচার প্রার্থনা করেন সেই জমিদারদের কাছেই- ‘জমীদারদিগের কাছেই আমাদের নালিশ’।

কেননা বঙ্কিমচন্দ্রের মতে গুটিকয়েক জমিদার অত্যাচারী, অন্য সবাই নিষ্কলঙ্ক, প্রজাবৎসল। ‘যাহারা জমীদারদিগকে কেবল নিন্দা করেন, আমরা তাহাদিগের বিরোধী। জমীদারদের দ্বারা অনেক সৎকার্য্য অনুষ্ঠিত হইতেছে। গ্রামে গ্রামে যে এক্ষণে বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইতেছে, আপামর সাধারণ সকলেই যে আপন আপন গ্রামে বসিয়া বিদ্যোপার্জ্জন করিতেছে, ইহা জমীদারদিগের গুণে। জমীদারেরা অনেক স্থানে চিকিৎসালয়, রথ্যা, অতিথিশালা ইত্যাদির সৃজন করিয়া সাধারণের উপকার করিতেছেন। আমাদিগের দেশের লোকের জন্য যে ভিন্ন জাতীয় রাজপুরুষদিগের সমুক্ষে দুটো কথা বলে, সে কেবল জমীদারদের ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন জমীদারদের সমাজ। তদ্বারা দেশের যে মঙ্গল সিদ্ধ হইতেছে, তাহা অন্য কোন সম্প্রদায় হইতে হইতেছে না বা হইবারও সম্ভাবনা দেখা যায় না। অতএব জমীদারদিগের কেবল নিন্দা করা অতি অন্যায়পরতার কাজ।’

‘এই অন্যায় কাজ বঙ্কিমচন্দ্র করতে পারেন না। করেনওনি। ফলে কৃষকদরদীর ধাঁচে শুরু হওয়া রচনাটি আদতে সর্বাংশে পরিণত হয়েছে জমিদারদের পক্ষের, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষের এবং ইংরেজদের পক্ষের সাফাই ও নির্লজ্জ স্তুতিতে। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে যে, শিব গড়তে বাঁদর নয়, বরং বঙ্কিমের প্রথম থেকেই সুচতুর লক্ষ্য ছিল বাঁদর গড়াই। সত্যি বটে, এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র কৃষক দুর্দশার কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন। তবে সেগুলোর কোনোটিই তার নিজস্ব অনুসন্ধান ও সাংবাদিকতার ফসল নয়।

বরং এইসব সংবাদ ততদিনে ‘অবজারভার’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ প্রভৃতি পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে ছাপা হচ্ছিল। সমাজের বিভিন্ন স্তরে কৃষকের দুর্দশা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্কিমচন্দ্রকে লিখতে হয়েছিল ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। সেই প্রবন্ধকেও পরবর্তীকালে অস্বীকার করেন বঙ্কিম। প্রায় পঁচিশ বছর পরে পুনর্মুদ্রণ করেন বটে, তবে তার সঙ্গে জুড়ে দেন মিথ্যা ও অবাস্তব একটি ভূমিকা- ‘অনেক স্থলে এখন দেখা যায়, প্রজাই অত্যাচারী, জমিদার দুর্ব্বল’।

প্রতিবাদ এলো কৃষক সমাজ থেকেই

কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ আসেনি বঙ্কিমের এই প্রবন্ধের বা তার অবাস্তব মন্তব্যের বিপক্ষে। আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ সচরাচর করে থাকেন বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু তৎকালীন কোনো বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদে এগিয়ে আসেননি। এগিয়ে আসেননি কোনো প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-সমাজকর্মী-রাজনৈতিক কর্মী। এগিয়ে এসেছিলেন উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কৃষক। শ্রী মহছেনউল্লা সরকার। ১৩১৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ‘গুণু প্রামাণিকের আবেদন’ শিরোনামে বাংলার কৃষক-সমাজের দুর্দশার এক মর্মস্পর্শী চিত্র। এই একটি রচনাই কলকাতাবাসী তৎকালীন বৃদ্ধিজীবী সমাজের সমস্ত কুটচাল ও জমিদারতোষণের নামে মিথ্যা রচনাগুলির অসারতা প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট। 

শ্রী মহছেনউল্লা সরকারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা অজ পাড়াগাঁয়ে। ১২৬৮ সালে নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার কাটাশকোল গ্রামে জন্ম তার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তৎকালীন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি ছোট কৃষক পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন। পিতা-মাতার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে জজ, কিংবা নিদেনপক্ষে উকিল-মোক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। তবে ওই দুই বছর স্কুলে যাবার বিদ্যা সম্বল করেও তিনি চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন ইংরেজদের পুলিশ বিভাগে। সেই চাকরিতে অবশ্য পুরো একটা বছরও টিকতে পারেননি। চাকরি করতে দেয়নি তার বিবেক। মূলত কৃষকদের ধরে এনে হাজতে ভরে পিটিয়ে দোষ স্বীকার করানোর দায়িত্ব ছিল তার মতো পুলিশ-সিপাইদের। এই প্রক্রিয়া তার সহ্য হয়নি। চাকরি ছেড়ে এবং অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা না করে লেগে যান কৃষিকাজে। সেই সঙ্গে গড়ে তুলেন কৃষকদের নিয়ে সংগঠন ‘নাটোর মহকুমা কৃষক সম্মীলনী’।

কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, তাদের সন্তানদের লেখা-পড়া শেখানো এবং কৃষকদের পক্ষে আইনি লড়াই ছিল কৃষক সম্মীলনীর মূল কাজ। আইন শেখার জন্য কিছুদিন একজন মোক্তারের অধীনে মুহুরিগিরি করেছেন। এই কৃষক সংগঠন করতে গিয়েই তার লেখালেখির শুরু। অমরত্বের আশায় সাহিত্য-চর্চা নয়; নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদে লেখালেখি করা। এসব প্রয়োজনেই একের পর এক লিখিত হয়েছিল ‘বুড়ীর সুতা’, ‘গুণু প্রামাণিকের আবেদন’, ‘গুদাম’, ‘ছিন্ন খেই’, ‘ফসকা গেরো’ প্রভৃতি রচনা। সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বিধায় এই রচনাগুলিকে একত্রিত করে নাটোর কৃষক সম্মীলনী প্রকাশ করে ‘বুড়ীর সুতা’ শিরোনামে তার একমাত্র পুস্তিকা। ১৩৩০ সালে প্রকাশিত এই পুস্তিকাই কৃষকের সমস্যা নিয়ে কৃষক রচিত ও মুদ্রিত প্রথম বাংলা গ্রন্থ।

শ্রীমহছেনউল্লা সরকার কখনো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের 

কৃষক’ পাঠ করেছিলেন কি না জানা যায়নি। তার ‘বুড়ীর সুতা’য় সাহিত্যগুণ কিছুটা থাকলেও এটি মূলত বিবৃতিধর্মী রচনা। তবে নিজ সম্প্রদায়ের দুর্দশা প্রসঙ্গে লিখিত বলে তা অসম্ভব আবেগ ও আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। গুণু প্রামাণিকের আবেদন নিবেদিত হয়েছে ‘পূর্ব্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের শ্রীল শ্রীযুক্ত ছোট লাট বাহাদুর সমীপে’। রচনার শুরুতেই মহছেনউল্লা সরকার নিজেকে ও পূর্ববঙ্গের 

কৃষক সম্প্রদায়কে অত্যাচারে জর্জরিত ক্রীতদাস হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন এভাবে- ‘এই দেশে পূর্ব্বে দাসত্ব-প্রথা প্রচলিত ছিল, ইংরেজের আমলে তাহা উঠিয়া গিয়াছে এই কথা যিনি বিশ্বাস করিতে চাহেন, পূর্ব্ব বাঙ্গালার কৃষকের অবস্থাটা তাহাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে অনুরোধ করি। ইংরেজ রাজ নামেমাত্র কাগজপত্রে উহা উঠাইয়া দিয়াছেন সত্য কিন্তু ফলে তাহা ঘটে নাই। বিশেষতঃ পূর্ব্ব বাঙ্গালার জমীদার কর্তৃক যে প্রকার ব্যবহৃত হইতেছে তাহার চাইতে সম্ভবতঃ পূর্ব্বকালীন দাসত্ব প্রথা ভাল। সেই দাসত্ব সম্প্রদায়গত ভাবে এরূপ প্রবল ছিল না এবং দাস ছাড়া অন্য কাহাকেও দাসত্ব করিতে হইত না, অথবা দাস ব্যতীত দাসের আত্মীয়বর্গকে বা একজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে দাসত্ব করিতে হইত না।’ 

শ্রী মহছেনউল্লা সরকার জানাচ্ছেন যে, জমিদাররা বিভিন্ন উপলক্ষে কৃষক-প্রজাদের ওপর অন্যায় কর বা খাজনার বোঝা চাপিয়ে দেয়। যেহেতু জমিদারের আদেশই আইন, জমিদারের অত্যাচারের হাত আদিগন্ত বিস্তৃৃত, তার বিপক্ষে দাঁড়ানো মানে জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা, তাই কৃষক বাধ্য হয় মুখ বুঁজে সবকিছু সহ্য করতে। তার ভাষায়- ‘কৃষি প্রজাগণকে তাহাদের ওয়ারিশের নামীয় জোত বা খরিদা জোত নিজ নামে জারী করিয়া লইতেও জমিদারকে জমার ২০/২৫ গুণ পর্যন্ত টাকা নজর দিতে, উত্তরোত্তর জমীদারকে জমাবৃদ্ধি, মইমবৃদ্ধি নিরিখ বৃদ্ধি করিয়া দিতে, নিজ নিজ স্বত্ব বিনা কারণে ত্যাগ করিয়া জমিদারকে কবুলিয়ত রেজিষ্টারি করিয়া দিতে ও ভিক্ষা খরচা, গ্রাম খরচা, আমলাগণের বেতন প্রভৃতি নানাবিধ কাজে কর ধরিয়া দিতে হয়।’ 

এই আদায় যেসব বীভৎস প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়, তার চিত্র তুলে ধরছেন তিনি এভাবে- ‘আজি এই দুর্ভিক্ষের দিনেও জমার প্রত্যেক টাকায় আট আনা পর্যন্ত হিসাবে ভিক্ষা আদায় করিয়া লইবার জন্য, বঙ্গীয় কৃষকের ঘরে ঘরে জমিদারের পেয়াদা লাঠী হাতে দাঁড়াইয়া থাকিয়া র্স্পধার সহিত কত কত অশ্লীল গালি উচ্চারণ করিতেছে। ঐ দেখ কেমন করিয়া কুঁড়েঘরের বেড়ায় লাঠির আঘাত করিয়া ও নানা প্রকার ভ্রুকুটির সহিত অন্দরের দিকে উঁকি মারিয়া কৃষক রমণীকে ভয় দেখাইতেছে, ভিক্ষার চাঁদা সংগ্রহ করিতে না পারিয়া কৃষক কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহার মাতা ও পুত্র-কন্যাগণ ক্ষুধার জ্বালায় গড়াগড়ি যাইতেছে, গৃহিনী ঘোমটা টানিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়া সভয়ে কৃষক জীবনের মহত্ব অনুভব করিতেছে।’

সেই সময়ে বাঙালি কৃষক নিজের কষ্ট, নিজের হারানোর বেদনা নিয়ে কারও দরজায় দাঁড়াতে পারে নাই। কারণ তার জন্য কোনো দরজাই খোলা ছিল না। জমিদার-রাজা-মহাজন-ইংরেজ সবাই কৃষকের দেহে শুঁড় বিস্তার করে অক্টোপাসের মতো তার রক্ত চুষে খেয়েছে। মহছেনউল্লা সরকার এজন্য ইংরেজ ও তার প্রণীত আইনকে দায়ী করেছেন- ‘বাঙ্গালী কৃষকের চক্ষু আছে দেখিতে পায় না, কর্ণ আছে শুনিতে পায় না, প্রাণ আছে স্বার্থজ্ঞান নাই, রক্ত মাংস আছে বেদনা বোধ নাই, জিহবা আছে কথা বলিতে বা উঃ আঃ করিতে জানে না; সেইজন্যই তোমার আইন হইয়াছে উপন্যাস, বিচারালয় হইয়াছে বটতলা, বিচারক হইয়াছেন উদাসীন, মন্ত্রী হইয়াছেন কল্পতরু, রাজা হইয়াছেন জগৎগুরু।’

কৃষকের ওপরে জমিদারের অত্যাচার বহুমাত্রিক ছিল। স্বাভাবিক ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতিপালন পর্যন্ত জমিদারের আজ্ঞাধীন ব্যাপার ছিল। বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক মুসলমান, অন্যদিকে প্রায় সব জমিদার হিন্দু ছিলেন। তাদের জমিদারি এলাকায় গরু কোরবানী নিষিদ্ধ ছিল। এই ব্যাপারটি সবসময়েই অন্তর্দাহে জর্জরিত করে মুসলমান কৃষক প্রজাদেরকে। তারই ফলশ্রুতিতে কখনো কখনো গোমাংস ভক্ষণকে কেন্দ্র করে অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয় মুসলমান প্রজাদের। এই ব্যাপারটিও উঠে এসেছে মহছেনউল্লা সরকারের লেখায়- ‘জেলা রাজসাহী, মহকুমা নাটোর, থানা বড়াইগ্রামের অধীনে কৈডিমি গ্রামের চতী হাজী গোমাংস খাইয়াছিল। তাই প্রবলের দ্বারা কয়েদ হইল, মাথায় অত্যাচারীর জুতার আঘাত পড়িল, কপালে দাগ হইল, জরিমানা দিতে বাধ্য হইল। পবিত্র মক্কার মসজিদে ঐ খাস তখতে যে মাথা সেজদায় যাইতে পাইয়াছিল, ঐ পবিত্র মাথায় অত্যাচারীর জুতার আঘাত হইল।’

বাংলার কুটির শিল্প ততদিনে ধ্বংস হয়ে গেছে। মুষ্টিমেয় কিছু মধ্যস্বত্বভোগী বাদ দিলে কৃষি ছাড়া অন্য কোনো জীবিকা মানুষের ছিল না। শুধু কৃষির উপর, কৃষকের উপর নির্ভর করে সব মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। মহছেনউল্লা সরকার সেখানেও শোষণের চিত্র, খুব পরিষ্কারভাবে না হলেও, ধরতে পারেন- ‘বাঙ্গালী কৃষকের শরীর আছে শরীরে বল আছে খাটিতে পারে। সত্য কথা বলিতে হইলে বলিতে হয়, বঙ্গদেশের কৃষক ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তি ভিন্ন দেশ হইতে একটি পয়সাও উপার্জ্জন করিয়া আনিতে পারেন না। অতি প্রখর রৌদ্র তাপে রক্ত মাংসের শরীরকে গলিয়া পুড়িয়া যাইতে দিয়া, মশা মাছি কীট পতঙ্গকে আপন শরীর উৎসর্গ করিয়া দিয়া, হতভাগা বাঙ্গালী কৃষক যে এত সোনার টাকা রোজগার করে, তাহা কি হয়?’

জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ-আমলা যেমন, তেমন ব্রিটিশ নিয়োজিত কর্মচারি, আইনের ফাঁক, আদালতের প্রক্রিয়া সবকিছুই জমিদার-জোতদারের সহযোগী ছিল। কোনো কৃষক অত্যাচারিত হয়ে সুবিচারের আশায় আইনের আশ্রয় নিতে গেলে সেখানেও দেখতে পায় সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে জমিদারের পক্ষে। ‘অপরাধ না করিয়াও বাঙ্গালী কৃষককে কোনও হেতুতে অপরাধ করা স্বীকার করিতে বাধ্য করিবার ও পুত্রের বিরুদ্ধে পিতাকে, স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করিবার কোনও প্রবল শক্তি বাঙ্গালী উপর নিয়ত প্রভুত্ব করিতেছে।’

এভাবে ধাপে ধাপে বাঙালি কৃষকের শত্রুর মুখোশ উন্মোচন করতে করতে, তাদেরকে একে একে শনাক্ত করতে করতে মহছেনউল্লা সরকার পৌঁছে যান সর্বোচ্চ ধাপে। সেখানে পাওয়া যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশিক শাসন-শোষণকে। এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে তিনি ইংরেজকে উদ্দেশ্য করে বলতে পারেন- ‘এ দেশ তোমার নহে, ইহাতে তোমার প্রভুত্ব খাটিবে না। তুমি ব্যবসাদার, প্রজা পালন করা তোমার কার্য্য নহে।’

শেষ পর্যন্ত যেতে হয় শ্রেণিবিচারের কাছে

অনেকের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র ঋষি। অনেকের কাছে ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ। কারও কারও কাছে তিনি হচ্ছেন, ভারতবর্ষে স্বাদেশীকতার উদ্বোধক। কিন্তু যারা গুণমুগ্ধ ভক্ত, তারা অনেকেই বঙ্কিমের অনুদার, সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎমুখি কার্যকলাপগুলোর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেননি। পারার কথাও নয়। কেননা একমাত্র শ্রেণিদ্বন্দ্বের আলোকেই ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া সম্ভব। শ্রেণিস্বার্থই বঙ্কিমকে বাংলাদেশের কৃষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে।

তবে তা সত্ত্বেও বঙ্কিমের কাছে বাংলা গদ্য তথা বাংলা সাহিত্যের যে ঋণ, তা কিছুমাত্র কমে না।

পরিশিষ্ট

বুড়ীর সুতা!

পূর্ব্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মহামান্য শ্রীল শ্রীযুক্ত ছোট লাট সাহেব বাহাদুর সমিপে-

গুণু প্রামানিকের আবেদন।

সসম্ভ্রমে কৃতাঞ্জলীপুটে নিবেদন এই যে-

আমি পূর্ব্ব বাঙ্গালার দরিদ্র কৃষক; লাট সাহেব বাহাদুরকে কিরূপে সম্মান করিতে হয়, তাহা আমি জানি না। ভরসা করি, আমার লাট সাহেব বাহাদুর তাহার নিজ মাহাত্ম্য গুণে, ইহাতে আমার যথোচিত ভক্তি ও তাহার যথাযোগ্য সম্মান প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য করিয়া লইবেন। আমাকে সকল প্রকারে আক্কেল দিবার কর্ত্তা ইংরেজ। তিনি আমাকে যে প্রকার আক্কেল দিয়াছেন আমার লাট সাহেব বাহাদুরকে এই পত্রখানি লিখিতে আমি সেই প্রকার আক্কেল ব্যবহার করিব ভিন্ন 

উৎকৃষ্টতর আক্কেল কোথায় পাইব?

এই দেশে পূর্ব্বে দাসত্ব-প্রথা প্রচলিত ছিল, ইংরেজের আমলে তাহা উঠিয়া গিয়াছে- এই কথা যিনি বিশ্বাস করিতে চাহেন, পূর্ব্ব বাঙ্গালার কৃষকের অবস্থাটা তাহাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে অনুরোধ করি। ইংরেজ-রাজ নামে মাত্র কাগজে পত্রে উহা উঠাইয়া দিয়াছেন সত্য কিন্তু ফলে তাহা ঘটে নাই। বিশেষতঃ পূর্ব্ব বাঙ্গালার কৃষকগণ জমিদার কর্ত্তৃক যে প্রকার ব্যবহৃত হইতেছে তাহার চেয়ে সম্ভবতঃ পূর্ব্ব কালীন দাসত্ব-প্রথা ভাল ছিল। সেই দাসত্ব সম্প্রদায়গত ভাবে এরূপ প্রবল ছিল না এবং দাস ছাড়া অন্য কাহাকেও দাসত্ব করিতে হইত না, অথবা দাস ব্যতীত দাসের আত্মীয় বর্গকে বা একজনের জন্য দেশ শুদ্ধ লোককে দাসত্ব করিতে হইত না।

পূর্ব্ব বাঙ্গালার কৃষকের নিকট হইতে জমিদার খাজনা আদায় করিয়া লইয়া তাহার যে সামান্য অংশ গবর্ণমেন্টকে দিয়া থাকেন, পশ্চিম-বঙ্গের জমিদার সেই পরিমাণ সামান্য অংশ গবর্ণমেন্টকে দিয়া নিস্কৃতি পাইতে পারেন কি?

কৃষি প্রজাগণকে তাহাদের ওয়ারিশের নামীয় জোত বা খরিদা জোত নিজ নামে জারী করিয়া লইতে ও তদুপলক্ষে জমিদারকে জমার ২০/২৫ গুণ পর্য্যন্ত টাকা নজর দিতে,উত্তরোত্তর জমিদারকে জমাবৃদ্ধি, মইমবৃদ্ধি ও নিরিখ বৃদ্ধি ধরিয়া দিতে, নিজ নিজ স্বত্ত্ব বিনা কারণে ত্যাগ করিয়া, জমিদারকে কবুলিয়াত রেজিষ্টারী করিয়া দিতে ও ভিক্ষা খরচা, গ্রাম খরচা, আমলাগণের বেতন প্রভৃতি নানাবিধ বাজে কর ধরিয়া দিতে যে প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করিতে দেখা যায়, পশ্চিম বঙ্গের প্রজাকে তদনুরূপ দেখা যায় কি?

পশ্চিম বঙ্গের প্রজা গবর্ণমেন্টের দরবারে যে প্রকার সুবিচার লাভ করিতে পারে, পূর্ব্ব বঙ্গের প্রজা তদনুরূপভাবে গবর্ণমেন্টের বিচার পাইতে পারে কি?

এই সকল ও এবম্বিধ বহু প্রবল কারণ দর্শন করিয়া লর্ড কার্জ্জন বাহাদুর পূর্ব্ব-বঙ্গ ভূমি ও পশ্চিম বঙ্গ-ভূমিকে পৃথক অবস্থার রাজ্য বা পশ্চিম বঙ্গ ইংরেজের রাজ্য ও পূর্ব্ব বঙ্গ জমিদারের রাজ্য ইহা সুস্পষ্ট রূপে দর্শন করিয়াছিলেন এবং ইহাই যে বঙ্গ বিচ্ছেদের একটি প্রধান কারণ হইয়াছিল, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই এবং ইহাতে জমিদারের যথেচ্ছাচার শক্তির ক্ষয় হইবার আশংকার, জমিদারগণ দ্বারা যে এই রাজ্য-ব্যাপী বিকৃত স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে, ও হিন্দু মুসলমানে এই সর্ব্বনাশকর বিবাদ উপস্থিত লইয়া শত শত ব্যক্তিকে জেলে যাইতে ও প্রাণ হারাইতে হইতেছে তাহার সন্দেহ নাই।

হে আমার লাট সাহেব বাহাদুর! তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখ, তোমার ম্যাজিষ্ট্রেট, কালেক্টার, পুলিশ, প্রভৃতির কোনও রিপোর্টে, জমিদারের বা ব্যবসায়ীদিগের কোনও কাগজে, খবরের কাগজ সমূহে কখনও কৃষকের প্রকৃত অবস্থার কথা শুনিতে পাও কি? যদি শুনিয়া থাক তবে শুনিয়াছ যে কৃষকেরা পাটে ভেজাল দেয়, পাটের চাষ বৃদ্ধি হওয়াতে ধান্যের দর চড়িয়াছে ও তাহাতেই দেশ-ব্যাপী দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইয়া ইংরেজ রাজ্য ধ্বংশ হইতে বসিয়াছে; বাঙ্গালার রফ্তানী ফসলের মূল্য বৃদ্ধি হওয়াতে, ইংরেজ প্রজার সর্ব্বনাশ হইতেছে; আর যদি দেখিয়া থাক, তবে দেখিয়াছ যে, কৃষকগণ অত্যাধিক অপরাধ করিতেছে ও তোমার সুশাসকগণের সাধুতায় আত্মগোপন করিতে না পারিয়া অপরাধ স্বীকার করিয়া ফেলিতেছে ও জেলখানা একচেটিয়া করিয়া লইয়াছে; আর কৃষকের মঙ্গলের জন্য যদি কাহাকেও চেষ্টা করিতে দেখিয়া থাক, তবে দেখিয়াছ যে, ফসলের রফ্তানী বন্ধ করিবার জন্য চারিদিকে সভা সমিতি হইতেছে।

অপরাধ না করিয়াও বাঙ্গালী কৃষককে কোনও হেতুতে অপরাধ করা স্বীকার করিতে বাধ্য করিবার ও পুত্রের বিরুদ্ধে পিতাকে, স্বামীর বিরূদ্ধে স্ত্রীকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করিবার কোনও প্রবল শক্তি বাঙ্গালী কৃষকের উপরে নিয়ত প্রভুত্ব করিতেছে, এ কথা গবর্ণমেন্ট বিশ্বাস করিতে চাহেন কি?

যাঁহাদের নিকট হইতে রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা জানিবার জন্য আশা করিতে চাহ, তাহারা তোমার নিমকখোর হইলেও নিজের মান সম্ভ্রম, জান প্রাণ, জাতি ইজ্জ্বত ও চাকুরী আদি লইয়া তাহাদিগকে জমিদারের রাজ্যে বাস করিতে হয়। তোমার প্রত্যেক নিমকখোরের জানা আছে যে, কেহ যদি এক বার কোনও এক জমিদারের অপ্রিয় হইয়া উঠে তবে অধিক দিন তাহাকে চাকুরী করিতে হয় না। তাহাকে তৎকালে তোমার অনুগ্রহে কুলাইয়া উঠিতে পারে না, তোমার আইনের বল দুর্ব্বল হয়, তোমার তরবারীর মুখে ধার থাকে না, তোমার কামান নিস্কর্ম্ম হয়, বিচারক অন্ধ হইয়া যায়। তোমার সিংহাসন তোমার কেল্লা তাহাতে কামান ও সেনা সামন্ত তোমার আইন, তোমার বিচারালয় বর্ত্তমান থাকিতেই হে আমার লাট সাহেব বাহাদুর! জমিদারের অপ্রিয় তোমার রাজ কর্ম্মচারীকে তোমারই বিচারকের হুকুমে, তোমারই কারাগারে যাইয়া ঘানি টানিয়া, শস্য ভাঙ্গিয়া, তোমাকেই তৈল বাহির করিয়া দিতে হয়। যে ইংরেজ রাজ-কর্ম্মচারীর চাকুরীর আবশ্যক আছে, প্রাণের আবশ্যক আছে, জাতি ইজ্জতের ও পরিবারের আবশ্যক আছে, তাহার নিকট হইতে পূর্ব্ব বাঙ্গালার জমিদারের বিরূদ্ধে কোন কথা পাইবার আশা করা তোমার বিড়ম্বনা মাত্র। 

হে আমার লাট সাহেব বাহাদুর! তুমি কি স্বীকার করিতে চাও যে ভারতব্যাপী বিকৃত স্বদেশী আন্দোলনে ভাঙ্গা বাঙ্গালা জোড়া দিবার ও পূর্ব্ব-বঙ্গ গবর্ণমেন্টের সিংহাসন উৎপাদন করিবার চেষ্টাতে, ঐ সিংহাসনের লাট সাহেব বাহাদুরকে অভিনন্দনে বাধা দিবার উদ্যোগে ভারতে স্বরাজ স্থাপনে, উদয় পাটনীর ফাঁসীর আন্দোলনে, ফুলার বাহাদুরের পদত্যাগ ঘটিত আনন্দ উৎসবে, স্বদেশী আন্দোলনের সপক্ষে চেষ্টা করিবার জন্য বিলাত পর্যন্ত প্রতিনিধি প্রেরণে বিলাতের পার্লেমেন্টে নানাবিধ প্রশ্ন উখাপনে, বাঙ্গালী কৃষকের কোনো সংশ্রব আছে? বাঙ্গালী কৃষকের শরীর আছে- শরীরে বল আছে খাটিতে পারে। সত্য কথা বলিতে হইলে বলিতে হয়, বঙ্গদেশের কৃষক ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তি ভিন্ন দেশ হইতে একটি পয়সাও উপার্জ্জন করিয়া আনিতে পারে না। 

অতি প্রখর রৌদ্র তাপে রক্ত মাংসের শরীরকে গলিয়া পুড়িয়া যাইতে দিয়া, মশা মাছি, কীট পতঙ্গকে আপন শরীর উৎসর্গ করিয়া দিয়া, হতভাগা বাঙ্গালী কৃষক যে এত এত সোনার টাকা রোজগার করে, তাহা কি হয়?

হে আমার লাট সাহেব বাহাদুর! তুমি বলিতে চাও কি যে, বাঙ্গালী কৃষকের চক্ষু আছে দেখিতে পায় না, কর্ণ আছে শুনিতে পায় না, প্রাণ আছে স্বার্থ জ্ঞান নাই, রক্ত মাংস আছে বেদনা বোধ নাই, জিহবা আছে কথা কহিতে বা উঃ আঃ করিতে জানে না; সেই জন্যই তোমার আইন হইয়াছে উপন্যাস, বিচারালয় হইয়াছে বটতলা, বিচারক হইয়াছেন উদাসীন, মন্ত্রী হইয়াছেন কল্পতরু, রাজা হইয়াছেন জগৎ গুরু আর এই সুবিচার দেখিয়া অন্তর্জগত আনন্দে বিভোর হইয়া হাত তালি দিয়া নাচিতেছে আর গাইতেছে “হরিবল হরিবল হরিবল”। তুমি রাজা হইয়াছ, তোমার অষ্ট চক্ষু থাকিবে, সহস্র কর্ণ থাকিবে, প্রবল পরাক্রম থাকিবে, দুষ্টের দমন করিবে, প্রজার পালন করিবে। তোমার কাছে নালিশ করিতে না পারিলেই, তোমার আদালতে প্রমাণ করিতে না পারিলেই, তোমাকে কি নাকে কানে তুলা গুঁজিয়া এই বলিয়া নিশ্চিন্ত 

থাকিতে হইবে যে, তোমার রাজ্যে পূর্ণ শান্তি বিরাজিত আছে?

আমি জোর করিয়া বলিব এই ঐন্দ্রজালিক বঙ্গ রাজ্যে তোমার আইন আদৌ কোন কার্য্যকারী নহে। জগৎকে দেখাইতে হয় বলিয়া শিলং-এ তোমার সিংহাসন, কলিকাতার রাজধানী, কেল্লায় কামান ও ফৌজ রাখিয়া বিচারককে উচ্চ আসনে বসাইয়া পুলিশকে নানা রঙ্গে রঞ্জিত করিয়া আইন নামক কতকগুলি উপন্যাস লিখিয়া রাখিয়া, বৃটীশ রাজ্যের উত্তম সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করা হইতেছে মাত্র। তোমার চরিত্র দেখিয়া তোমাকে বলিতে পারি না তুমি শক্তের ভক্ত নরমের কাল! তোমার চরিত্র অনেকেই টের পাইয়াছে। তাই অনেকেই তোমাকে বিভীষিকা দেখাইয়া স্বর্ত্ত করিয়া লইতেছে। কেবল ঘুমাইয়া আছে বঙ্গীয় কৃষক। এই ঘুমন্ত কৃষকের নিদ্রাভঙ্গ হইলে জাগিয়া উঠিয়া যেদিন তোমাকে ধরিয়া ফেলিবে, হে আমার লাট সাহেব বাহাদুর! এখন তুমি শক্তকে পূজা করিতে থাকিলে কৃষকের ন্যায্য স্বত্ত তাহাকে বুঝ করিয়া দিতে পারিবে না। মনে রাখিও বঙ্গীয় কৃষকের নিকটে তুমিও সভ্য জগৎ নানা কারণে ঋণী আছ।

উদোর পিন্ডী বুধোর ঘাড়ে চাপাইয়া নরমের আট পিট লইয়া, গরমের ভান্ডা পূর্ণ করিয়া দিয়া হে আমার সুচতুর চুড়ামণি! এমন করিয়া এ রাজ্য আর কতদিন চালাইবে? কৌশল ছাড়া তোমার শরীরে কি সামর্থ নাই? যে ব্যক্তি নরম হইবে তোমাকে সর্ব্বময় কর্তা জ্ঞান করিয়া, তোমার অনুগ্রহ পাইবার আশায়, তোমার মুখের দিকে তাকাইয়া ভক্তির উদ্বেগে কথা বলিতে না পারিয়া কেবল অশ্রু বিসর্জ্জণ করিবে, তুমি তাহাকে দেখিবে না! তার মর্ম্মবেদনা বুঝিবে না! তোমার আইন আদালত তাহার বিচার করিবে না!!! ইহাই ত তোমার রাজ্যের বড় আইন। তোমার আইন আদালত দেখিয়াছি, তোমার চতুরতা দেখিয়াছি, আর বুঝিয়াছি তুমি ব্যবসায়দারের দেশের লোক, ব্যবসায় করিতে আসিয়াছ, প্রজাপালন তোমার কার্য্য নহে।

আমার এই নিরেট সত্য অতি কর্কশ কথা বিশ্বাস করিতে যদ্যপি কাহারও প্রবৃত্তি না হয়, তবে তাহাকে চক্ষু খুলিয়া, বঙ্গীয় কৃষকের অবস্থাটা দেখিতে বলি। যদ্যপি চক্ষু থাকে চক্ষে মণি থাকে, তাহাতে দর্শন শক্তি থাকে, তবে ঐ দেখ, আজি এই দুর্ভিক্ষের দিনেও জমায় প্রত্যেক টাকায় আটআনা পর্য্যন্ত হিসাবে ভিক্ষা আদায় করিয়া লইবার জন্য, বঙ্গীয় কৃষকের ঘরে ঘরে জমিদারের পেয়াদা লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া থাকিয়া স্পর্দ্ধার সহিত কত কত অশ্লীল গালি উচ্চারণ করিতেছে। ঐ দেখ কেমন করিয়া কুঁড়ে ঘরের বেড়ায় লাঠির আঘাত করিয়া ও নানা প্রকার ভ্রুকুটীর সহিত অন্দরের দিকে উকি মারিয়া কৃষক রমণীকে ভয় দেখাইতেছে। ভিক্ষার চাঁদা সংগ্রহ করিতে না পারিয়া কৃষক কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহার মাতা ও পুত্র কন্যাগণ ক্ষুধার জ্বালায় গড়াগড়ি যাইতেছে, গৃহিনী ঘোমটা টানিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়া সভয়ে 

কৃষক জীবনের মহত্ব অনুভব করিতেছে।

আরও দেখিবে? ঐ দেখ কৃষকগণ উৎপাতে অস্থির হইয়া শান্তির আশায় তোমার আদালতে দরখাস্ত দিতেছে, জমিদার তাহা জানিতে পাইয়া দরখাস্তকারী কৃষককে ধরিয়া লইয়া যাইয়া দরখাস্ত উইড্র করাইয়া লইতেছে ও খেসারতসহ ভিক্ষার টাকা আদায় করিয়া লইতেছে। তোমার আদালতে দরখাস্ত হইল, তাহা উইড্র হইলে, ফাইল ক্লিয়ার হইল বছ! তোমার কর্ত্তব্য ফুরাইল। এখন জিজ্ঞাসা করিতে পারি না? কোন আইনের কোন বলে এখন তুমি কোন বিচারটা করিয়া উঠিবে বল দেখি?

মুসলমান জমিদারের এলাকায় গরু কোরবানী হইয়াছিল 

কৃষক লোভ সম্বরণ করিতে না পারিয়া ঐ মাংস হিন্দু জমিদারের এলাকায় আনিয়া খাইল, জমিদার তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া জরিমানা করিল, জুলুম করিল। জানে প্রাণে আর কুলায় না দেখিয়া সকল আদালত ছাড়িয়া তোমার সিংহাসনে দরখাস্ত করিল। তুমিত তোমার ডেপুটীর প্রতি তদন্তের ভার দিলে ডেপুটী। প্রমাণ উপস্থিত করিবার জন্য দিন ধার্য্য করিয়া সমন দিল। দরখাস্তকারী প্রমাণসহ তোমার ডেপুটীর এজলাসে হাজির হইয়া দরখাস্ত দিয়া জানাইল যে, ‘জমিদার আমাকে ও আমার সাক্ষীগণকে বাধ্য করিয়া লইয়া যাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে, সুতরাং দয়া করিয়া, অদ্যই আমাদিগের জবান বন্দী গ্রহণ করিতে আজ্ঞা হয়’। ফল কথা যে সেদিন আর কাহারও জবানবন্দী গ্রহণ করা হইল না। দরখাস্তকারী ও তাহার সাক্ষীগণকে জমিদারের এলাকার মধ্যেই বাস করিতে হইল। পরদিন দরখাস্ত দিয়া জানাইল যে, জমিদারের সহিত তাহার আপোশে নিস্পত্তি হইয়া গিয়াছে। বছ, আর কথা কি তোমার আদলতের ফাইল ক্লিয়ার হইল। 

কৃষকগণ জমিদারকে যে, কবুলিয়ত রেজিষ্টারী করিয়া দিয়াছে, তাহার মোসাবিদাটা একবার পাঠ করিয়া দেখিতে চাও কি? তোমার আইনের বলে কৃষক জমিতে কৃষকের যে স্বত্ব জন্মিয়া ছিল, কৃষক ইচ্ছা করিয়া কেন তাহা ত্যাগ করত জমিদারকে তাহার নির্দ্দেশিত মোসাবিদার কবুলিয় রেজিষ্টারী করিয়া দিতেছে, তাহা তোমার দেখিবার বিষয় হইতে পারে কি? 

যতদিন কৃষকগণ জমিদারের বাধ্য থাকে, ততদিন জমিদারের এলাকায়, মোকদ্দমার সংখ্যা এককালীন কম হইয়া যায়। জমা বৃদ্ধি ও খরচাদি লইয়া জমিদার ও প্রজার মধ্যে অসদ্ভাব ঘটিলেই আদালত ও ফৌজদারীতে মোকদ্দমার সংখ্যা হঠাৎ বাড়িয়া উঠে, তৎসঙ্গে সঙ্গে প্রজাগণ ক্রমে জেলে যাইতে থাকে, তখনই রেজিষ্টারী অফিসে উদ্ভট মোসাবিদার অসংখ্য কবুলিয়ত রেজিষ্টারী হইতে ও কোর্টে সোলেনামা আদি দাখিল হইতে থাকে, ইহা দেখিয়াও কি তোমার গবর্ণমেন্ট বিশ্বাস করিতে চাহেন যে, প্রজাগণ বিশেষ কোনও স্বার্থের আশায় বিনা জোর-জুলুমে নিজের ইচ্ছায় স্বাধীন ভাবে ও সন্তষ্ট চিত্তে ঐ সকল দলিল ও সোলেনামা দিতেছে।

আমার নিজস্ব হক সম্পত্তি বাস্তবিকই যাহাতে এই ব্রহ্মান্ডের একটি প্রাণীও কোন স্বত্ত্বের চিহ্ন মাত্র দেখাইতে পারে না, তোমার সিংহাসন আইন আদালত বর্ত্তমান থাকিতেই আজ আমি তাহা হইতে বঞ্চিত হইলাম কেন? যে জমিদারের সহিত আমার বিবাদ ছিল তাহার প্রজা আমার পক্ষ হইতে পারিবে না জানিয়া ভিন্ন জমিদারের প্রজাকে স্বাক্ষীমান্য করিয়াছিলাম। তোমার আদালতের মোক্তার বাসা হইতে মোক্তার উকিলের ও বহু লোকের সাক্ষাতে দিবালোকের প্রকাশ্য আলোকের ও সহরের মধ্য দিয়া আমার সেই ভিন্ন এলাকার সাক্ষীগণকে তাহাদের জমিদারের প্রধান আমলা, তাহার সদয় কাছারীতে ধরিয়া লইয়া গিয়া আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে নিষেধ করিয়া দিল আমি আর সাক্ষী পাইলাম না, আমার মোকদ্দমা অচল হইল। তোমার হাকিমকে জানাইলাম, কি ফল হইল? তোমার রাজ্যের কোনও কর্ত্তাই আমার ন্যায্য সম্পত্তি আমাকে দিতে পারিল কি? তাই বলিতে ছিলাম- হে আমার লাট সাহেব বাহাদুর! এ দেশ তোমার নহে, ইহাতে তোমার প্রভূত্ব খাটিবে না। তুমি ব্যবসায় দারের দেশের লোক, প্রজা পালন করা তোমার কার্য্য নহে। আমার হক সম্পত্তি গিয়াছে আমার সর্বনাশ হইয়াছে। একটা প্রাণ আছে যদি তাহা লইতে হয় লও, রক্ষা করিতে হয় দয়া করিয়া রক্ষা কর। জেলে দিতে ইচ্ছা হইয়া থাকে দাও। সত্য কথা বলিতে এতদিন ভয় ছিল এখন আর নাই। 

ন্যায্য তর্ক লইয়া জমিদারের সহিত বিবাদ করিয়া তোমার রাজ্যে যাহা হইয়া থাকে, আমার ভাগ্যে তাহা হইয়াছে। তোমার অন্য প্রজা যাহারা এখনও ক্ষীণ প্রাণ লইয়া মৃতবৎ বাঁচিয়া আছে তাহাদিগকে আর প্রতারিত করিও না। ধর্ম্ম গ্রন্থ স্বরূপ যে আইন লিখিয়া রাখিয়াছ, তাহা যাহাতে কার্য্যকারী হয় তাহা কর। তোমার আইনের মাধুর্য্যে মুগ্ধ হইয়া প্রজাকুল জমিদারের সহিত দ্বন্দ্ব করিয়া মরিতেছে। সময় থাকিতে এখনও নতুন আইন করিয়া বৃটীশ-প্রজাকে নিষেধ করিয়া দাও, কেহ যেন আর কখনও তোমার আইন দেখাইয়া জমিদারের সহিত বৃথা ঝগড়া উপস্থিত না করে, ইতি। তাং ৩০-০৯-০৭ইং।

(মিহির ও সুধাকর-২৭শে অগ্রহায়ণ ১১ই পৌষ, ১০ই মাঘ ১৩১৪ সাল)

শ্রী গুণু প্রামানিক -

সাং শিধলি, ষ্টেসান বড়াইগ্রাম,

মহাকুমা নাটোর, জেলা রাজসাহী।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh