সাফওয়ানা জাবীন
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২০, ০৮:৫৭ এএম | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০, ০৮:৫৯ এএম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সাক্ষী ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িটি। এই বাড়িটি হলো বাংলাদেশ সৃষ্টির সূতিকাগার। বাড়িটিকে ক্ষুদ্র সংস্করণের বাংলাদেশও বলা যায়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাড়িটি তীর্থস্থান হিসেবেই বিবেচিত হবে। কেউ যদি বলেন ধানম-ির ৩২ নম্বরে যাই, তাহলে বুঝতে হবে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছেন। আর বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়া মানেই বাংলাদেশের কাছে যাওয়া। ৬০-এর দশক থেকে বাড়িটি একটি প্রতীক হয়ে আছে। আর সে প্রতীক হচ্ছে সাহস, দৃঢ়তা ও বিদ্রোহের।
এই বাড়িকে অবলম্বন করেই স্বাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত। আর এ বাড়ি থেকেই তিনি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। সারাদেশের মানুষ প্রতিটি রাজনৈতিক নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকত ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িটির দিকে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের সময় এই ৩২ নম্বরের সামনে ভিড় জমে যেত। সবাই নেতার নির্দেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনতেন।
কখন বঙ্গবন্ধু তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন- সেই প্রত্যাশায় দিন কাটত মুক্তিপাগল বাঙালির। যেন বাঙালির প্রাণভোমরা এইখানে, এই বাড়িতে। বাঙালির প্রাণের, প্রেরণার উৎস যে এই বাড়িটি তা খুব ভালো বুঝেছিল স্বাধীনতার শত্রুরা। তাই ’৭৫-এ এই বাড়িতেই হামলা করে তারা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। শিশু রাসেলও রক্ষা পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে।
এই বাড়িটি এখন স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। ধানমন্ডির লেক সার্কাসের পাশে ৩২ নম্বর গেলেই দেখা মিলবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। সড়ক-৩২, বাড়ি নম্বর-৬৭৭ আর নতুন ঠিকানা অনুযায়ী ধানমন্ডির সড়ক নম্বর ১১ আর বাড়ি নম্বর ১০। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাড়ির পরিচয় ৩২ নম্বরের বাড়ি।
একটি বাড়ি ঘিরে যে কত ইতিহাস তা না গেলে বোঝা যাবে না। সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন বাড়িটি থেকে। কিশোর হাসনাইন কাদের রাজ্য জানে না। ক্লাস নাইনের ছাত্র সে। বঙ্গবন্ধুর কথা বই পড়ে জেনেছে। সাদা রঙের ভবনকে বঙ্গবন্ধু ভবনও বলা হয়।
বাড়িটির মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘর। আছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এখানে আসতে হবে।
তিন তলা বাড়ির ভবনে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বলা যায়, এক তলার প্রথম কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তোলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এ তলায় আরও আছে পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের তৈলচিত্র। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়েছিল।
আর এ ঘরের সামনে করিডোর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু। এখনো গুলির স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। সিঁড়িটিতে চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তার সবসময়ের সঙ্গী পাইপ, তামাকের কৌটা। এ কক্ষে আরোআছে টেলিফোন সেট, রেডিও। কিছু রক্তমাখা পোশাক। সামনের খাবার ঘরের পাশেই আছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তার সামরিক পোশাক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। এ কক্ষে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়িগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো।
এ ভবনের মোট নয়টি কক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে আরও আছে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশুপুত্র রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবহার্য আসবাবের মধ্যে আরও আছে খাবার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা, বাটি। আছে সোফা। বাড়ির দেয়াল, দরজায় বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার করে। জাদুঘরের পেছনের অংশে রয়েছে সম্প্রসারিত নতুন ভবন। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয়। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে আর পঞ্চম তলায় পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।
দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহে মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বুধবার সাপ্তাহিক ছুটি। এ ছাড়া সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও জাদুঘর বন্ধ থাকে। ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো টিকিট প্রয়োজন হয় না। শুক্রবার ১২ বছর বয়সের নিচের কারো টিকিটের প্রয়োজন হয় না। টিকিটের দাম ৫ টাকা মাত্র।