লেখকদের ঈদভাবনা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২০, ০১:০৯ পিএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২১, ০১:৪৯ পিএম

চলছে করোনাকাল। আর এর মধ্যেই ঈদুল ফিতরের আগমন ঘটলো। প্রতিবারের চেয়ে এবারের ঈদ ভিন্ন। আতঙ্কের কারণে নেই ঈদের আমেজ, মানুষের মনে নেই শান্তি। এবারের ঈদ নিয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের মতো লেখকদের ঈদ ভাবনাও ভিন্ন। করোনাকালীন ঈদ নিয়ে লেখকরা কী ভাবছেন তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো: 

মহামারি চিরতরে বিদায় হওয়ার নয়: নাসরীন জাহান


মহামারির এই পরিস্থিতিতে ঈদ উদযাপনের কথা কল্পনাই করা যায় না। এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতি যে রকমটা চলছে, এই সময়টায় আসলেই কিছু লিখতে পারছি না। আমি সাধারণত উপন্যাস, গল্প কাগজে কলমে লিখি। আমি কম্পোজ করতে পারি- কিন্তু প্রথমে হাতে লিখি, তারপর কম্পিউটারে লিখি। আমি আসলে কম্পিউটারে লিখতে গেলে, লেখার আত্মার ভেতরে ঢুকতে পারি না। যার ফলে আমি লিখতে পারছি না কয়েক লাইন লিখতে গেলেই আর পারছি না। যার ফলে দু’বছর ধরে কবিতা লিখছি। ইনফ্যাক্ট করোনার প্রভাবের ভেতরে এক একটা করে পার্ট উঠে আসছে কবিতায়। জোরালোভাবে উঠে আসছে। আগে কবিতা হতে হবে তার পরে ভিতরের ব্যাপারটা। এর মধ্যে অনলাইনে কলকাতা সুইডেন থেকে কানাডা থেকে বিশেষ করে কলকাতা থেকে লেখক আড্ডা গ্রুপে, একক কবিতা পাঠ করেছি এগুলো মিডিয়ার মাধ্যমে যারা দেখেছে তারা পেয়েছে। আর আমি এখন এত বিষণ্ণ এবং বিপর্যস্ত এত খারাপ অবস্থায় আমি প্রতিদিন কল্পনা করি আমাদের সৃষ্টিকর্তা ওছিলায় ডাক্তাররা এত এত চিকিৎসা করে মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে ফেলে।

সেই ডাক্তাররাই কিছু করতে পারছে না একটা ছোট্ট ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষদের। এই সময় আমি সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করতে পারছি। তিনি যদি না চান এর বাইরে কারও কিচ্ছু করার ক্ষমতা নাই চোখে দেখা যায় না এমন একটা ভাইরাস পাঠিয়েছেন। আমেরিকার মতো এমন বড় দেশও পারছে না। আমাদের এখানে তো অনেক কম আক্রান্ত হয়েছে, ওরা তো আরও বেশি ধ্বংস হওয়ার পর্যায়ে এখন। আমাদের দেশ-বিদেশি কেউ আসলে ভয় পেয়ে যেতাম কিছুদিন আগেও যে ওদের দ্বারা আমাদের দেশেও ছড়াবে।

আমরা ধনী রাষ্ট্র না, ওরা শিক্ষিত দেশের মানুষ- ওদের খাওয়া-পরার অভাব নাই, যথেষ্ট পরিমাণ সচেতন, তারা নিয়ম পালন করতে পারে। আমাদের এই গরিব দেশে কি করার আছে নিয়ম মানা অনেক কঠিন। এর মধ্যে অনেকের চাকরি চলে গেছে, ভাড়াটিয়ারা ভাড়া দিতে পারছে না, নাছোড়বান্দা মালিকরা। দিনমজুরের অবস্থা খারাপ, নিম্নবিত্তরা অসহায়, মধ্যবিত্তরা ত্রাণের কথা তো ভাবতেই পারে না; কিন্তু বেতনহীন পরিবারগুলো এদের কি অবস্থা এইসব ভাবলে খুব অধৈর্য লাগে। যার ফলে সবাই বলে এখন মন ভালো রাখতে হবে, নিজের মন যতটা শক্ত রাখা যায়। যে কারণে আমি মাঝে মাঝে মুভি দেখি- আর্ট ফিল্ম যেগুলো, আর বই পড়ি যেহেতু নতুন বই পড়তে পারছি না। পুরনো যে বইগুলো খুব পীড়নময় ওই বইগুলোই টানছে আমার মন। 

আমরা তো অত স্মার্ট না। আমাদের তো অতো আধুনিক প্রযুক্তি নেই। তবুও আমি খুব আশাবাদী মানুষ কিন্তু মহামারির জন্য হতাশ ও খারাপ লাগে। এই ভাইরাস এত ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম, এটা এক মাসে বা অল্প দিনে এক-দুই বছরে নির্মূল হয়ে যাবে এমন তো বলা যায় না। যে দেশগুলো আমাদের মতো গরিব দেশ এগুলোর শিক্ষা একাডেমি ধ্বংস হয়ে যাবে, ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে। আর আক্রান্তের হার এখন আমাদের দেশে বাড়ছে, লকডাউন শিথিল করা কেন, করবেইবা না কেন? মানুষের আগে ক্ষুধা তার পর করোনা। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশের বাস্তবতা। আগে মানুষ মৃত্যুকে বেশি ভয় পেতো এখন ক্ষুধাকে বেশি ভয় পায়। এমন বাস্তবতা আমি আগে কখনো দেখিনি। বন্যার্ত এলাকায় দেখেছি কিছু, তখন ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সাহায্য করতে পেরেছে-  এখন কে কাকে সাহায্য করবে?

পৃথিবীর বড় দেশগুলো নিজেদের অর্থ খাটাতে ভয় পাচ্ছে, ধনী দেশের পতন হলে- তারা আবার অন্যকে কি সাহায্য করবে? আমাদের সমস্যা হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সাহায্য পেতাম। আর আমাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে গার্মেন্টস ব্যবসা। এই অবস্থায় কি স্বপ্ন দেখব কি ভাবব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা নিজেদের ঘরে ঘরে যতটা সম্ভব সাবধান থাকি। যখন শুনলাম যে হোয়াইট হাউসেও করোনা ঢুকে গেছে তখন আর কোনো ভাষা রইল না। তাহলে আর আমরা কি সাবধান হবো, কোনটা ঠিক। যে এই চারটা নিয়ম মানলে ঠিক হয়ে যাবে, যখন চিকিৎসকরা নিয়ম বদলায়, এরকম না ওরকম করে চিকিৎসা নিন।

যেখানে তারাই বিভ্রান্ত সেখানে কী বলার থাকে। ভয়ংকর বাস্তবতা যে অনেকের না কি করোনার কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না, তারা আক্রান্ত হচ্ছে এটা তো খুব মারাত্মক ব্যাপার। আনিস স্যারের মতো মানুষ চলে গেলেন। উনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুব নিবিড় ছিল। তিনি একদিকে শিক্ষক আবার বন্ধুর মতো মিশতে পারতেন সবার সঙ্গে। এইরকম ব্যক্তি যখন হাসপাতালে ভর্তি হলেন আমরাতো ওনার কাছের মানুষ শুনেছিলাম এবার আর উনি ফিরবেন না। ডাক্তাররা চেষ্টা করেও জ্ঞান ফিরছে না অনেকের আশঙ্কা ছিল, মধ্যে থেকে কি হলো করোনা ধরা পড়ল। 

এই যে বাণিজ্যিক মিডিয়া, বাণিজ্যিকীকরণ করে কি মজা পায় ওরা, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মিডিয়ার চাপেই হয়তো হয়েছে এটা; কিন্তু ডাক্তাররাও বলছেন উনি করোনায় মারা যাননি। আমি চার-পাঁচটা পত্রিকা রাখি সবগুলোতেই হেডলাইন দেখলাম উনি করোনায় মারা গেছেন। মানে মিডিয়া হাইলাইট করছে করোনায় মারা গেছেন। এই যে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল- বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান করোনায় মারা গেছেন, এটা আমার জন্য খুব দুঃখজনক। করোনা যে লজ্জার ব্যাপার তা না। শুধু করোনাকে হাইলাইট করার একটা সুন্দর পথ পাওয়া গেল। কলকাতায় তো আনিসুজ্জামানের বিশাল বিস্তার, ওরা ওখানে কি করবে ওরা যা পাবে তাই করবে। এই অবস্থায় কিছুই বলবার থাকে না। গবেষকরা বলছেন- মহামারি করোনা চিরতরে বিদায় হওয়ার নয়, সত্যি এ এক ভয়ানক উদ্বেগ তৈরি করেছে আমার মনে।

মিলে মিশে জয় করুন বিপদের মহামারি: হায়াৎ মামুদ


আমরা এখন অত্যন্ত খারাপ সময়ের মধ্যে বাস করছি। মহামারি করোনা থেকে কোনো পরিত্রাণ দেখতে পাচ্ছি না। সমাজের যারা মান্যগণ্য মানুষ তারা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আনিসুজ্জামান স্যারের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষের এই প্রস্থান আমাদের হতভম্ব করে দিয়েছে; কিন্তু আমরা এত অসহায়- যে এ অবস্থা থেকে কোনো মুক্তি দেখতে পাচ্ছি না। এই অসহায়ত্ব প্রকাশ করা যায় এমন কোনো ভাষা নেই আমার কাছে।

আমি সারা জীবনতো শিক্ষকতা করেছি, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছি। আর নিজের জন্য কেবল লিখেছি। পড়া আর লেখা ছাড়া তো কিছু করতে পারি না। তো এখনো সেই পড়াশোনার মধ্যেই আছি, লেখার মধ্যেই আছি।

এখন রমজান মাস চলছে, চারদিকে মহামারি- সারা পৃথিবীতে মানুষ বিপন্ন। ধনী থেকে দরিদ্রতম রাষ্ট্র সব জায়গায় একই দৃশ্য। কে ধনী, গরিব তা বিচার্য নয়- সকলে আজ এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছি। মানুষের মধ্যে কেবলই উৎকণ্ঠা। সকলেই ছুটছে যেন একটু স্বস্তি আর সুস্থতার আশায়।

আমাদের এদেশে মুসলমানদের বৃহত্তম উৎসব ঈদ। অন্তত বাঙালি মুসলমানদের জন্য। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও তাই। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এই দুটি ঈদ মুসলমানের বড় উৎসব। ঈদের উৎসব আসন্ন; কিন্তু মানুষ তো কাজহীন, চাকরিহীন। কারও হাতে টাকা নেই। খাবারের জন্য ত্রাণের চাল খুঁজছে, কে কাকে আজ সাহায্য করবে! সকলেই আজ নিরুপায়। এমন সময়ে সকলে সকলের পাশে সামর্থ্য মতো সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত।

একজন শিক্ষক হিসেবে কিংবা লেখক হিসেবে আমার এই নিবেদন দায়িত্বশীল সর্বস্তরের মানুষের কাছে, যেন আসন্ন উৎসবটি নিরানন্দের না হয়ে যায় ওইসব মানুষদের জন্য- যাদের দু’বেলা খাবারের জোগান নেই ঘরে- সাধ্যমতো সেই চেষ্টাটাই আজ আমাদের করা উচিত, না হলে সেটা হবে আমাদের জন্য বড় অপরাধ। অন্তত শিশুদের দিকে তাকান, অন্তত ভুখা দরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষদের দিকে তাকান- সবাইকে সাহায্য করুন। মিলে মিশে জয় করুন এই বিপদের মহামারির সময়কে, তবেই হবে মানুষের বড় পরিচয়।

দুঃসময়ের ঈদভাবনা: আফসানা বেগম


যারা বিশেষভাবে আনন্দে মেতে ওঠার উপলক্ষ্য হিসেবে ঈদকে পেয়ে থাকেন তাদের জন্য এবারের ঈদ দুঃখজনক। করোনাজনিত লকডাউনের মধ্যে এবারে দিনটি হয়তো উৎসবের আমেজবিহীন পেরিয়ে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে কৈশোরের পরে ঈদ নিয়ে আমার তেমনভাবে উত্তেজনায় মেতে ওঠা হয়নি। বাবা-মা বেঁচে থাকবার সময়ে ঈদগুলো ছিল কেবলই উপভোগের। সকাল সকাল গোসল, কড়কড়ে কাপড়ের স্পর্শ, আত্মীয়-বন্ধুদের আনাগোনা, সৃজনশীল কোনো খাবার সাজাতে মায়ের ব্যস্ততা-এসব ছিল ঈদের সাধারণ অভিজ্ঞতা।

একসময় বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে যেতাম। তাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড়দের সালাম করে নিজের নতুন সাজ-সজ্জা দেখিয়ে আসা অদ্ভুত আনন্দের ছিল বটে; কিন্তু পিছুটানের মতো টেনে ধরত মায়ের অনুরোধ, যে যেখানেই যাই না কেন দুপুরে সবাইকে একসঙ্গে বাড়িতে খেতে হবে। স্বাধীন চলাফেরার মাঝখানে দিনের মধ্যভাগে শহরের আরেক প্রান্ত থেকে বাড়ি ফিরে আসার তাগিদ বড় অত্যাচারের মতো মনে হতো। আজ এত বছর বাদে মনে হয় জীবনের সবকিছুর বিনিময়ে ওরকম অত্যাচার একদিনের জন্য হোক। শুধু একদিন, একটা কোনো ঈদের দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

দেশের বাইরে থাকতে থাকতে ঈদ আয়োজন নিয়ে আলগা আবেগ নিজের অজান্তেই কবে যেন জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। তাই ঈদকে বেশিরভাগ সময়ে সাধারণ একটা ছুটির দিন ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ হয় না। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত সময়ে মৃত্যুচিন্তা, জাতীয় এবং বৈশ্বিক ভরাডুবির চিন্তায় ঈদের আনন্দ মনে ঠাঁই পাচ্ছে না। এখন ঈদ ভাবলেই মনে হচ্ছে যত মানুষ ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করত তাদের দুর্দশার কথা।

এই ঈদে আমাদের লক্ষ্য হবার কথা সাধ্যমতো আশপাশের অন্তত দু’একজন মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। লকডাউনের সময়টাতে যত মানুষ কর্মহীন, আয়হীন তথা লকডাউন-পরবর্তীকালে যত মানুষ ছাঁটাইয়ের শিকার হবে, সামগ্রিকভাবে সম্ভব না হলেও নিজ নিজ জায়গা থেকে কাউকে সাহায্য করার মধ্যে দিয়েই যেন আমাদের ঈদ-আনন্দ সার্থক হয়ে ওঠে। ঈদে সমবেত আনন্দের পরিবর্তে এবারে এরকম কিছু আয়োজনের প্রত্যাশা রাখি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh