চাল-চুরি কি আদৌ ঠেকানো সম্ভব?

গৌতম দাস

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২০, ০৭:২০ পিএম

আমাদের দেশে প্রচলিত সরকার ব্যবস্থা ব্যাপারটাকে আমরা প্রশাসন বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলে চিনতে শুরু করেছি কয়েক দশক ধরে। তবে অনেকে আবার ভুল করে মনে করে, ব্যাপারটা বোধহয় রাজধানীর বাইরে অর্থে শুধু ব্যবহৃত হয়, যেমন- জেলা প্রশাসন হিসেবে। যদিও প্রশাসন মানে কেবল রাজধানীর বাইরের ব্যাপার নয়, বরং রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের কাঠামোটাকেই বোঝায়। আবার এককালে যেমন সত্তরের দশকে এটাকে প্রশাসন না বলে আরো বৃহত্তর অর্থে ‘সরকার’ বলে বুঝতাম। যেমন আমাদের দেশে এটাকে এরশাদ সরকার, হাসিনা সরকার বা খালেদা সরকার বা ভারতের মোদি সরকার- এরকম বুঝে থাকি। আবার আমেরিকায় এটাকে ট্রাম্প প্রশাসন, বুশ প্রশাসন বলে; কিন্তু সরকার বলি আর প্রশাসন বলি শত কথার শেষ কথাটা হলো- একে ‘ম্যানেজমেন্ট’ বা বাংলায় ‘ব্যবস্থাপনা’ বলে। যার পুরো কথাটা হলো, সরকার পরিচালনায় ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের কর্তৃপক্ষ। যাকে আবার ইতিবাচক চোখে দেখলে অনেকে বলে- ‘বিজনেস ম্যানেজমেন্ট’ আর নেতি দিকগুলোকে বেশি ফোকাস করে বলে ‘আমলাতন্ত্র’। তবে আমলা বা ব্যুরোক্র্যাট শব্দের মূলটা কিন্তু কোনো নেতি অর্থবোধক নয়; কিন্তু জনস্বার্থবিরোধী, দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত ও অবস্থান বা তাদের পাবলিক হয়রানিমূলক আচরণ এবং পদক্ষেপের কারণে ‘আমলা’ শব্দটা যে ইতিবাচক ছিল, তা মানুষ ভুলতে বসেছে।

এককালে যেমন সত্তরের দশকে এটাকে প্রশাসন না বলে আরো বৃহত্তর অর্থে ‘সরকার’ বলে বুঝতাম। যেমন আমাদের দেশে এটাকে এরশাদ সরকার, হাসিনা সরকার বা খালেদা সরকার বা ভারতের মোদি সরকার- এরকম বুঝে থাকি। আবার আমেরিকায় এটাকে ট্রাম্প প্রশাসন, বুশ প্রশাসন বলে; কিন্তু সরকার বলি আর প্রশাসন বলি শত কথার শেষ কথাটা হলো- একে ‘ম্যানেজমেন্ট’ বা বাংলায় ‘ব্যবস্থাপনা’ বলে। যার পুরো কথাটা হলো, সরকার পরিচালনায় ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের কর্তৃপক্ষ। যাকে আবার ইতিবাচক চোখে দেখলে অনেকে বলে- ‘বিজনেস ম্যানেজমেন্ট’ আর নেতি দিকগুলোকে বেশি ফোকাস করে বলে ‘আমলাতন্ত্র’।

বাংলাদেশে এই করোনা সংকটকালে ম্যানেজমেন্ট এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। কেন? কারণ, সোজাসাপ্টা বললে, লকডাউন বাস্তবায়ন করতে চাইলে দিন এনে খাওয়া মানুষকে বাঁচাতে তাদের ঘরে খাদ্য পৌঁছাতে হবে। আর সদিচ্ছা থাকলে এখনো আমাদের রাষ্ট্রের খাদ্য জোগান দিতে সম্পদের স্বল্পতা বলে দৃশ্যমানভাবে কিছু দেখা যায়নি। তাহলে সংকটটা কোথায়?

স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা ছিল ১৯৭৪ সালে। পরবর্তীকালে অনেক সময় ধরে ঠিক দুর্ভিক্ষ নয়, কিন্তু খাদ্যাভাবও বড় দুর্যোগ আকারে হাজির হয়নি। তবে এক বিশেষ অবস্থা তৈরি হয়েছিল ২০০৭ সালের শেষের দিকে, পরপর দুটি বড় ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ‘আইলা’ আঘাত হানাকে কেন্দ্র করে। সেটাও ঠিক দুর্ভিক্ষ নয়, তবে সরকারি চাল ঠিক সময়ে ক্রয় না করার কারণে সর্বনিম্ন স্টক দেড় লাখ টনে নেমে যাওয়ার তথ্য তখনকার খাদ্যমন্ত্রী পাবলিকলি মিডিয়াতে প্রকাশ করেছিলেন। আর এর প্রভাবে বাইশ টাকার চাল একধাপে বিয়াল্লিশ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাজারে হাহাকার নেমে এসেছিল। আর এবারও আরেক বিশেষ অবস্থা বিরাজ করছে। এটা অবশ্যই দুর্ভিক্ষ নয়। যাদের ঘরে এখন খাবার নাই তারাও ঠিক বেকার নয়; কিন্তু করোনা ঠেকাতে লকডাউন কায়েম করতে গিয়ে দিন এনে খাওয়া লোকগুলো ঘরে বন্দি হয়ে  সাময়িক বেকার হয়ে পড়েছেন। এরা অবশ্যই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মার্চের ২৫ তারিখের আগে কাজ করে অন্তত খাওয়া-দাওয়া নিজের সংগ্রহে রাখার যোগ্য ছিল। বেশিরভাগ লোক ইনফরমাল ধরনের কাজ জোগাড় করে আয় করছিল। তাই এরা বেকার নয়। তবে এ অবস্থায় বড় শহরের নিম্নমধ্যবিত্তরাও হাত পাতার অবস্থায় পৌঁছে গেছে। 

এভাবে পরিস্থিতিটা আমাদের রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে একটা চ্যালেঞ্জ বা পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে, যারা সাময়িক এবং অযাচিতভাবে খাদ্যহীন হয়ে পড়েছে তাদের সংকট মেটাবার মতো ‘ব্যবস্থাপনা-জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষতা কী আমাদের আছে?’

মানে এক কথায় সমস্যাটা রাষ্ট্রের ঠিক অর্থনৈতিক সামর্থ্যের না, যার মানে এটা চুয়াত্তরের সংকটের সঙ্গে কোনো মিল নেই। বলা হয় চুয়াত্তরের মূল সমস্যা ছিল মূলত খাদ্য বিতরণের সমস্যা। অর্থাৎ যা স্টকে ছিল সেটাই কড়া বিতরণ ব্যবস্থা করতে পারলে দুর্ভিক্ষটা মারাত্মক হতো না। যদিও এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি স্টক থেকে নিয়ন্ত্রিত বণ্টনের মাধ্যমে অবস্থা সামাল দেয়া যেতে পারে। যেটার পূর্বশর্ত আবার রাষ্ট্রের হাতে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা থাকা, যাতে চাল আমদানি করে বাজার অনুকূলে আনা যায়। এই প্রশ্নেই আমরা চুয়াত্তর সালে হেরে গিয়েছিলাম। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আবার ২০০৭-০৮ সালে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ছিল বলে সেটা ব্যবহার করে বিপুল বেসরকারি এলসি খুলে সংকট মোকাবেলা করেছিলাম। আর তিন মাসের মধ্যে মে ২০০৮ সালে বোরো ধান উঠে যাওয়াতে দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় আইলাও এসেছিল ওই মাসেই; কিন্তু সেটার আঘাত আর তত অসহনীয় হতে পারেনি। কারণ আরো একটা শক্ত মেকানিজম হাজির ছিল। সে সময় সিভিলের পাশাপাশি সামরিক প্রশাসন সক্রিয় ছিল। কারণ সেটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। সে সময় প্রভাবশালী বড় চালকল ও চালের স্টকের শহর ছিল নওগাঁ। সামরিক প্রশাসন নওগাঁ শহরের অলিগলি খুঁজে চালের মজুদদারি নখদর্পণে ও নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। আর এবারের লকডাউনে প্রশাসন ফেল করার বড় ঘটনাটা হলো- গরিব নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দের চালের ব্যাপক চুরির ঘটনা। এপ্রিল মাসজুড়ে পত্রিকার পাতায় ছিল চাল চুরি করে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনা, কোনো কোনো দিন পাঁচ-সাতটা ঘটনাও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব রিপোর্ট বলছে, মূলত ‘১০ টাকার চাল’ (কনসেশন রেটে গরিব তালিকাভুক্ত লোককে বিক্রির জন্য বরাদ্দ দেওয়া চাল), আর দুস্থ তালিকায় বরাদ্দ দেয়া এই দুই ধরনের চালই মূলত সরকারি দলের কর্মী-নেতা বা জনপ্রতিনিধিরা চুরি করেছে নির্বিচারে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ত্রাণ সবকালেই চুরি হয়েছে; কিন্তু তবুও বিতরণের নিয়ম-মেকানিজম নানা সংস্কার এনে অনেক দক্ষতা বাড়ানোও হয়েছে। 

কিন্তু এবার সবাই স্বীকার করবে যে, এটা এক চরম বেপরোয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। তবে এবারের অ্যাকশনগুলো মূলত স্থানীয় সিভিল প্রশাসন বা বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেফতার তৎপরতা লক্ষ্য করার মতো ছিল; কিন্তু মামলা দায়ের বা শান্তি দেয়া অবস্থাটা তেমন কার্যকর ছিল না। কারণ ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে। অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালত মানেই এই মামলা সিরিয়াস না। আর আদালতে যাওয়া মাত্র এটা ডিসমিস হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। সেটা সম্ভব না হলেও অন্তত জামিন নিয়ে বের হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে কেন্দ্রের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়ার কারণে চাল চোরদেরকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে।

এক কথায় বললে খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থাপনা ফেল করেছে। বেপরোয়া হয়ে যাওয়া দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখন সিভিল প্রশাসনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে; কিন্তু মনে হচ্ছে না চাল চুরি থামছে। অর্থাৎ গত ত্রিশ দিন ধরে চাল চুরির ঘটনা সব মিডিয়ায় শিরোনাম হয়ে থাকলেও তা নতুন চাল-চোর ও চুরিকে বিরত, নিরুৎসাহিত বা ভয় দেখাতে পারছে না, পারেনি। যেটা প্রমাণ করে তারা কত বেপরোয়া। আর সরকার তাদের কোনো বিপদে ফেলতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তা এই চাল-চোরেরা মনে করছে, ভয় পাচ্ছে না। এটাই হলো সব ঘটনার শেষ মেসেজ। কাজেই সর্বশেষ ৬৪ জেলায় ৬৪ সচিব দিয়ে ত্রাণ বিতরণ তদারকি করেও কোনো সমাধান আনতে পারবে না। সম্ভবত একটা বড় কারণ, এই সচিবেরাই তো এতদিনের প্র্যাকটিসে সবখানে দলীয় নেতা-কর্মীদের অধীনে বা সহযোগী ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এতদিন জনপ্রতিনিধিরা মনে করত এই ত্রাণ দেয়ার বিনিময়ে হবু ভোটার থেকে আগামীতে ভোট পাওয়ার কমিটমেন্ট পাবে; কিন্তু এখন তারা মনে করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে ত্রাণ বিতরণ করা না করার কোনো সম্পর্কই নেই। কারণ এটা নিশীথ ভোটের যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। নেত্রীর আশীর্বাদই এখানে আসল ব্যাপার। বাকি সব মিথ্যা। এ পরিস্থিতিতে আমাদের বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ভেঙে পড়া চাল চুরি ব্যবস্থা আদৌ ঠেকানো যাবে কি?


গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh