করোনায় সর্বনাশ, করোনাতেই বসবাস!

আবুল খায়ের

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২০, ০৮:৪০ এএম

মানব সভ্যতার ইতিহাসে তাবৎ পৃথিবীর মানুষ কয়েক দশকের মধ্যে এমনতর মহামারির মুখোমুখি হয়েছে বলে জানা যায় না। করোনাভাইরাসটি পৃথিবীবাসীকে শুধু স্তব্ধ করেই দেয়নি, জীবন ও জীবিকার মধ্যে পার্থক্য রেখাটিও মুছে দিয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের অবিশ্বাস, আপন-পর কেউ এই রোগে আক্রান্ত মৃত্যু পথ-যাত্রীকে মুখে দু’ফোটা পানি দেয়া তো দূরে থাক, শেষ যাত্রায় রক্ত সম্পর্কিত কাউকে পাশেও পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষকে অস্পৃশ্যে পরিণত করেছে এ ভাইরাসটি। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, যীশু খ্রিস্ট তথা ঈশা নবীর সময় কুষ্ঠ রোগের ব্যাপক বিস্তারে মহামারি রূপ পরিগ্রহ করলে, ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বাসে মানুষ আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এবারের করোনাভাইরাসটি সাম্যবাদী রূপ পরিগ্রহ করায় ধনী-গরিব কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। 

মরণঘাতী এই ভাইরাসে অদ্যাবধি পৃথিবীব্যাপী প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সার্স ভাইরাসসহ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার এখন পর্যন্ত কোনো টিকা আবিষ্কৃত না হলেও এসব রোগের চিকিৎসা আছে; কিন্তু করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারে বহু দেশের বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেলেও কোনো ইতিবাচক ফলাফল এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রেখেছে। সঙ্গত কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস আর স্যানিটাইজার ব্যবহার করে এই রোগ থেকে বাঁচার পথে হাঁটছে পৃথিবীর মানুষ। আর লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষগুলো ত্রাণ ও প্রণোদনা নির্ভর হয়ে পড়েছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। ধর্ম-কর্মে বিধি নিষেধে মানুষ ক্রমেই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে পরিত্রাণের প্রার্থনা ভিন্ন বিকল্প কিছু খুঁজেও পাচ্ছে না।

এ বছর হজেও যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আগামী বছরটি মানব জাতির জন্য নানাবিধ বিপর্যয়ে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সাধারণ ছুটি বাদ দেয়ার কারণে করোনায় আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। এখন জনগণকে নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে বাজেট-পূর্ব অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে ভৌতিক বিদ্যুৎ বিল দিয়ে ব্যবহারকারীদের বে-কায়দায় ফেলে দিয়েছে। প্রতি বছর বাজেট-পূর্ব মে’তে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো এমনতর জনরোষ সৃষ্টিকারী খেলায় মেতে ওঠে আর এই মহামারির দুর্যোগেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাবে বহু জীবন বলি হয়েছে, যেমন ১৮১৭ সালে কলকাতা থেকে ছড়িয়ে পড়া কলেরায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। বিগত ১৮০০ সালে ইয়েলো ফিভার, ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা, ১৯৬০ সালে গুটি বসন্ত, ১৯৬৮ সালে ফ্লু ভাইরাস এবং ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মানব জাতিকে মৃত্যুর দোড়গোড়ায় নিয়ে গিয়েছিল। মহামারি হিসেবে ১৭২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্লেগ রোগে কমবেশি ১ লাখ ২৬ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। 

১৮২০ সালে কলেরা ফ্রান্সসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯২০ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশ্বের ৫ কোটি জীবনের অবসান ঘটায়। তবে এসব রোগের অনেক প্রতিষেধকসহ চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে শত বর্ষ পর পর পৃথিবী নানা ধরনের মারাত্মক রোগের সম্মুখীন হয়েছে- চিকিৎসা বিজ্ঞান এমনটাই বলে। ২০২০ সালে কভিড-১৯ নামে করোনাভাইরাসে মানবসভ্যতা আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্মম অত্যাচার, ভারসাম্য রক্ষাকারী বন্যপশু ও কীট-পতঙ্গকে রসনা পূরণে অনুষঙ্গ করায়, এসব মহা দুর্যোগের কারণ বলেও পশু-পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন। পবিত্র ইসলাম ধর্মেও হালাল ও হারাম খাদ্যের স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মে জীব হত্যা মহাপাপ বলে উল্লেখ থাকলেও, এ ধর্মে বিশ্বাসী বিশাল জনগোষ্ঠী পশু-কীট আর পতঙ্গ নিধন কাজে অতি মাত্রায় জড়িত।

পরিশেষে এটা স্পষ্ট যে, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, সার্স ও এইডসের যেমন প্রতিষেধক বা টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি, তেমনি চলমান করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা সফল হয়ে যাবেন বলে আশা করাটা সমীচীনও হবে না। তাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া আর ম্যালেরিয়া কিংবা জন্ডিসের মতোই হয়তো মানব জাতিকে করোনার সঙ্গে বসবাস করতে হবে।

অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে টিকে থাকা যদিও প্রায় অসম্ভব, তবু আশাবাদী হয়ে বলা যায়, চিকিৎসাবিজ্ঞান দ্রুত এই রোগের প্রতিষেধক তথা টিকা আবিষ্কারে সক্ষম হোক।


আবুল খায়ের , অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক, পিএমও

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh