রাবেয়া আশরাফী পিংকি
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২০, ১০:৪৪ এএম
৭৫ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। সে যুদ্ধে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ও জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ দেশের শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে, পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রসারণ ও পুনরুদ্ধারের মতো সুবিশাল কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। বর্তমানে বিশ্ব নতুন আরেক যুদ্ধের সম্মুখীন। এবারে শত্রু এক অদৃশ্য ভাইরাস। দেখতে না পাওয়া এ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আরো একবার নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সাধারণ মানুষের আয় কমছে, লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। এই মহামারির প্রভাব অর্থনীতিতে কতটা প্রকট হয়ে উঠতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমরা যে বড় ধরনের ধাক্কার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, সে বিষয়ে সবাই নিশ্চিত। বিশ্ব ব্যাংকের দেয়া সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনীতি সবচেয়ে বড় সংকোচনের মুখে পড়তে যাচ্ছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন গভীরতর মন্দা ধেয়ে আসছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের ‘২০২০ গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে বাজে মন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর সামগ্রিকভাবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ৫.২ শতাংশ সংকুচিত হবে। অথচ জানুয়ারিতে দেয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২.৫ শতাংশ বাড়বে। বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রাক্কলন অনুযায়ী অর্থনীতি সংকুচিত হলে, এটি হবে ১৫০ বছরের মধ্যে চতুর্থ গভীরতর মন্দা। এর আগে ১৯১৪, ১৯৩০-৩২ এবং ১৯৪৫-৪৬ সালে মহামন্দায় নিমজ্জিত হয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারি এবং শাটডাউন কর্মসূচির প্রভাব সবাই খুব দ্রুত ও ব্যাপকভাবে অনুভব করবে। এর মধ্যে কারও ভোগান্তির মাত্রা বেশি হবে, আবার কারও একটু কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বের উন্নত অর্থনীতিগুলো সাত শতাংশ সংকুচিত হবে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও সংকুচিত হবে; কিন্তু এই হার মাত্র ২.৫ শতাংশ। অঞ্চলভিত্তিক এই পার্থক্য হবে আরও ব্যাপক। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে ইউরো অঞ্চলে সংকোচন হবে বেশি, ৯.১ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ০.৫ শতাংশে দাঁড়াবে; যা ১৯৬৭ সালের পর সবচেয়ে শ্লথ। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ২.৭ শতাংশ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার অর্থনীতি ৪.৭ শতাংশ সংকুচিত হবে।
কভিড-১৯-এর প্রকোপ ঠেকাতে লকডাউন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের উপার্জন কমে গেছে। এ অবস্থায় মাথাপিছু আয় ৩.৬ শতাংশ কমে যাবে বলেও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে প্রাক্কলন করা হয়েছে। মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার কারণে এ বছর লাখ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্য বরণ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ৯০ শতাংশ দেশেই মাথাপিছু উৎপাদন কমবে। এই হার ১৮৭০ সালের পর সর্বোচ্চ। এ ছাড়া মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার ফলে সাত থেকে ১০ কোটি মানুষ অতি-দারিদ্র্যের মুখে পতিত হবে। যেসব দেশে কভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি এবং যেসব দেশ বৈশ্বিক বাণিজ্য, পর্যটন, কমোডিটি পণ্য রফতানি এবং বহির্বিশ্বের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল, তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১৯৯৮ সালের পর কভিড-১৯ এর কারণে প্রথমবারের মতো বিশ্বে দারিদ্র্যের হার বাড়তে যাচ্ছে। তখন এশিয়ার আর্থিক সংকটের কারণে দরিদ্রতার হার বেড়ে গিয়েছিল। নতুন পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৈশ্বিক দরিদ্রতার হার (দৈনিক ১.৯০ ডলারের কম অর্থে জীবনব্যয় নির্বাহ করা) ৮.২ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি বছর ৮.৬ শতাংশ হবে। অর্থাৎ, গত বছর বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬৩ কোটি ২০ লাখ, যা এ বছর বেড়ে হবে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ। অথচ গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন প্রতিবেদনে দরিদ্রতার হার হ্রাসের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ইকুইটেবল গ্রোথ, ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেইলা পাজারনাসোইগলো বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জরুরি দিকগুলো চিহ্নিত করা। এরপর আরো বেশি মানুষ যাতে দরিদ্র ও বেকার না হয়ে পড়ে, সে জন্য দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে।’
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রসপেক্টস গ্রুপের পরিচালক আহিয়ান কোজ বলেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে হিসাব করে বলা হচ্ছে, কভিড-১৯ মন্দার সৃষ্টি করবে এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে তা বেশি অনুভূত হবে। এ ছাড়া ছয় দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো উৎপাদনে সংকোচনের সম্মুখীন হবে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।’
মূলত স্বাভাবিক সময়ে একটি দেশের অর্থনীতি তার নিজস্ব গতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে। সে দেশের পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসাধারণের আয়ও বাড়ে এবং সামগ্রিকভাবে জিডিপিও বৃদ্ধি পায়; কিন্তু কিছু কিছু সময় আসে, যখন পণ্য ও সেবার মূল্য কমতে থাকে। যখন দুই থেকে তিন মাস অথবা গোটা এক প্রান্তিক ধরে এমনটা ঘটতে থাকে, তখনই অর্থনীতি মন্দাগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। গত বছরের শেষের দিকে চীন থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। দীর্ঘ এ সময় ধরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমও শ্লথ হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো লকডাউন-শাটডাউন চলছে। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় লোকসান গুনতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মন্দায় পড়বে বলে সতর্ক করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মন্দায় নিমজ্জিত হয়েছে জাপান ও জার্মানি। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা হলেও হ্রাস করতে সুদের হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এক জরিপে বলা হয়েছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের মন্দায় নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা ৩৫ শতাংশ। জানুয়ারিতে একই জরিপে যা ছিল ২৫ শতাংশ। প্যাসিফিক ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (পিমকো) সম্প্রতি তাদের গ্রাহকদের জানায়, করোনাভাইরাস মহামারি প্রচ্ছন্ন মন্দার সৃষ্টি করবে। অথবা যুক্তরাষ্ট্রে টানা দুই প্রান্তিক এবং ইউরো অঞ্চলে প্রথমার্ধ পর্যন্ত ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি থাকবে। এ ছাড়া আকস্মিকভাবে এই মন্দা সৃষ্টি হওয়ার কারণে ভোগান্তির মাত্রাও বেশি হবে বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিওএফএ সিকিউরিটিজের মার্কিন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান মিশেল মেয়ার বলেন, ‘বিষয়টি খুব দ্রুত ঘটছে, তাই এর ধাক্কার ওজনটাও অনেক বেশি হবে।’
সামগ্রিক বাস্তবতায় দুই ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভূত হতে পারে বলে অনুমান করছে বিশ্বব্যাংক। এক. ধারণার চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে কভিড-১৯ বিরাজ করবে এবং বর্তমানে চলমান বিধিনিষেধও অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় ৮ শতাংশ সংকুচিত হবে। দুই. যদি খুব শিগগিরই নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মসূচিগুলো তুলে নেওয়া হয়, তাহলে এই সংকোচনের মাত্রা হবে ৪ শতাংশ। তা সত্ত্বেও ২০০৯ সালের আর্থিক সংকটের পর এটি হবে দ্বিগুণ মাত্রার সংকোচন।