সাইফুল হক
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০, ১০:১৯ পিএম
বিজেপির নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী এবং চরম মুসলমান বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপসমূহের মধ্য দিয়ে ভারতের চিরায়ত সামাজিক ভারসাম্য এখন ধ্বংসের পথে। সাম্প্রদায়িক বিভাজন যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, তার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ভারতের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এ বিষয়ে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও বিশ্বে দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন-সিএএ ও এনআরসি নিয়ে ইতিমধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং বলেছে যে, এসব পদক্ষেপ বৈষম্যমূলক, অসম ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এসব পদক্ষেপ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলবে; বহুত্ববাদী সহনশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নষ্ট করবে। পরোক্ষভাবে ভারতকে এই ধরনের বিভাজনমূলক পদক্ষেপ কার্যকর করার ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছে।
মোদি-অমিত শাহরাও বসে নেই। গত ক’বছর ধরে ভারতের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নতুন সাম্প্রদায়িক ভাষ্য ও বয়ান তৈরিতেও তারা তৎপর রয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন ডিসকোর্স তৈরির অনেক প্রকল্প তারা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মুসলমান মোঘল বাদশারা কীভাবে ভারতে হিন্দুদের ওপর জবরদস্তি করেছে, নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্মান্তরিত করেছে তার নানা কৃত্রিম ইতিহাসকে তারা তাদের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক প্রচারণার হাতিয়ার করে তুলছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের অনুগত সাভারকারকে এখন আম্বেদকারসহ স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরদের বিপরীতে ‘মহান দেশপ্রেমিক’ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী বিভাজনের অন্যতম প্রবক্তা শ্যামাপ্রসাদকে ভারতের নায়ক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপির এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতে হিন্দুত্ববাদী এক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক-মতাদর্শিক ধারাকে সামনে তুলে আনা হচ্ছে। এর আশু লক্ষ্য হলো- উলঙ্গ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বিভেদ-বিভাজন আরও প্রশস্ত করা এবং ভারত শাসনে বিজেপির ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা, যেন দশকের পর দশক ধরে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারে।
বিজেপি এই রাজনীতির সাক্ষাৎ ফলাফল ঘরে তুলেছে গত লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি যে কাজে লেগেছে গত নির্বাচনেই তো তার সর্বশেষ বড় প্রমাণ। প্রবল আর্থিক সংকট, মন্দা, আশঙ্কাজনক প্রবৃদ্ধির হার, বেকারত্ব প্রভৃতি নানা সংকট-দুর্যোগের পরও নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় মোদি-অমিত শাহকে আরও আত্মবিশ্বাসী ও আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। অন্য অনেক দেশের মতো একচেটিয়া বিজয় তাদেরকেও নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারী করে তুলেছে; উন্মত্ত সাম্প্রদায়িকতার এক তেজি ঘোড়ায় তারা চেপে বসেছে।
এটা ইতিহাস সচেতন সবারই জানা যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির পর ভারতের ঐক্য ও সংহতির সাংবিধানিক রক্ষাকবচ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকেই অবলম্বন হিসাবে গণ্য করা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার এক ধরনের চর্চারও প্রচেষ্টা চলে। কিন্তু এই সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘নরম সাম্প্রদায়িকতার’ চর্চাও ভারতে দিনকে দিন বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন ভারতে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারও বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও ভোটের সমীকরণের হিসাব থেকে নানাভাবে এই ‘নরম সাম্প্রদায়িকতাকে’ পৃষ্ঠপোষকতা জোগায়। বাবরি মসজিদ ভাঙা ও তৎপরবর্তী নানা ঘটনায় এসব মদদ প্রদান ভালোভাবেই ধরা পড়ে। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার চাষবাসের এই জমিনেই বিজেপির বাড়-বাড়ন্ত, চারা গাছের এখন মহীরূহে পরিণত হওয়া।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত মনে করা হতো, মোদি-অমিত শাহ তথা বিজেপির নেতৃত্বে ভারত বুঝি গোল্লায় গেছে; এই অশুভ জুটির নেতৃত্বে আগামী দিনগুলোতে ভারতে কেবল হিন্দুত্ববাদের জয় জয়কার দেখা যাবে; বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে বিজেপি হজম করে ফেলবে; কাশ্মীরে বিশেষ অধিকার কেড়ে নিয়ে যেভাবে কাশ্মীরকে দিল্লির রাজনৈতিক-সামরিক বলয়ে সংহত করা হচ্ছে এবার গোটা ভারতকেও তারা এইকভাবে তাদের নতুন হিন্দুত্ববাদী উত্থানের পথে এগিয়ে নেবে, পর্যায়ক্রমে ভারত পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু ভারতে তা হয়নি। বিজেপির সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা ইতিমধ্যে হোচট খেয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করেছে। অভূতপূর্ব এবং অপ্রত্যাশিত এক প্রতিবাদী জাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন এক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের পুনর্জন্ম ঘটছে; ধর্ম, জাত-পাত, শ্রেণি-গোত্রতে বিভক্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ আর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সহনশীলতার সংস্কৃতি আবার ভারতীয়দের যুথবদ্ধতা তৈরি করছে; বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সেতুবন্ধন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষে মানুষে হিংসা আর ঘৃণার পরিবর্তে সাধারণ মানবিক সম্পর্কের রাস্তা তৈরি করছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি কার্যকর হলে মুসলমানের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, দলিত ও নিম্নবর্গের মানুষ, যাদের বিপুল অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সঙ্গত কারণে এদের অধিকাংশেরই নাগরিকত্ব প্রমাণে দালিলিক কাগজপত্র নেই, ভারতের এই বিশাল অংশের মানুষরা তাদের অস্তিত্ব সংকটে। তাদের এক বড় অংশও এখন রাজপথে সোচ্চার।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর) বা জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন তৎপরতার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইও শুরু হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে দেড় শতাধিক মামলা জমা পড়েছে। এইসব মামলার আরজির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে- সিএএ, এনআরসি, এমনকি এনপিআর এর উদ্যোগ ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী, বৈষম্যমূলক, মুসলমান ও গরিব বিদ্বেষী। সে কারণে এসব তৎপরতাকে অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করা হোক। ২২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে আবেদনকারীরা পূর্ণাঙ্গ শুনানি না হওয়া পর্যন্ত এসব আইনের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ না দিয়ে এসব বিষয়ে সরকারের অভিমত জানতে চেয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে পাঁচ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা শুনানি হবে ও তা নিষ্পন্ন করা হবে। কংগ্রেস ও বামপন্থী দল থেকে শুরু করে নানা রাজনৈতিক দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ এসব মামলা করেছে।
স্পষ্টত এসব মামলা নিষ্পন্ন হতে বেশ লম্বা সময় লেগে যাবে। আর সে পর্যন্ত রাজপথের প্রতিবাদ-দ্রোহ জীবন্ত রাখার প্রয়োজন হবে। আসল লড়াইটা রাজপথে। রাজপথের লড়াইয়ের স্রোতে মোদি-অমিত শাহ জুটির হিন্দু রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক প্রকল্পকে পরাজিত করতে না পারলে আইনি লড়াইয়েও জেতা কঠিন হয়ে পড়বে।
ভারতের পরিস্থিতি মোটামুটি একটি প্রলম্বিত সংগ্রামেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে আন্দোলনের শেকড় আরও গভীরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। আন্দোলন আরও বিস্তৃত হওয়ার পরিসরও বাড়বে বলে আশা করা যায়; এবং এসবের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
সাইফুল হক
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশের বিপ্লবী
ওয়ার্কার্স পার্টি