রাজস্ব আদায়ের সহজ জায়গা কলরেট!

এ আর সুমন

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২০, ০৯:০২ এএম

‘বাজেট ঘোষণার পর থেকে মোবাইলে কথা বলতে গেলেই থমকে যাচ্ছি। কথা শেষ করে কলচার্জ দেখে মনে হচ্ছে, মোবাইল ব্যবহারের সেই প্রারম্ভিক যুগে ফিরে গেছি! এটা কেমন কথা, প্রতি বছর বাজেট এলেই মোবাইলের কলরেট বাড়াতে হবে!’ 

কথাগুলো বেশ আক্ষেপের সঙ্গেই বলছিলেন মানবাধিকার কর্মী জিমি আমির। 

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মানুষ যাতে ঘরে থাকে, টেলিফোনেই প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিতে পারে, এজন্য অনেক দেশে এই করোনাকালে মোবাইল ফোনে কিছু ফ্রি টকটাইম দেয়া হয়েছে। আমরা চলেছি উল্টো পথে। এবার বাজেটে বাড়ানো হয়েছে মোবাইল কলরেট। এখন আপনি ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সেখান থেকে ২৫ টাকা নিয়ে নেবে সরকার। এনবিআরের চেয়ারম্যান এক অসাধারণ যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন- বর্তমানে কলরেট অনেক কম, তাই অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে! আচ্ছা, উনি কি করে বুঝলেন- মানুষ অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে? তাছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা কোনগুলো?’

বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর কর আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। এই দফায় সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা গত বছরও একই হারে বাড়ানো হয়েছিল। 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেন, এতে নতুন করে এই কর বাড়ানো হয়। বাজেটে কর প্রস্তাব ঘোষণার পরপরই কার্যকর হয়। ফলে বাড়তি কর টেলিযোগাযোগ কোম্পানি নিজেরা বহন না করলে গ্রাহকের ওপর চাপবে। 

নতুন করহারে মোবাইল সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ১৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ ও সারচার্জ ১ শতাংশ। ফলে মোট করভার দাঁড়িয়েছে ৩৩.৫৭ শতাংশ। এর মানে হলো, প্রতি ১০০ টাকা রিচার্জে সরকারের কাছে কর হিসেবে যাবে ২৫ টাকারও বেশি, এত দিন যা ২২ টাকার মতো ছিল। 

বিশ্লেষক ও কোম্পানিগুলো বলে আসছিল, মোবাইল সেবায় কর বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষ চাপে বেশি পড়বে। মোবাইল সেবার ওপর কর প্রায় প্রতি বছরই বাড়ে। 

এনবিআর ও মোবাইল অপারেটরদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোবাইল সেবার ওপর ১ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরোপ হয় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ও ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক আরো বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আর এবার বাড়ল নতুন করে আরো ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক। 

গত মার্চের শেষে দেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৩ লাখেরও বেশি। এ তালিকায় শীর্ষ ধনীরা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দরিদ্র মানুষ। তবে দরিদ্রের সংখ্যাই বেশি। মহামারির এই সময়ে যখন পারস্পরিক যোগাযোগ, লেখাপড়া ও ব্যবসা-বাণিজ্য মোবাইলে কথা বলা ও অনলাইনভিত্তিক হয়ে উঠছে, সেই সময়ে এই সেবার ওপর কর বৃদ্ধি গ্রাহকের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাবের সাথে সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো ও ডাটা ব্যবহারের খরচ বেড়েছে। কেন বাজেটে বারবার মোবাইল ফোন কলরেট বা এই খাতে কর আরোপের বিষয়টি বেছে নেয়া হচ্ছে! 

সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান সাম্প্রতিক দেশকালকে এ বিষয়ে বলেন, ‘মূলত ফোন কলরেটকে টার্গেট করার কারণ একদম সোজা। আপনি এই খাতে সহজে কর আরোপ করতে পারবেন, তা আদায় করতে পারবেন, রাজস্ব ঘাটতি পূরণ হবে। সেজন্য সরকার এই খাতকে রাজস্ব আদায়ের সহজ লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। সরকারের লক্ষ্য হলো রাজস্ব আদায় করা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সহজ পথ হিসেবে এটাকেই বেছে নেয়।’ 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কলরেট কম, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়, আমাদের দেশের জন্য এটা কতটুকু যৌক্তিক- জানতে চাইলে তৌফিকুল বলেন, ‘যৌক্তিকতা তো মোটেও নেই; কিন্তু কেন হবে না বলুন! সরকার বাজেটে ধনীদের কর কমিয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন করপোরেট ট্যাক্স কমেছে, প্রণোদনা দিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, জায়গায় জায়গায় কর ছাড়ের ব্যবস্থা করেছে। এখন এই কর তো আদায় করতেই হবে, সেটা যেভাবেই হোক। তা কীভাবে হবে! তখন এনবিআর মোবাইল কলরেটকে বেছে নিয়েছে। কারণ এখানে করারোপ করা হলে তা সোজা বের হয়ে চলে যায়, মানুষ কিছু বলতেও পারবে না, বুঝতেও পারবে না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বিষয়টা বলা যায় ম্যাগি নুডলসের মতোই, সহজেই হয়ে যায়। সরকার একটা ভ্যাটের মেশিন বসাতে গেলেও নানা সমস্যায় পড়ে, ভোগান্তিতে পড়ে। সেখানে মোবাইল কলরেট বাড়ানো তো খুব সহজ পথ। সেজন্য প্রায় বছর আমরা এই খাতে করারোপের বিষয়টি দেখতে পায়। যদিও এই করারোপ করা সামষ্টিক ভোক্তাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। চাপ পড়ে।’ 

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আয়-উপার্জনে টান পড়ার মধ্যে এই খরচ বৃদ্ধি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। 

ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সহজলভ্য হওয়া উচিত। দেশের এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বা লকডাউনের সময়টায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন একমাত্র মাধ্যম ছিল। এ পরিস্থিতিতে অল্প দূরত্বেও কথা বলার জন্য মোবাইল ব্যবহার করতে হয়। সবখানেই আমাদের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি চলছে। কেন? প্রতিবেশী দেশ ভারতে দেখেন কলরেট কম, আমাদের উল্টো বাড়ছে। এটা জনগণের ওপর অনিয়ম ছাড়া কিছু নয়।’ 

এই সময়ে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবে হতাশা জানিয়ে তা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব এস এম ফরহাদ বলেছেন, ‘দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এমনিতেই মানুষের মধ্যে যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, মোবাইল মাধ্যম হয়ে উঠেছে সব যোগাযোগের মূল চালিকা ও দেশ ডিজিটাল ইকোনমির দিকে এগিয়ে চলছে; ঠিক সে সময় এ ধরনের করের বোঝা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এ বোঝা দরিদ্র মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়বে ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে উঠবে, যা করোনাভাইরাস সংকটের কারণে আরো বাড়বে।’ 

অ্যামটব মহাসচিব আরো বলেন, ‘সরকার নিয়মিতভাবে প্রতি বছর এই খাতের ওপর আরো বেশি করে করের বোঝা চাপিয়ে একে আরো দুর্বল করে তুলছে, গ্রাহকদের ওপর ফেলছে বাড়তি চাপ। ফলে দেশের জিডিপিতে মোবাইলের বর্তমান অবদান ৭ শতাংশ থেকে যে দুই অংকের ঘরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তা আর অর্জিত না-ও হতে পারে।’

মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোনের হেড অব পাবলিক অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত জানিয়েছেন, ‘২০২০-২১ সালের বাজেটে সম্পূরক শুল্ক বর্ধিত করায় কভিড-১৯ ও পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় মোবাইল সেবা ব্যবহারে গ্রাহকদের অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ডিজিটাল বাংলাদেশের সম্ভাবনার পথে অন্তরায়। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করছি।’ 

বাংলালিংকের সিইও এরিক অস জানিয়েছেন, ‘আমাদের গ্রাহকরা ইতোমধ্যেই উচ্চ করের বোঝা বহন করে টেলিকম সেবা গ্রহণ করছেন। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হলে তা অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের গ্রাহকদের প্রভাবিত করবে।’

এদিকে বাজেটে শুল্ক আরোপ নিয়ে যখন এত এত তুলকালাম, তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘মোবাইলে বর্তমান কলরেট অনেক কম। তাই অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। তবে কথা বলার প্রবণতা কমানোর জন্য কলরেটে আরো ৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়নি। বরং কলরেট কম তাই মাত্র ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।’ ব্যয়ের সক্ষমতাও মানুষের আছে বলেও দাবি করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা সমস্যা হচ্ছে, কত শতাংশ বাড়ানো হলো সেটা বিবেচনা না করেই এর বিরোধিতা করা। এক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এটাতে মানুষের তেমন ক্ষতি হবে না।’ 

এনবিআর চেয়ারম্যানের বক্তব্যে দ্বিমত জানিয়েছেন অনেকেই। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জানিয়েছেন, ‘মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বসানো ঠিক নয়। কারণ এ ধরনের কর সাধারণ মানুষের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।’ 

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে যে নীতি সরকার হাতে নিয়েছে, তা ভোক্তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। যেমন মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে কথা বলায় খরচ বাড়বে। স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তারা খরচ করতে নিরুৎসাহিত হবেন।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh