বঙ্গবন্ধুর অগ্রসর চিন্তাভাবনা কারাগারের রোজনামচার সাক্ষ্য

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২০, ০৯:৪৪ পিএম

নাইজেরিয়ার ওলে সোয়িংকা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮৬ সালে। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্য থেকে তিনিই প্রথম। তার একটি প্রবন্ধের শিরোনাম : ‘টোয়াইস বিটেন’ মানে ‘দুই বার কামড় খাওয়া’। সাম্রাজ্যবাদের দিক থেকে। নাইজেরিয়ার কথা বলেছিলেন সোয়িংকা। তার থেকে অনেক বড় এবং স্পষ্টভাবে ‘দুই বার কামড় খাওয়া’ অবস্থা ছিল আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে। সরাসরি আমরা দু’বার স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম- ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিদের কাছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে কি না জানি না, আমরা দ্বিতীয় এক শক্তির হাতে বন্দি হয়েছিলাম। নানা ঘটনাপ্রবাহে সেই দ্বিতীয় বন্ধন থেকে মুক্তির সংগ্রামে আমাদের জাতীয় নেতা হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজই মানুষকে তৈরি করে। লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও। সেই লড়াই-সংগ্রামের শক্তি-দুর্বলতা বঙ্গবন্ধুর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে। অলৌকিক কিছু কি কোথাও পাওয়া যায়?

বঙ্গবন্ধুর অনেক ভূমিকা এবং বক্তব্যকে তাঁর সাধারণ কিছু পরিচয়ের মধ্যে পাওয়া যায় না। যেমন, তাঁকে শুধু জাতীয়তাবাদী নেতা ভাবা হয়, বিশেষ করে তার প্রথম জীবনের মুসলিম জাতীয়তাবাদের আলোকে তাঁকে অমনটা ভাবা হয়। তখন তার বেশ কিছু অগ্রসর, উদার, প্রগতিশীল বক্তব্য বিস্ময়কর ঠেকে, অবিশ্বাস্যও। সেক্ষেত্রে এটা মনে রাখলে সাহায্য হয় যে, মূলত সেটা ছিল একটি উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রাম, এবং উপনিবেশবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের গর্ভজাত একটি ব্যবস্থা। মূল পুঁজিবাদকে একেবারে না ভেবে, না বুঝে তখন স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়া ছিল বিরল ঘটনা। সেভাবেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীরই চেতনাগত অনেক বিলোড়ন এবং উত্তরণ ঘটার বাস্তব অবকাশ ছিল। দেখা গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগেরই খানিক বামঘেষা আবুল হাশিম ধারাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং খুব বেশি মনোযোগ নিয়ে না হলেও, তার রাজনৈতিক ক্লাস ইত্যাদিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণচরিত্রের অধিকারী এক কর্মী এবং নেতা। তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের চেয়ে মাঠের লড়াই-সংগ্রামে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন তিনি। ব্যাপক জনসংযোগের মধ্য দিয়ে অনেক ধারণা এবং শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন- তখন তো চারদিকে ডান-বাম সব ধারার এবং মতাদর্শের মানুষ। শ্রম, গতি, আবেগ-উচ্ছ্বাস ইত্যাদির মিলিত বিকাশ ঘটেছিল তাঁর জীবনে। প্রখর স্মরণশক্তি এবং বাগ্মিতায় নির্মিত ছিলেন তিনি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি নানা সাক্ষ্যে ও প্রমাণে পূর্ণ। রাজনৈতিক এবং জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু মূল্যবান ধারণা ও প্রত্যয় তিনি অর্জন, ব্যবহার এবং প্রকাশ করেছিলেন অত্যন্ত সহজভঙ্গিতে।

বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং সত্যের সম্পদ নিয়েই মূল্যবান শেখ মুজিবুর রহমানের তখনকার ধারণা কিংবা চিন্তা। সেগুলো এখনো আলো ফেলে, পথ দেখায়। কারাগারের রোজনামচার ১৯৬৬ সালের ৭ জুলাই, বৃহস্পতিবারের ভুক্তিটির একাংশে বঙ্গবন্ধু নিম্নরূপ লিখেছিলেন, ‘সন্ধ্যার সময় এক সিপাহি আমাকে বলল, দেশের কথা কি বলব স্যার! কয়েকদিন পূর্বে ফরিদপুরের একটা মেয়েলোক আমার এক বন্ধুর কাছে ১৩ দিনের এক ছেলেকে ১০ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গিয়াছে। এমনিই দিয়ে যেতে চেয়েছিল, বন্ধু ১০ টাকা দিয়ে দিল। কোনো কথা না বলে ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে সে চলে গেল। একটা কথাও বলল না, শুধু বলল, আমি মাঝে মাঝে দেখতে চাই ছেলেটা ভালো আছে।’ আরও বলল, অনেক গ্রামের কচু গাছ ও গাছের পাতাও বোধ হয় নাই। বললাম, এই তো আইয়ুব খান সাহেবের উন্নয়ন কাজের নমুনা। মোনায়েম খাঁ সাহেবের ভাষায় চাউলের অভাব হবে না, গুদামে যথেষ্ট আছে। যে দেশে মা ছেলে বিক্রি করে পেটের দায়ে, যে দেশের মেয়েরা ইজ্জত দিয়ে পেট বাঁচায়, সে দেশও স্বাধীন এবং সভ্য দেশ। গুটিকয়েক লোকের সম্পদ বাড়লেই জাতীয় সম্পদ বাড়া হয় বলে যারা গর্ব করে তাদের সম্বন্ধে কি-ইবা বলব! (পৃ: ১৫৩)

এক ধরনের ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বিশ্লেষণ এবং মত এখানে পাওয়া যাচ্ছে, যা বিভিন্ন সময়কে বুঝতে সাহায্য করে। বর্তমান কালকেও।

বামপন্থীদের আমি দীর্ঘ ও জটিল তর্ক এবং বিশ্লেষণ করতে দেখেছি। ধর্ম বিষয়টি নিয়েও তাদের নানা বক্তব্য, শক্ত শক্ত অবস্থান আছে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেগুলোর বিভিন্ন মূল্য, গুরুত্ব আছে। ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতা হলেও বঙ্গবন্ধু এমন সব বিতর্ক, বিচারকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাননি। তবে তার বক্তব্য অনেক সহজ সরল, একই সঙ্গে সাহসীও বটে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যেহেতু ধর্মকে খুব বেশি রাজনীতিতে টেনে এনেছিল, সেটা লক্ষ্য না করে এবং পাল্টা কিছু বয়ান উপস্থিত না করে বঙ্গবন্ধুর পর্যায়ের নেতার কোনো উপায়ও ছিল না। কারাগারের রোজনামচার ১৯৬৬ সালের ২ আগস্ট তারিখের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু নিম্নরূপ লিখেছিলেন-

জনাব আইয়ুব খান সাহেব আজকাল আল্লা ও রসুলের নাম নিতে শুরু করেছেন। খুব ভালো কথা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন, দেশের দুই অংশকে যুক্ত করার সূত্র আমাদের পয়গম্বর হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মহান ব্যক্তিত্বেই পরিলক্ষিত হইয়াছে। যতদিন এই যোগসূত্রের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন জাতীয় একতা অক্ষুণ্ন থাকিবে। মহান আদর্শের নামে নিশ্চয়ই হজরত মুহম্মদ (সা.) দেশের একটা অংশ অন্য অংশকে শোষণ করবে এ কথা বলে যান নাই। তিনি তো ইনসাফ করতে বলেছিলেন। শোষক ও শোষিতের মধ্যে সংগ্রাম হয়েই থাকে এবং হবেও। শোষকদের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই। একই ধর্মের বিশ্বাসী লোকদেরও শোষণ করে চলেছে ছলে বলে কৌশলে। (পৃ: ১৮৭)

বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যে সহজ ভাষায় মুক্তির ধর্মতত্ত্ব যেমন পাচ্ছি, তেমনি সহজ ভাষায় পাচ্ছি দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের মুখোশ-উন্মোচন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র তো সংখ্যাগুরু সাধারণ মুসলিমরাই সর্বাধিক শোষিত, বঞ্চিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর বাড়তি চলছিল অঞ্চলভিত্তিক শোষণ-বঞ্চনা, আর তাতে ব্যবহার করা হয়েছে আইয়ুব খান-কথিত ‘যোগসূত্র’টি ধর্মকে।

বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত শোষণের বৃহৎ বিশাল ক্রিয়াদান সম্পর্কে বলা হয় বড়-বড় তত্ত্বকারের নাম, তত্ত্বের নাম বলা হয়ে থাকে। যেন এগুলো শুধু পশ্চিমের জ্ঞান, তাদের অবদান। শ্রেণিস্বার্থের মিল থেকে যোগসাজশ, দালালি ইত্যাদি যে সর্বকালে সর্বত্র ঘটেছে, সেখানে যে কোনো ঐক্য, কোনো সম্পর্ক কাউকে রক্ষা করে না, করেনি- সেটা আমরা মনে রাখি না, বলি না। কারাগারের রোজনামচার ১৯৬৬ সালের ২০ জুন, সোমবারের দিনলিপিতে দেখতে পাচ্ছি জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার এবং নানা সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার কিছু ঘটনার উল্লেখ ও বিবরণ।

স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির দেশপ্রেম, বিশ্বস্ততা ইত্যাদির বিপরীতে এ এক ভয়াবহ চিত্র আমরা পাই বঙ্গবন্ধুর কলম থেকে। তাঁর নিজের মৃত্যুবরণও বিশ্বাসঘাতকতারই এক নৃশংস পরিস্থিতি। নিচের উদ্ধৃতির কথাগুলো যিনি লিখেছিলেন, বিশ্বাস হতে চায় না তিনিই বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের শিকার একপ্রকার অবলীলায় কীভাবে হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল। আমরা সাধারণত মীরজাফর আলী খার কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর পূর্বেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রিম আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেঈমানী করে মোগলদের দলে যোগদান করে। রাজমাবাদের যুদ্ধে দাউদ কারানীকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করে বাংলাদেশ মোগলদের হাতে তুলে দেয়। এরপরও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাতি। একে অন্যের সাথে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। (পৃ: ১১১)

এমন তথ্য এবং বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে মূল্যবান সতর্কতা এবং সাহস আছে, গ্লানি আছে, গৌরবও আছে। এর ভারসাম্যও মূল্যবান। জাতীয়তাবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার ত্রুটি নির্দেশ শুধু মার্ক্সবাদীরা, ফানোরাই করেননি। বাড়তি প্রজ্ঞা এবং পর্যবেক্ষণ যে জাতীয়তাবাদীরা প্রমাণ করেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সারিতেই। বাংলাদেশের মানুষ এই নেতাকে কতটা অনুসরণ করেছেন, পরিপূরক সহায়তা দিয়েছেন- সে প্রশ্ন উত্থাপনই বরং আজও জরুরি।

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়

অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh