ভূতের গলির সেই বাড়িটা

সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২০, ০৯:৩৬ এএম

চৈতি আমার বান্ধবী। তার বাবা অনেক আগে একটি বাড়ি কিনেছেন ভূতের গলিতে। খুব পুরোনো একটি বাড়ি। কম দামে পেয়েছেন বলে তাড়াতাড়ি করে কিনে ফেলেছেন বাড়িটা। কবে উঠবে বাড়িতে সেই আনন্দে চৈতিরা ছটফট করছে। 

একদিন তারা কেনা বাড়িতে গিয়ে উঠল। বাড়িটির দেয়ালে ও ছাদে অসংখ্য ছিদ্র। চামচিকারা ওড়াউড়ি করছে। ঘরভর্তি পোকামাকড়ের বাসা। বাড়ির দেয়াল কাত হয়ে আছে। মনে হয় একটু ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। 

বাড়ির চারপাশ আগাছায় ভর্তি। বাড়িটির এক কোণে আছে দুটি কদমগাছ আর এক কোণে আছে একটি তেঁতুলগাছ। ভুতুড়ে পরিবেশ। দেয়ালে চোখ পড়ে চৈতির। লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ! মানুষের রক্তের মতো, ছড়ানো-ছিটানো হাতের দাগ। তারপরও খারাপ লাগছে না চৈতিদের। কারণ বাড়িটা এখন নিজেদের। তাই অনেক আনন্দ।

গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। ‘চৈঁতির বাঁবা বাঁড়ি আঁছেন্নি। অ চৈঁতির বাঁপ, বাঁড়ি আঁছেন্নি?’ গম্ভীর গলায় কে যেন ডাকছে। কথাগুলো কয়েকবার কানে এলেও চৈতির বাবা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু মশারি ফাঁক করে যখন বলল, ‘চৈঁতির বাঁবা ঘুঁমাইছেঁন্নাকি, উঁঠেন।’ 

তখন চৈতির বাবা চোখ মেলে তাকালেন। দেখলেন, মশারির বাইরে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ামানুষ! হাত-পা, শরীর, মাথা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চৈতির বাবা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, কে আপনি? কে! ভরা গলায় উত্তর আসে, ‘আঁমি বাঁড়িঅঁলা। এঁই বাঁড়ির মাঁলিক আঁমি। হুঁট কঁরে বাঁড়িতে উঁইঠা পঁড়লেন দেঁহি, আঁমার সঁঙ্গে কোঁনো যোঁগাযোগই কঁরলেন নাঁ, ব্যাঁপারটা কীঁ!’

চৈতির বাবা মোচড় দিয়ে উঠে বসলেন বিছানার এক কোণে। মশারির একটা অংশ স্ট্যান্ডের ওপরে রেখে বললেন, ‘আচ্ছা বসেন ভাই, বসেন।’ একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বললেন তিনি। ছায়ালোকটা ডান-বাও তাকিয়ে বললেন, ‘সঁংসার তোঁ ভাঁলোই পাঁতছেন দেঁখছি। বাঁড়ি কঁই আঁফনের।’ 

চৈতির বাবা অবাক হয়ে নরম গলায় বললেন, ‘এত রাতে এসে আপনি বাড়ি-ঘরের খবর নিচ্ছেন, আগামাথা কিছুই ত বুঝতেছি না ভাই। আপনি কে বলুন ত!’ লোকটার চোখ লাল হতে লাগল। ‘অঁ ঠিঁকই কঁইছেন আঁপনি! আঁগামাঁথা কিঁছুই বুঁঝতেছেন নাঁ? চোঁখ দুঁটো বঁন্ধ কঁরেন। আঁগামাথা বুঁঝাই।’ চৈতির বাবা বন্ধ করলেন চোখ। একটু পরেই লোকটি ধীরে ধীরে বলল, ‘এঁবার চোখ খুলুন। চৈতির বাবা চোখ খুলেই-‘ওরে আল্লারে’ বলে খাট থেকে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।

চৈতির মায়ের ঘুম ভেঙে গেল। ‘আয় হায়! এ কী অবস্থা! কী হয়েছে আপনার?’ এসব বলে কেঁদে কেঁদে চৈতির বাবাকে টেনে তুললেন খাটে। চৈতির বাবা বললেন, ‘পানি দেও।’ পানি খেয়ে তিনি ঝিমুতে লাগলেন। ঘুম থেকে উঠে পড়ল চৈতি। সে কান্না শুরু করে দিল। তার ছোট ভাইটি ঘুম থেকে উঠে চৈতির দেখাদেখি কাঁদতে লাগল। গভীর রাতে এ বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। 

ছায়ালোকটি বলল, ‘চৈঁতির বাঁপ শোঁন্, তোঁর মঁতো আঁমার দুঁটো বাঁচ্চা আঁছে। নঁইলে খাঁমছি মেঁরে তোঁর শঁরীর থেঁকে রঁক্ত বেঁর কঁরে ফেঁলতাম আঁর সেঁই রঁক্ত দিঁয়ে ঘঁরটা রঁং কঁরতাম। সঁকাল আঁটটার আঁগে বাঁড়ি ছেঁড়ে চঁলে যাঁবি। গেঁলাম।’ -বলেই শোঁ করে চলে গেল ছায়ালোকটা।

ভয়ে সবাই কাঁপছে। কোনো রা নেই কারও মুখে। সকালবেলা। চৈতিরা বাড়িটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সবারই মন খুব খারাপ। বাড়ির উঠোনে একটা আমগাছ। এমন সময় গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ল দুটো শিশু। তারা ছুটে এসে চৈতির হাত ধরে বলল, ‘কঁই যাঁও তোঁমরা? যেঁতে দেঁব নাঁ তোঁমাদের। 

চৈতি বলল, তোমরা কে? এভাবে আমাদের থাকতে বলছ কেন? এখানে থাকলে আমরা ভয়ে মরে যব। একটা ভূত গতকাল রাতে এসে আমাদের চলে যেতে বলেছে। থাকলেই বিপদে পড়ে যাব আমরা। শিশু দুটো বলল, এঁটা আঁমাদের বাঁড়ি। আঁমার বাঁবা খুঁব খাঁরাপ। তোঁমাদের চঁলে যেঁতে বঁলেছে বুঁঝি? কিন্তু আঁমরা তোঁমাদের যেঁতে দেঁব না। তোঁমরা হঁবে আঁমাদের খেঁলার সাঁথি। বাঁবা যঁদি কিঁছু বঁলে সেঁটা আঁমরা দেঁখব। তোঁমরা অঁবশ্যই থাঁকবে এ বাঁড়িতে। তোঁমরা আঁমাদের বঁন্ধু। 

চৈতির ছোট ভাই বলল, ‘ভূতে আর মানুষে কি বন্ধু হয়?’ ভূতের মেয়ে বলল, ‘হবে না কেনরে বাপু! মানুষ সবার বন্ধু হতে পারে।’

চৈতিরা থাকতে লাগল বাড়িটিতে। দিনে দিনে খুব বন্ধু হয়ে গেল ভূতের বাচ্চা দুটোর সাথে। একসাথে খেলে আর আনন্দ-হাসি-গান। চৈতির অনেক বুদ্ধি আছে। সে ভূতের বাচ্চাদের গল্প আর ছড়া শোনায়। ভূতের বাচ্চা দুটো আনন্দে লাফালাফি করে বলে, ‘আঁরও বঁলো, আঁরও শুঁনব।’ 

চৈতি এদের লেখাপড়া শেখাতে লাগল। এরা মানুষের রূপ ধরে স্কুলে যায় আর পড়ালেখা করে। এভাবে ভূতেদের সঙ্গে চৈতিদের বেজায় খাতির হয়ে গেল। তাই তাদের আর কোনো ভয় নেই। বাড়িতে চোর-ডাকাত আসতে পারে না। কী মজা! পরদিন রাতে কিন্তু বুড়ো ভূতটা এসেছিল। সাথে এসেছিল বাচ্চা দুটো। 

ভূতটা বলেছে, ‘আঁর তোঁমাদের ভঁয় নেঁই, আঁমার বাঁচ্চা দুঁটো তোঁমাদের বঁন্ধু বঁলেছে! আঁমিও আঁজ থেঁকে তোঁমাদের বঁন্ধু হঁলাম।’  

তারপর থেকে কত লোক রাতের বেলা এই বাড়ির সামনে কত ভয়ংকর কী যেন দেখেছে! বিস্তারিত কেউ বলতে চায় না। আবার কেউ যদি এই বাড়িতে চুরি করতে আসত তাহলে লোকে দেখত বাড়ির সামনের আমগাছে চোর লোকটার পা ওপরে আর মাথা নিচে ঝুলে আছে। দিনের আলোয় লোকেরা এ দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে যায়। 

ঝুলন্ত চোরটা কখনো সবার সামনে শূন্য থেকে ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে। এলাকার মানুষের কাছে চৈতিরা বিস্ময়! কী করে থাকে তারা! আজ ষোলো বছর হলো-চৈতিরা এখানে থাকে। আর সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে ভূতের গলির সেই বাড়িটা!

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh