বিএনপি কি পারবে গোলক ধাঁধা থেকে বের হতে

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২০, ০৯:১৩ পিএম

বিএনপির রাজনীতির হাল-হকিকত বুঝে উঠতে পারা এখন অসম্ভব ঠেকছে, আগা-মাথা কিছু বুঝে উঠতে পারা যাচ্ছে না। যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা যদি থাকেন জেলে, তবে সেই দলের রাজনীতির ফোকাল পয়েন্ট নিঃসন্দেহে নেতার মুক্তি। যত অবস্থান ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তার সবই নেতার মুক্তির দাবি নিয়ে; কিন্তু অবস্থান ও পদক্ষেপ গ্রহণ দূরে থাক, মহাসচিব মির্জা ফখরুলের কথা থেকে অনুধাবন করা যাচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি এখন আর বিএনপির হাতে নেই। গত ৭ মার্চ জিয়ার কবর জিয়ারতের সময় এ বিষয়ে আবেদন করা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক বলতে পারব না। পরিবারের পক্ষ থেকে করা হলেও হতে পারে। আবেদনে কী আছে সঠিকভাবে জানা নেই।’

দল জানে না নেত্রীর মুক্তির ব্যাপারে- বিষয়টা নিয়ে ভাবলেই বিএনপি এখন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে কোন অবস্থায় রয়েছে, তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে। প্রসঙ্গত, বিএনপি খালেদা জিয়ার ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে চেয়েছিল। ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতারের পর তাকে ‘মা’ আখ্যায়িত করে বিএনপিকে একটি পরিবার হিসেবে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছিল; কিন্তু দেশনেত্রী কিংবা মা দুটিই বিএনপির জন্য এখন এক করুণ পরিহাসে পরিণত হয়েছে। দেশনেত্রীর পেছনে দেশবাসীকে নামানো দূরে থাক, বৃহত্তর পরিবারের মা তথা প্রধানের মুক্তির বিষয়ে কী হচ্ছে, তা জানতে পারছে না দলটি। হঠাৎ করে দেশ ও দলকে তফাতে রেখে নেহাতই পরিবারের একজন হয়ে গেলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া গ্রেফতারের পর থেকেই বিএনপি বলে আসছিল রাজনৈতিক কারণে নেত্রীকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়টাকে বিএনপি দূরে ঠেলে এখন মুক্তির বিষয়টি একেবারেই পারিবারিক পর্যায়ে নিয়ে গেল। বিষয়টা খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের জন্য নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক।

বিএনপি দলে এখনো জিয়া পরিবারের প্রভাব অনেকটাই একচ্ছত্র। নতুবা তারেক জিয়া আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিদেশ থেকে গঠনতন্ত্র পাল্টিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হতে পারতেন না। স্কাইপি বা ফোনে দলকে আদেশ-নির্দেশ দিয়ে কন্ট্রোল করতে সক্ষম হতেন না; কিন্তু এটাই বাস্তব ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমানের বিষয়ে বিএনপি কার্যত নিশ্চুপ, যেন তার বিষয়ে বিএনপির বলার কিছু নেই। আরও আগ্রহোদ্দীপক বিষয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠির বিষয়ে তারেক জিয়া পরিবারের উদ্যোগের সঙ্গে আছেন নাকি দলের মতো অন্ধকারে আছেন, তাও জানা যাচ্ছে না। বিএনপির সংকট যে কত গভীর এটা তারই প্রমাণ।

বিএনপি যে অস্তিত্বের সংকটে কতটা নিমজ্জিত তা অনুধাবন করা যাবে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করলে নিঃসন্দেহে জাতীয় জীবনে মুজিববর্ষ বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে জাতির সামনে সমুপস্থিত; কিন্তু এই উৎসব পালন নিয়ে বিএনপির অবস্থান একেবারেই ধোঁয়াটে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ৭ মার্চ বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া যখন কারাগারে, তখন মুজিব জন্মশতবর্ষ সফলের প্রশ্নই ওঠে না।’ জনগণের মনে যখন প্রশ্ন, বিএনপি মুজিববর্ষ পালনের পক্ষে না বিপক্ষে তখন তিনি ওই প্রশ্ন তুলে দলকেই আরও প্রশ্নের মুখোমুখি করলেন। এটা আসলে কাচের ঘরে বসে ঢিল মারারই নামান্তর। এদিকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইস্যুতেও জনগণের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে চাইলেন। ভারতে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ‘মোদির আসাটা কতটুকু সমীচীন, তা তারাই বিচার করবেন’। আবার এটাও বললেন, মোদির সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে দলে ‘এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।’ দেশের দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আসা কিংবা না আসাটা বিবেচনা করার ভার কীভাবে ছেড়ে দিলেন ভারতের ওপর, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। আলোচনা করবেন কিংবা করবেন না, এটাও তিনি বলতে পারলেন না। 

প্রসঙ্গত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিএনপি ও জিয়া পরিবারের অবস্থান পূর্বাপর এদিক-ওদিক দুলছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া বঙ্গবন্ধুর কাছে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন, বাকশালের সদস্য হয়ে মিছিলে রাস্তায় নেমেছিলেন প্রভৃতি ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছিল পেন্ডুলাম নাটক। ‘স্বাধীনতার ঘোষক’, ‘দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট’ প্রভৃতি কথা হচ্ছে দোল খেয়ে অপর দিকে ওঠার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিএনপি কখনো টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরে গিয়ে ফুল দেয় আবার কখনো কেক কেটে খালেদা জিয়ার তথাকথিত জন্মদিন পালন করে। এ সম্পর্কে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও দলটি অবস্থান পরিবর্তন করেনি। বিএনপির এই ধরনের রাজনীতির লক্ষ্য হলো, জনগণকে বিভ্রান্ত করে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কালিমালিপ্ত করা; সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে গিয়ে খোদ দলটিই এখন রাজনৈতিক গোলক ধাঁধায় আটকে গেছে।

আর এরই প্রকাশ ঘটছে বিএনপির প্রতিটি রাজনৈতিক বক্তব্যে। ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোসাই’ প্রবাদটা বিএনপি দলের নেতাকর্মীদের জন্য এখন প্রযোজ্য হয়ে উঠছে। দলকে সচল সক্রিয় করে মাঠে নামাতে পারছে না, বরং কথার ভেতর দিয়ে নেতারা দলকে বিপদে ফেলছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল মুজিববর্ষ পালন নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘বেগম জিয়া সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। ’৭১ সালেও যিনি স্বাধীনতার জন্যই পাকিস্তান বাহিনীর হাতে কারাগারে ছিলেন। তাকে গণতন্ত্রের জন্য ৯ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে।’ গণতন্ত্রের জন্য তিনি ত্রিদলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলনে এক জোটের নেতা হিসেবে ছিলেন, এটা আসলে কারোই অস্বীকার করার উপায় নেই; কিন্তু বিবেচ্য বিষয় হলো, ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে কিংবা উন্নয়নের স্বার্থে কি করেছিলেন। ১/১১-এর জরুরি আইনের শাসন ছিল খালেদা জিয়ার দুঃশাসনে ও দুরভিসন্ধিরই বিয়োগান্তুক পরিণতি।

বিএনপি ভুলে যাচ্ছে, মিথ্যা নয় সত্যের ওপর এখন দলটিকে দাঁড়াতে হবে; কিন্তু উল্টোটাই করছেন মির্জা ফখরুল। তিনি দলের চরিত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘বিএনপি একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি।’ এমনটা হলে নিঃসন্দেহে দেশের মঙ্গল হতো। বলাই বাহুল্য, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি একমাত্র গড়ে উঠে বিকশিত হতে পারে ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে জনগণের মধ্য থেকে। সামরিক শাসনের মধ্যে ক্ষমতায় বসে উর্দি পরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ক্যান্টনমেন্টের দল হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী সামরিক-বেসামরিক আমলা, পেশাজীবী, দলছুট রাজনীতিকদের দলে সমবেত করেছিলেন। তবে এটা ঠিক নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ত্রিদলীয় জোটের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বিএনপির সেরকম একটি দল হিসেবে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল।

বিগত নির্বাচনের আগে যদি জামায়াতকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকত, তবে তেমন আরও একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হতেও পারত; কিন্তু তা বিএনপি পারেনি। বাস্তবে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন তারেক জিয়া, যাকে নিয়ে জনগণের সামনে নামা যায় না, যার নাম নিতেও বিএনপির নেতাদের অসুবিধা হয়, সেই তারেক জিয়াকে সামনে নিয়েই চলতে চাইছে বিএনপি। বিএনপির ঘাড়ে মূলত বোঝা সৃষ্টি যিনি করেছেন, তাকেই বিএনপি শাকের আঁটি করে মাথায় রাখতে চাইছে। বিএনপি যদি শাকের আঁটি নামাতে পারে, তবে বোঝাও ক্রমে কমাতে পারবে বলে ধারণা করা যায়। পারবে কি না বিএনপি, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে!

শেখর দত্ত

কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh