ড. মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২০, ০৮:৫১ এএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২০, ০৮:৫২ এএম
কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব চীন থেকে দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর কোনো সীমারেখা না মেনে, উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর মানুষকে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। এ মহামারির ফলে গ্লোবাল সাউথের বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো ও গ্লোবাল নর্থ বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য কী বার্তা বহন করে তা জানা দরকার। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও নিম্ন জীবনযাত্রার মানসহ নানা সমস্যা। গোবাল সাউথ পৃথিবীর জনবহুল অঞ্চল। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। জীবিকা নির্বাহের জন্য এই আঞ্চলটি গ্লোবাল নর্থের তুলনায় মারাত্মক হুমকির মধ্যে আছে।
গ্লোবাল সাউথ তাদের উন্নয়ন ও সমস্যা মেটানোর জন্য অনেকাংশে গ্লোবাল নর্থের ওপর নির্ভরশীল। গ্লোবাল সাউথ অনুকরণ করে তাদের উন্নয়ন মডেলকে। করোনভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গ্লোবাল নর্থ কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাও অনুকরণ করেছে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো। গ্লোবাল সাউথের তুলনায় গ্লোবাল নর্থে করোনাভাইরাসের আক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু গ্লোবাল নর্থের উন্নত স্বাস্থ্য সুরক্ষা, উন্নত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সুশাসন তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক সহজ। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করেছে তারা।
করোনাভাইরাস পৃথিবীর পুরনো মানচিত্রকে পরিবর্তন করে নতুন এক করোনাভাইরাসের মানচিত্র তৈরি করেছে। প্রথমে চীনে আঘাত করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়ে এই মহামারির আক্রমণ চলে যায় সুদূর ইউরোপে। ইউরোপের দেশগুলোকে প্রায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে উপস্থিত হয় উত্তর আমেরিকায়। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, আফ্রিকার দেশগুলোতে আক্রমণ চালায়। করোনার এ বৈশ্বিক মানচিত্র দেখে মনে হচ্ছে যে, করোনাভাইরাস উন্নত বিশ্বে আক্রমণ চালানোর পরে আসে গ্লোবাল সাউথে। গ্লোবাল সাউথের প্রতি করোনা কিছুটা নমনীয় ছিল, একটু সময় দিয়েছে চিন্তা করতে, প্রস্তুতি নিতে কীভাবে এ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করবে; কিন্তু এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। বরং দাবি করেছি করোনা থেকে আমরা আরো বেশি শক্তিশালী। করোনা যখন পুরো উন্নত বিশ্বকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে, তখন আমরা দাবি করেছি করোনা আমাদের কিছুই করতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কী আমরা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো গ্লোবাল নর্থের দেশগুলো যেভাবে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভূমিকা পালন করেছে- সেগুলো কী পুরোপুরি আমরা অনুসরণ করা সম্ভব কিনা, তা অবশ্যই পরীক্ষা করা দরকার। আগেই বলেছি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলার সুযোগও রয়েছে কম। এই সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও গ্লোবাল নর্থের মতো সামাজিক দূরত্ব, লকডাউনের মতো পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে ; কিন্তু বিস্ময় হলো আমরা যদি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মানুষের সচেতনতা ও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সচেতনতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করি, তাহলে সেখানেও একটি বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে যে সব উপাদানের মাধ্যমে মানুষকে করোনামুক্ত করার প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়েছে, সেই সরঞ্জামগুলো জোগাড় করার ক্ষেত্রেও সীমিত সুযোগ ও সামর্থ্য রয়েছে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে। আশ্চর্যের বিষয় হলো যদিও গ্লোবাল নর্থ এবং সাউথের মধ্যে করোনা মোকাবেলায় সামর্থ্য ও সুযোগ সমান নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকার করে নিলেও তারা গ্লোবাল সাউথের জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের চিন্তায় শুধু গ্লোবাল সাউথের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বা বাস্তবসম্মতভাবে কীভাবে সমাধান করা যায় সেদিকে তাদের খেয়াল নেই।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্লোবাল সাউথের কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির মানুষ করোনাভাইরাসকে তাদের সুবিধার উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছে। করোনাকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
এ অঞ্চলের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দরিদ্র, হতদরিদ্রের সংখ্যাও রয়েছে অনেক। চাকরিতে ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা নেই। বেকার ভাতার প্রচলন ও সামর্থ্যও নেই। এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ খেটে খাওয়া মানুষ, দৈনিক কর্মের মাধ্যমে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। একদিকে যদি বাইরে যান করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়, আর যদি ঘরে থাকেন তাহলে অভুক্ত থেকে মরে যাওয়ার ভয় গ্লোবাল সাউথের বিপুল জনসংখ্যার। এর মৌলিক কারণ হচ্ছে গ্লোবাল সাউথ এর দেশগুলোর সামর্থ্যরে অভাব।
গ্লোবাল সাউথ ও নর্থের জনগণের চিন্তা-চেতনা, সচেতনতা একরকম নয়। আমাদের ভেতরে অসচেতন থাকা বা নিয়ম না মানার একটা প্রবণতা দীর্ঘ দিনের। গ্লোবাল নর্থ ও সাউথের সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে অনেক ব্যবধান। আর এগুলোর জন্য এককভাবে তাদেরকে দায়ী করা ঠিক নয়, কারণ আমাদের ভেতরে এ ধরনের চিন্তা চেতনা, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা ও আমাদের একটি ভঙ্গুর জাতিতে রূপান্তরিত করার পেছনে মূলে রয়েছে দীর্ঘ দিনের উপনিবেশিক শাসনের ফল। আমাদের রয়েছে এক ধরনের কলোনিয়াল মাইন্ড।
গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে সেবা ও পরিষেবা দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের সীমাবদ্ধতা এবং আন্তরিকতার দুর্বলতা রয়েছে। এ ছাড়াও এসব দেশে সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণির জন্য এক ধরনের স্বাস্থ্যসেবা আর সাধারণ মানুষের জন্য রয়েছে অন্য ধরনের স্বাস্থ্যসেবা। এখানে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী সব ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে, যা সচরাচর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় না।
গ্লোবাল সাউথে করোনাভাইরাসের ট্র্যাজেডি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো বড় ধরনের ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে। চরম বেকারত্ব, দরিদ্রতা এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে এখানকার দেশগুলোতে।
ড. মো. কামাল উদ্দিন, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়