শর্ট ফিল্ম ‘দেবী’
গাজী তানজিয়া
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২০, ০২:৩৮ পিএম
সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রিয়াঙ্কা ব্যানার্জি নির্মিত একটা শর্ট ফিল্ম ‘দেবী’ বেশ আলোড়ন তুলেছে। দেশি এবং বিদেশি চলচ্চিত্র সমালোচকদের ১৩ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে প্রশংসামূলক আলোচনাও চোখে পড়েছে বেশ কয়েকটি। এক কথায় বলা যায় সাধারণ চলচ্চিত্র দর্শক এবং বোদ্ধা দু‘ধরনের দর্শককেই এক ধরনের ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছে এই চলচ্চিত্র।
গল্পের শুরুতে দেখা যায় একটি গোথিক স্ট্র্যাকচারের বাড়ির বসবার ঘরে বসে আছেন সমাজের নানা স্তরের নারী। তাদের এই বসে থাকার ভঙ্গি বলে দেয় যে, এই বসে থাকা সাময়িক নয়, যেন অনন্তকালের জন্য কোনো এক অজানা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছেন তারা। সেখানে ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ভিন্ন জাত গোত্রের এবং ভিন্ন সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের নারীরা অবস্থান করছেন।
তারা যে সেখানে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থান করছেন তা নয়, প্রকারান্তরে মানিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার এই নারীরা স্বেচ্ছায় যে সেখানে একত্রিত হয়েছেন তা কিন্তু নয়। মূলত নূহের নৌকায় ওঠার মতো বাধ্য হয়েই যে তারা একত্রিত হয়েছেন এটা তাদের সংলাপ চয়নে বোঝা যায়।
ছবিতে লক্ষ্যণীয় এইসব নারীদের পোশাক এবং বয়স। সেখানে একেবারেই ঘরোয়া সদাচারী ধর্মপরায়ণ নারী যেমন আছেন, তেমনি আছেন বুক ওয়ার্ম সারাক্ষণ বইয়ে মুখগুঁজে পড়ে থাকা সুশীলা ছাত্রী, পর্দায় আচ্ছাদিত মুসলিম নারী, সন্ধ্যা আরতী দিতে ব্যস্ত গৃহিণী, ফ্যাশন মডেল, করপোরেট চাকুরে, মূক বধির, সমাজের নিচু তলার মধ্য বয়সিনী বা পড়ন্ত বয়সেরও নারী সে ঘরে উপস্থিত। আছে ধনী, আছে গরিব, আছে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, পর্দানসীন বা স্বল্পবসনা কিন্তু তাদের সবার সমস্যার জায়গাটি এক, তারা নারী।
টিভিতে একটা সংবাদ প্রচারের সময় তাদের নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেই খবর শুনতে দেখা যায়; কিন্তু বিপত্তি বাধে তখনই যখন নতুন একজন আগন্তুক এসে দরজায় কড়া নাড়ে। তারা তাদের এই জনাকীর্ণ ঘরে আরও একজনকে ঠাঁই দিতে চায় না। তাদের ধারণা প্রতিদিন এভাবে স্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকলে এক সময়ে হয়তো ওই ঘরে আর তিল ধারণের ঠাঁই থাকবে না। তাই আগন্তুককে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে বিবাদটা তারা যার যার ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যান।
তারা নানাভাবে আগন্তুককে বাধা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। কেউ কেউ নির্যাতনের ধরন এবং জখম অনুযায়ী ওই ঘরে অবস্থানের ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করতে থাকেন। তবে নির্যাতনের ধরন যতটাই হিংস্র হোক বা না হোক মানসিক নিপীড়নটা যে সবার ক্ষেত্রে একই ছিলো সে বিষয়টাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে সংলাপ নির্মাণের ভেতর থেকে। সাধারণ কয়েকটি ঘরোয়া সংলাপ স্পষ্ট করে তোলে বিষয়টির ভয়াবহতা এবং বীভৎসতা সম্পর্কে। এবং দর্শককে মোক্ষম ঘা টি দেয়া হয় শিশু আগন্তুকের প্রবেশের মধ্য দিয়ে।
আমরা জানি প্রতিদিন ভারতে ও বাংলাদেশেও অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন, যা বছর শেষে হাজার ছাড়িয়ে যায়। সেই সব ধর্ষণের ক্ষেত্রেও বয়স, পেশা, শ্রেণি ও পোশাকের কোনো সীমা থাকে না। তাই ধর্ষিতা হিসেবে শিশু আগন্তুকের আগমনে চমকাবার কিছু নেই। বরং এই চলচ্চিত্রে যে বিষয়টা আমাকে হতাশ করেছে তা হলো, সব ধর্ষিতা যেন একত্রিত হয়েছেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। একটা সংলাপ ছিলো এমন-‘বাইরে ওই হায়েনাদের সঙ্গে থাকার চেয়ে সবাই মিলে এখানে (এই বদ্ধ ঘরে) অ্যাডজাস্ট করা ভালো’।
এই একটি সংলাপ গোটা চলচ্চিত্রের আবেদনকে নষ্ট করে দিয়েছে। তখনই খেয়াল হলো ওই গোথিক স্ট্রাকচারের বাড়িটি। গোথিক স্ট্রাকচার হলো অষ্টাদশ শতকের স্ট্র্যাকচার। ওরকম একটি ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বসবার ঘরকে কেন বেছে নেয়া হলো? আর সব ধর্ষিতা নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া শারীরিক এবং একই সাথে অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদ না করে, বাইরে বেরিয়ে না পড়ে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপেই বা আশ্রয় নিল কেন? সমাজে শিশুরাও যে ধর্ষিত হয় শুধু এই মেসেজটা দেয়াই কি ছিল এই চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য!
এখন আমরা যে সমাজে বাস করি সেটি অষ্টাদশ শতকের কোনো পর্দানশীন সমাজ নয়। এটি নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার কোনো সমাজ নয়। এখানে ধর্ষণের প্রতিবাদে আওয়াজ তোলাটাই দস্তুর। ধর্ষিতা হওয়া মানে কোনো নারীর জন্য বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে লুকিয়ে থাকা নয়। নির্মাতা আর একটু টেকনিক্যাল হলেই সেই আওয়াজটা অনায়াসে তুলতে পারতেন, নারীর মধ্যে বুনে দিতে পারতেন প্রতিবাদ করার সাহস। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি সে ক্ষেত্রে উদাসীন। আম দর্শকের রুচিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা ভেবে নিশ্চই একজন নির্মাতা শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেন না।
এর চেয়ে ভারতের মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও ধর্ষণের বিরুদ্ধে অনেক সরব হতে দেখা গেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে বাইরে বের হয়ে এসে সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ ও চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করতে দেখা গেছে। সেক্ষেত্রে দেবী হতাশাজনক। দেবী বলতে আমার বুঝি শক্তিময়ী পরাক্রমশালী নারী। দেবী মানে কোনো অত্যাচার কোনো অনিয়মকে না মানার সাহস। অথচ চলচ্চিত্রের এই ‘দেবী’ নারীর দেবী হয়ে ওঠার পরিপন্থী।
মূলত ভোগবাদী সমাজ কৌশলে নারীকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। নারীর শ্রমকে তারা ব্যবহার করে প্রয়োজনে। নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে ঠিক ওই পুঁজির প্রয়োজনেই। প্রকৃত নারীবান্ধব সাহিত্য বা চলচ্চিত্র সব সময় বাহবা পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠে না। দেবী চলচ্চিত্রের কাহিনী বিন্যাস, নির্মাণ কৌশল, আবহ সংগীত এবং শব্দ ক্ষেপণের মন্তাজ এসব নিয়ে কোনো তাত্ত্বিক সমালোচনায় যাচ্ছি না। এগুলো যে উৎরে গেছে বলাই বাহুল্য। অভিনয়ের ক্ষেত্রে বলিউড অভিনেত্রী কাজল, নেহা ধূপিয়া, শ্রুতি হাসান, নীনা কুলকার্নি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির নারীদের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন।