কভিড-১৯
অনিক আহমেদ
প্রকাশ: ২২ মে ২০২০, ০২:০৯ পিএম
একজন সদালাপী, হাসিখুশি এবং বিনয়ী প্রকৃতির মানুষ। চলমান সময়ে সারাবিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া করোনাভাইরাস তথা কভিড-১৯ এর শনাক্তকারী কিট উদ্ভাবন করে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। যদিও তার দীর্ঘজীবনে এটিই প্রথম সাফল্য নয়। অণুজীব বিজ্ঞান নিয়ে ১৪টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট রয়েছে তার নামে। তার বিভিন্ন উদ্ভাবনের সুফল ভোগ করছে বিশ্ববাসী। বলছি ড. বিজন কুমার শীলের কথা। বর্তমান সময়ে তাকে আলাদাভাবে পরিচয় করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অধীনে কিট উদ্ভাবন করে বর্তমানে দেশবাসীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিনি।
কৃষক পরিবারের সন্তান ড. বিজনের জন্ম ১৯৬১ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায়। বাবা রসিক চন্দ্র শীল ও মা কিরণময়ী শীলের ৬ ছেলেমেয়ের মধ্যে বিজন ছিলেন পঞ্চম। প্রাথমিক শিক্ষা নেন বনপাড়ার সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল থেকে এবং উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন পাবনার বিখ্যাত সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে। ছোটবেলা থেকেই তুখোড় মেধাবী বিজন ডিভিএম (ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন) ডিগ্রি লাভ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে। একই প্রতিষ্ঠান থেকে অণুজীব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের দ্য ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ডেভেলপমেন্ট অব মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে পিএইচডি (ডক্টর অব ফিলোসোফি) ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে জীবাণু নিয়ে গবেষণার যে সূচনা তিনি করেছিলেন, তা আর থেমে থাকেনি। একে একে ছাগলের পিপিআর (পেস্টি ডেস পেটিটস রুমিন্যান্টস) ভ্যাকসিন, ডেঙ্গু, সার্স, করোনাভাইরাস এবং সর্বশেষ কভিড-১৯ নিয়ে কাজ করছেন।
গবেষণার জগতে এই যে বিশাল পথ পাড়ি দেয়া, আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের যে নেশা তার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? জানতে চাইলে স্বভাবসুলভ মুচকি হাসিতে বললেন, ‘আমার চিরকালই অভ্যাস ছিল, কোনোকিছু দেখে সেটাকে মডিফাই করে নতুন কিছু তৈরি করা। কোনো একটা টেকনিক দেখলে হুবহু তৈরি না করে আমি চেষ্টা করতাম সেটাকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়। ওই টেকনিকে কোথায় ভুল আছে, সেটি বের করে আপডেট করার প্রবণতা ছোটবেলা থেকেই ছিল।’
১৯৯৯ সাল। একাডেমিক শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি তখন সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) কর্মরত। ওই বছর হঠাৎই সারাদেশে গবাদিপশু বিশেষ করে ছাগলের মড়ক শুরু হয়। পিপিআর ভাইরাসে (গোট প্লেগ) আক্রান্ত ছাগলের মড়ক ঠেকাতে উদ্ভাবন করেন পিপিআর ভ্যাকসিন। যুগান্তকারী এই উদ্ভাবন সম্পর্কে তিনি জানান, ‘রোগটির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমি দ্রুতই কাজ শুরু করি। উদ্ভাবনকৃত ভ্যাকসিনটির নাম দিই শহীদ টিটো স্ট্রেইন। ওই ভ্যাকসিনের ফলে সে সময় লাখ লাখ ছাগলের প্রাণ বাঁচে।’ এরপর আফলাটক্সিন দ্বারা আক্রান্ত মুরগিকে বাঁচাতে তিনি উদ্ভাবন করেন আফলাটক্সিন ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনও সে সময় মুরগির প্রাণ বাঁচিয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।
২০০০ সালে বাংলাদেশে শুরু হয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। ড. বিজন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ওই সময় তারা একটি টেস্ট ডেভেলপ করেন। সেটি হলো, গ্লাসের ওপর এলাইজা (এনজাইম লিঙ্কড ইমিউনোসরবেন্ট আসেই)। এটি ছিল ব্যতিক্রম একটি পদ্ধতি। কারণ, এলাইজা মূলত করা হয় প্লাস্টিকে। তিনি এই থিওরি ফ্রান্সে একটি সেমিনারে সাবমিট করেন। তখন এটা বেশ সমাদৃত হয়। যার ওপর ভিত্তি করে সিঙ্গাপুর থেকে ড. বিজনকে তখন ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করার জন্য ডাকা হয়েছিল।
২০০২ সালে ড. বিজন সিঙ্গাপুর সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে সারাবিশ্বে সার্স করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ড. বিজন তখন ডেঙ্গুর কাজ আপাতত বন্ধ রাখেন। সিঙ্গাপুরে তিনি কয়েকজন গবেষককে নিয়ে সার্সের ওপর কাজ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা কার্যে আমরা যে পরীক্ষাগার ব্যবহার করতাম, তা সরকার অনুমোদিত ছিল। আমরা নিজেরা একটা টেস্ট ডেভেলপ করি, যার নাম দিই- এলাইজা ডট ব্লট র্যাপিড টেস্ট। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সার্সের কিট তৈরি করতে সক্ষম হই। এটা দিয়ে ওই সময় সার্স ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম দিকে সময় লাগতো দেড় ঘণ্টা। পরে আমরা এটিকে সফলতার সঙ্গে ১৫ মিনিটে নামিয়ে আনি। বর্তমানে কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে আমরা আরো আপডেট করেছি। এখন সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটেই করোনাভাইরাস শনাক্ত করা যাবে।’ সার্স প্রতিরোধে উদ্ভাবনকৃত এই পদ্ধতি ড. বিজন কুমার শীলের নামে পেটেন্ট করা। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয় এবং সফলভাবে সার্স মোকাবেলা করে।
পিপিআর ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে সার্স করোনাভাইরাস, একেকটি যুগান্তকারী উদ্ভাবনের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ড. বিজন কুমার শীল। তবে এই গল্পটা শুনতে যতটা সহজ লাগছে, পর্দার আড়ালের গল্প ছিল ততটাই কঠিন। নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। নিজ মুখেই জানালেন সেই কঠিন বাস্তবতার কথা, ‘পরীক্ষাগারে টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যেতাম। আমরা যখন কাজ করি, তখন আশানুরূপ ফলাফল না আসলে অনেকেই মন খারাপ করে; কিন্তু আমি কখনোই মন খারাপ করতাম না। আমি মনে করতাম, নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আমার ভুল আছে। আমি ভুলটাকে খুঁজে বের করে সংশোধন করতাম।’
বর্তমানে কভিড-১৯ নিয়ে চলমান পরিস্থিতির মাঝেই দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রয়োজন পড়লে সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় ডেঙ্গুর কিট দেয়ার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে ড. বিজন বলেন, ‘ডেঙ্গুর কিট আমার অলরেডি তৈরি করা আছে। ওটা একদম প্রমাণিত। চার বছর আগে আমি ভারতে এটি তৈরি করেছিলাম, যাতে ওই দেশের সরকারের অনুমোদনও আছে।’
তিনি আরো জানান, ‘ডেঙ্গুর ওই টেকনোলজি আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসছি। আশা করছি, এক মাসের মধ্যেই এটি চলে আসবে। তখন এখানেই কিট তৈরি করব। সামনেই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হবে। সমস্যা হচ্ছে, বড় বড় দেশগুলো রফতানি বন্ধ করে দিচ্ছে। ভারত থেকেও কোনো ধরনের র্যাপিড টেস্ট কিট বাইরে আসতে দিচ্ছে না। আমার মূল জিনিসটা ভারতেই ছিল। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা ২৫ হাজার কিটের অর্ডার দিয়েছি। খুব তাড়াতাড়িই চলে আসবে।’
সার্স করোনাভাইরাসের ওপর কাজ করার সুবাদে ড. বিজন কভিড-১৯ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। সার্সের সঙ্গে এই ভাইরাসের ৮০ শতাংশ মিল রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই এ নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা জানুয়ারির ২৩ তারিখে কাজ শুরু করেছি। ২০০৩ সালে যেহেতু এটা ডিল করেছি, আমি জানি এ ভাইরাসের চরিত্র। এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ স্যারকে অবগত করলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি যেহেতু টেকনিক জানো, তাহলে কাজ শুরু করো। যখন ডিসেম্বরে চীনে সংক্রমণ শুরু হলো, ওই সময় ছিল নিউ ইয়ার। নিউ ইয়ারে ২০০-২৫০ মিলিয়ন মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যান। আমার আশঙ্কা ছিল, রোগটা ছড়াবে। কারণ, চীনারা সারা পৃথিবীতেই আছে। নিউ ইয়ারে অংশগ্রহণ করতে যারা যাবে, তারা ফিরে আসার সময় ভাইরাস নিয়ে আসবে। ঠিক এটাই ঘটেছে। এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।’
ড. বিজন আরো জানান, ‘যদি কোনো নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব হয়, তাহলে এর কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। এরা সর্বগ্রাসী হয় এবং এদের জিনগত মিউটেশন (রূপান্তর) ঘটে।’ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকৃতি সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা, ‘আপনারা খেয়াল করবেন, চীন এবং ইতালিতে যে ইনফেকশন হয়েছে সেটা কিন্তু ভিন্ন। ইতালিয়ান ভাইরাসটাই পরে বাংলাদেশে আসছে। আমার ধারণা ছিল বলেই তখন আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। তবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যায় না বলে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।’ ড. বিজনের আশাবাদ, ‘সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী কিছুদিনের মাঝে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কিট বাজারজাতকরণ সম্ভব হবে।’
কিটের বিশেষ সুবিধা সম্পর্কে ড. বিজন বলেন, ‘কিছু মানুষ উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই টেস্টের জন্য আসে। আবার কিছু মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কাজ না হলে তখন আসে। অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি দুটি টেস্ট করলে রোগী যখনই আসুক, কারও মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ জন্য আমরা সবাইকে দুটি পরীক্ষা করার জন্যই উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, একজন রোগীর শনাক্তকরণ যদি মিস হয়, তাহলে তিনি আশপাশের মানুষকে সংক্রমিত করবেন। আমরা এ সুযোগটা দিতে চাচ্ছি না।’
ড. বিজন কুমার শীল চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী। সহকর্মীরাও তাকে নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদের শিক্ষক ড. জামিনুর রহমান বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে বিজন স্যার অত্যন্ত মিষ্টভাষী এবং বিনয়ী প্রকৃতির। তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তিনি একজন জাত গবেষক। আমি আশা করছি, তার উদ্ভাবনকৃত কিট শিগগিরই অনুমোদন পাবে এবং জাতির প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
তরুণ গবেষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানের জগতে সামনে চলতে হলে বাধা থাকবেই; কিন্তু বাধাকে শিক্ষার বস্তু মনে করতে হবে। তাতে কাজটা সহজ হয়ে যায়। ভালো কোনো কাজ করতে গেলে সেটির সমালোচনা, বিরোধিতা হবে এটিই স্বাভাবিক। সবকিছু মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। তাহলেই সামনে এগোতে পারবেন, নইলে পিছিয়ে পড়বেন। বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছি বলেই আজকে আমি এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।’