দীপক পিললাই
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২০, ০৯:৩১ এএম
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এই একবিংশ শতাব্দীতেও এমন সব মানুষের দেখা মেলে, যাদের কাছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান পৌঁছায়নি। এই রকমই একদল মানুষ হলো ফিলিপাইনস দ্বীপপুঞ্জের তাসাডে, সিংহলের ভেড্ডা, কিংবা এই ভারতের কেরালা রাজ্যের চোলনায়কনে। যদিও সমাজ বিবর্তনের ধারায় এই সব বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের সংস্কৃতি একই পর্যায়ভুক্ত নয়, কিন্তু গুহা-বাসের ব্যাপারে তারা সকলে যেন একই গোত্রের।
এইরকম মানুষেরা যে-সব দেশে থাকে, সেইসব দেশের সরকার আজও এদের আধুনিক জ্ঞানের আলোয় শিক্ষিত করে তোলা দূরের কথা, তাদের কাছে আধুনিক সভ্যতার এতটুকু কণাও পৌঁছে দিতে পারে নি! এঁরা তাই আজও পড়ে আছে লক্ষ বছর আগের যুগে; গুহাই এদের রাজপ্রাসাদ। যদি কখনো এদের গুহা-বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পড়ি তাহলে দেখবো- এঁরা কেমন আগুনে ঝলসানো মাংস খেয়ে আর প্রায়-উলঙ্গ অবস্থায় গুহা-প্রাসাদে দিব্যি খোশমেজাজে দিন কাটাচ্ছে। এদের জীবনধারণ পদ্ধতি দেখলে মনে হবে, বর্তমান সভ্যতার যুগে এরা যেন জীবন্ত ‘হোমো ইরেকটাস’!
আমরা যে তৈরি করা বাড়ি আর গুহা-বাড়ির কথা জানলাম, সে সব বাড়িতে যারা থাকতো তাদের বয়স তো লক্ষ বছরের কোঠায়। কিন্তু অন্য সময়ে মানুষে কোথায় বসবাস করেছে? গুহায়, না তৈরি করা বাড়িতে?
এ প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনো দিয়ে উঠতে পারেননি। গবেষণা চলছে; আগামী দিনে নিশ্চয়ই আরো-আরো তথ্য পাওয়া যাবে, নতুন-নতুন তত্ত্বের উদ্ভব হবে, সত্যের আরো অনেক কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে আদিম মানুষ যে বিভিন্ন সময়ে গুহায় কাটিয়েছে, তার প্রমাণ কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলেই পাওয়া গেছে। এ কথা তো নিশ্চয়ই জানা যায়, আজ থেকে প্রায় হাজার দশেক বছর আগেও আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রধানত পাথর দিয়েই নানা রকম হাতিয়ার বানাতো, তাই দিয়ে পশু শিকার করতো, শিকার করা পশুর ছাল-চামড়া ছাড়াতো, মাংস কাটতো, আরো নানা কাজ করতো।
এই জন্য বিজ্ঞানীরা লাখ লাখ বছরব্যাপী সেই যুগটার নাম দিয়েছেন ‘প্রস্তর যুগ’। এই প্রস্তুর যুগে মানুষ যে গুহায় থাকতো, তার অনেকের ভেতরের দেয়ালে সে নানা রকম সুন্দর সুন্দর সব ছবি এঁকে রেখেছে, যার বেশিরভাগই হলো পশু বা পশু-শিকারের ছবি। এইসব ছবি এখনও পৃথিবীর বহু জায়গাতেই, এমনকি এই ভারতবর্ষেও দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের মধ্যপ্রদেশের ভূপাল শহরের কাছে ‘ভীম বেট্কা’ পাহাড়ের গুহাতে এরকম অনেক চিত্রের দেখা মেলে।
ভাবতে পারি- ‘ছবি দেখেই ওমনি বোঝা গেল, যে সেখানে মানুষ বাস করতো? এমনও তো হতে পারে যে, কেউ হয়তো একটা গুহা দেখতে পেয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং খুশি মতো ছবি এঁকেছে।’ না, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সেরকম ভাবে ঘটেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানা পাহাড়েরর গুহার দেয়ালে আঁকা যেসব ছবি পাওয়া গেছে, তার অনেকগুলো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলে বেশ পরিষ্কার বোঝা যায় যে, অনেকদিন ধরে এবং অনেক কষ্ট করেই তখনকার মানুষদের এইসব ছবি আঁকতে হয়েছিল- যা কেবলমাত্র সেইসব গুহায় অনেকদিন ধরে বসবাস করলেই সম্ভব।
এমনকি, কোনো কোনো ছবি অন্ধকার ঘুরঘুট্টি গুহার অনেক ভিতরে এমন জায়গায় আঁকা হয়েছে যেখান শুধু হামাগুঁড়ি দিয়েই পৌঁছানো সম্ভব। তাছাড়া, গুহা থেকে পাওয়া গেছে আগুন ব্যবহারের চিহ্ন, উচ্ছিষ্ট খাবার; পাওয়া গেছে নানা ধরনের হাতিয়ার (কোনোটা পাথরের, কোনোটা হাতির দাঁতের, কোনোটা বা হরিণের শিঙের) ইত্যাদি। এইসব প্রমাণ থেকে নিশ্চিতভাবেই জানা যায় যে, প্রস্তর-যুগে আমাদের পূর্বপুরুষরা বহু-বহু বছর গুহাতেই জীবন কাটিয়েছে।
পাহাড়ের গুহা তো অনেক সময়েই বিশাল লম্বা হয়- এক মাইল, দু’মাইল, বা তার চাইতে বেশিও লম্বা হয়। কিন্তু অত ভেতরে কিন্তু কখনোই মানুষ বসবাস করত না। একে তো অন্ধকার ঘুরঘুট্টে, তার ওপর আবার সূর্যের আলো ঢোকে না বলে স্যাঁতসেঁতে, ওপর থেকে টপ্ টপ্ করে পানি পড়ে অনেক সময়। ওই রকম অবস্থায় কি আর মানুষ থাকতে পারে? তারা সমসময়েই গুহা-মুখের কাছে থাকতো, যাতে আলো বাতাস সবই পাওয়া যায়।
তাছাড়া, তখনকার আবহাওয়াও এখনকার মত ছিল না। ঠান্ডা পড়তো একেবারে হাড় কাঁপানো, কনকনে। তবে, গুহা মুখের কাছে থাকছে বলে অসুবিধা কিছু নেই। পশুর চামড়া ঝুলিয়ে দিলেই হলো গুহা-মুখে। কিংবা, কোনো কিছু জড়ো করে একটা দেয়াল কোনো রকমে গুহা-মুখের কাছে খাঁড়া করতে পারলেই হল- আর কি, ঠান্ডা সমস্যার সমাধান!
আদিম মানুষ থাকার জন্য উপযুক্ত জায়গা হিসেবে সে রকম গুহাই পছন্দ করতো যার কাছাকাছি পানীয় জল পাওয়া যায়; আর যে গুহার মধ্যে সূর্যের আলো ঢোকে। এই রকম গুহার মুখের কাছেই তারা থাকতো। ‘গুহা বাড়ি’ বললে যদি কেউ ভুল করে ভেবে বসে যে, মানুষ বুঝি গুহার অনেক ভেতরে অন্ধকার-স্যাঁতসেঁতে জায়গাতেও বাস করতো, তাই বিজ্ঞানীরা অনেক সময়ে ‘পাথুরে আস্তানা’ কথাটাও ব্যবহার করেন।
আমরা আদিম মানুষের ‘ঘরবাড়ি’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাদের তৈরি করা বাড়ি এবং গুহা-বাড়ির খবর জানলাম। মানুষ কিন্তু চাল-চুলোহীন অবস্থায় খোলা জায়গাতেও থাকত। অনেক সময় প্রাকৃতিক অবস্থায় বাধ্য হয়েও মানুষ গুহাতে বসবাস করেছে। যেমন- ‘বরফ যুগ’-এর কথা। এ সময়ে যেসব মানুষ ছিল, তারা বাইরের ভয়ানক ঠান্ডার ফলে বাধ্য হয়ে গুহার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতো। গুহাকে তারা বাড়ি বানাতে বাধ্য হতো।
মানুষ এ সময়ে ছিলো যাযাবর। খাবার সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতে গিয়ে তাদের থাকতে হতো এখানে- সেখানে। কিন্তু যখন- যেখানে থাকার দরকার হতো সেখানেই যে পাহাড় থাকবে, গুহা-বাড়ি তৈরি হয়ে থাকবে- এমন তো আর হতে পারে না। অন্যদিকে, সব সময়ে যে তারা বাড়ি বানাতে পারবেই, সেখানে বাড়ি বানানোর উপযুক্ত উপকরণ যে পাওয়া যাবেই এমনও নয়। সে ক্ষেত্রে খোলা জায়গাই ছিল মানুষের ‘ঘর’; খোলা জায়গায় ছিল তার ‘বাড়ি’। সেরকম খোলা জায়গাতেই তারা বসবাস করতো দলবদ্ধ হয়ে।