ভয়াবহ ক্ষতির মুখে বিমান চলাচল খাত

রাবেয়া আশরাফী পিংকি

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২০, ১০:৪৯ এএম

করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) মারাত্মক প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল খাতের ওপর। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বের অনেক দেশের সরকার ভ্রমণে নানা বিধিনিষেধ জারি করেছে। প্রতিদিনই বাতিল হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ফ্লাইট। 

একদিকে যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়া ও অন্যদিকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোও নিজেদের সেবা কার্যক্রম সংকুচিত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক ও নজিরবিহীন এই শ্লথগতির কারণে বিমান চলাচল শিল্প কোটি কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

এ তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। অভিবাসী শ্রমিক, এখানে থাকা বিদেশি নাগরিক ও পর্যটকদের ভ্রমণের সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় বিমান চলাচল খাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আকাশপথে যাত্রী চলাচল ছিল ধারণার চেয়েও অনেক কম। সামনের মাসগুলোতেও করোনাভাইরাসের কারণে তা আরো কম থাকবে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। 

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুই বিমানবন্দর ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আসা-যাওয়া ফ্লাইটগুলো কিছু পুনঃবিন্যাস, আবার কিছু বাতিল করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশসহ সাতটি দেশের সাথে বিমান চলাচল স্থগিতের ঘোষণা দেয় কুয়েত। কুয়েতের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে বিমান বাংলাদেশও ঢাকা-কুয়েতের দুটি ফ্লাইট বাতিল করে। এছাড়া মোট ছয়টি দেশের অনঅ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা প্রদান স্থগিত করেছে বাংলাদেশ বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। 

ঢাকা থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনাকারী বেশ কিছু সংস্থা জানিয়েছে, যাত্রীর অভাবে ইতালি, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর ফেব্রুয়ারির পর থেকে ফ্লাইট সংখ্যায় চরম পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

রিজেন্ট এয়ারের মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের ডিরেক্টর সোহাইল মজিদ জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালামপুরে তাদের দৈনিক ফ্লাইট অনেক কমে গেছে। ঢাকা-কলকাতা ও চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটেও ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে।

নভোএয়ারের মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ব্যবস্থাপক এ কে এম মাহফুজুল জানান, ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা-কলকাতা রুটে তাদের ফ্লাইট চলাচল ছিল ৮৭ শতাংশ; কিন্তু মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তা ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে সৌদি আরব ওমরাহ হজেও ভিসা দেয়া স্থগিত রেখেছে। ফলে বাংলাদেশের ওমরাহযাত্রীরা এখন বিপাকে পড়েছেন। 

বিমান জানায়, সৌদিগামী ১১ ফ্লাইটের জন্য তারা এরই মধ্যে তিন হাজার ৩০০টি টিকিট বিক্রি করে ফেলেছে। এখন এসব টিকিট বাতিল করার বিষয়ে কাজ চলছে।

শুধু বাংলাদেশ নয় যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল খাতই এখন বড় ধরনের ধসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই সংকটে গত ১০ বছর ধরে গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান খাতের শক্তিশালী ভিত্তিও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এক দশক আগে আর্থিক সংকটের পর থেকে দেশটির বিমান সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম সমন্বিত করার পাশাপাশি আরো মজবুত করে তোলে।  

পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তা বোঝাতে টাটকা উদাহারণ হিসেবে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের কথা উল্লেখ করা যায়। সপ্তাহ দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো বিমান সংস্থা হিসেবে ব্যাপকহারে অভ্যন্তরীণ সেবা কার্যক্রম কমিয়ে ফেলার ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। মূলত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আতঙ্কে টিকিট বিক্রি কমে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ইউনাইটেড এয়ারলাইনস কর্মীদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে বলেছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা এপ্রিলের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেবা কার্যক্রম ২০ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর অভ্যন্তরীণ সেবা কার্যক্রম কমবে ১০ শতাংশ। আগামী মে মাসেও এ ধারা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া জুন পর্যন্ত সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। 

ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের কর্মীরা চাইলে স্বেচ্ছায় বিনা বেতনে ছুটির আবেদন করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী অস্কার মোনাজ বলেন, ‘আমরা খুবই আন্তরিকতার সোথে আশা করছি সম্প্রতি নেয়া পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট; কিন্তু এই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ধরনের কারণে আমাদের আরো সতর্ক থাকতে হবে।’

করোনাভাইরাস নিয়ে যাত্রীদের আতঙ্কের কারণে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শীর্ষ বিমান সংস্থা জেট-ব্লু। গত ৪ মার্চ জেট-ব্লুর পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে- তারা করোনাভাইরাসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে খুব শিগগিরই ‘প্রাথমিকভাবে’ সক্ষমতা ৫ শতাংশ কমানো হবে। 

বিমান সংস্থাটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের সেবা কার্যক্রম আরো কমানো হবে কি না তা বোঝার জন্য পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নগদ অর্থ সাশ্রয়ের বিষয়টিও ভাবতে হচ্ছে। আর এজন্য সব বিভাগেই নিয়োগ হ্রাস করা হবে ও অতিরিক্ত খরচেও লাগাম টানা হবে।’

আমেরিকান এয়ারলাইনসের (এএএল) মুখপাত্র অন্য কোম্পানিগুলোর ফ্লাইট হ্রাস প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি ও প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিমান সংস্থাগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা। 

ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে ২০০১ সালের মতো বিমান সংস্থাগুলোর কোনো বেলআউট বা অর্থ সহায়তা প্রয়োজন হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে এয়ারলাইন ইনডেক্সে পতন হয় ৩০ শতাংশ। ডাও জোনসে সংশ্লিষ্ট শিল্পটির সূচকেও বড় ধরনের পতন লক্ষ্য করা যায়। 

চলতি বছরের শুরুটাও বিমান চলাচল খাতের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরে একই সময়ে আকাশপথে যাত্রী চাহিদা ছিল ২.৪ শতাংশ বেশি; কিন্তু ডিসেম্বরের ৪.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় তা কম। শুধু তা-ই নয়, জানুয়ারিতে আকাশপথে যাত্রী প্রবৃদ্ধি ছিল ২০১০ সালের এপ্রিলের পর সবচেয়ে শ্লথ। ২০১০ সালে আগ্নেয়গিরির লাভা-ছাইভস্মের কারণে ইউরোপজুড়ে আকাশপথ বন্ধ ছিল ও বিমান সংস্থাগুলো ব্যাপকহারে ফ্লাইট বাতিল করেছিল।

বিমান সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন আইএটিএর ডিরেক্টর জেনারেল ও সিইও আলেকজান্দার দে জুনিয়াক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘টলমল পায়ে বছরটা শুরু করেছে কার্গো ইন্ডাস্ট্রি। অথচ আশা করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য উত্তেজনা প্রশমনের সুবাদে ২০২০ সালটা এ খাতের জন্য ভালো যাবে; কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সবকিছু বদলে গেল। বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।’ 

দ্য গ্লোবাল বিজনেস ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণে বিনিয়োগ কমে যাবে ৩৭ শতাংশ। ফলে এই শিল্পটিকে মাসে ৪৬.৬ বিলিয়ন ডলার ও বছরে প্রায় ৫৬০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে। 

শিকাগোর দেপল ইউনিভার্সিটির ট্রান্সপোর্টেশন বিভাগের অধ্যাপক জো শুটারম্যান বলেন,‘এই মুহূর্তে বিশ্বে বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত বিমানসংস্থাগুলো ঘোলাটে পরিস্থিতি অতিক্রম করছে।’ 

সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রি কোটি কোটি ডলার লোকসানের সামনে দাঁড়িয়ে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh