সৌর শাইন
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২০, ০৩:২২ পিএম
প্রেম-বিদ্রোহ-সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য সাম্রাজের পাশাপাশি রয়েছে অনন্য গদ্যের ভুবন। এর মধ্যে গল্প-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। যদিও কবি সর্বাধিক পরিচিত কবিতার ঝঙ্কারে, তবে উপন্যাসের পৃথিবীতেও যে তার পদচারণা রয়েছে, তা প্রমাণ করে তিনটি বিস্ময়কর উপন্যাস। নজরুলের সাহিত্যজগতে প্রথম প্রবেশ গদ্যের মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীতে তিনি কবিতায় মনোনিবেশ করলেও সেই সাথে গদ্যচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসে যা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে ভিন্নতার ছোঁয়া। ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’ এ তিনটি উপন্যাসই স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল। নজরুল তার উপন্যাসে সৃষ্টিতে নিজস্ব দ্রোহ-কাব্যিক ভাষা ও চমৎকার সুখপাঠ্য কাহিনী বিন্যাসে নিঃসন্দেহে সচেষ্ট ছিলেন।
তিনি গোটা কয়েকটি উপন্যাস রচনার মধ্যে দেখিয়েছেন শক্তিশালী লেখনীর প্রমাণ। তাছাড়া নজরুলের প্রকৃত স্বরূপ প্রেম-সাম্য ও বিপ্লব আদর্শকে এসব উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম পত্রোপন্যাস, যেখানে সমাজের জটিলতা ও অতৃপ্ত প্রেম কাহিনী পত্রে পত্রে বর্ণিত। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটিকে বলা যায় প্রথম সাম্যবাদী উপন্যাস, অন্যদিকে ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসটি দেশমাতৃকার প্রেম ও বিল্পবী চেতনার দৃষ্টান্ত।
‘বাঁধনহারা’ নজরুলের প্রথম উপন্যাস, যা ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে, পরে ১৯২৭ সালে (১৩৩৪ শ্রাবণ) গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। এ উপন্যাসে নায়ক চরিত্র নুরুল হুদা। পিতৃ-মাতৃহীন নুরুল হুদাকে স্নেহভরে বাড়িতে আশ্রয় দেয় রবিয়ল। সেই সাথে নুরুল হুদার প্রতি রবিয়লের স্ত্রী রাবেয়ার স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ পায়। রাবেয়ার ভাই মনুর সাথে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। রবিয়লের ছোট বোন সোফিয়ার সই প্রতিবেশী সুন্দরী মাহবুবার সঙ্গে নুরুল হুদার প্রেম-ভালোবাসা হয়। এ ভালোবাসার সার্থক রূপ দেয়ার জন্য রবিয়লের মাধ্যমে নুরুল হুদা ও মাহবুবার বিয়ে ঠিক হয়।
কিন্তু হঠাৎ রহস্যজনকভাবে নুরুল হুদা কাউকে কিছু না বলে দূরে সরে যায়। যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে, চলে যায় দূর বিদেশে। কাক্সিক্ষত বিয়ে ভেঙে যাওয়া, মাহবুবার বাবার মৃত্যু প্রভৃতি ঘটনার ভেতর দিয়ে উপন্যাসের কাহিনী এগোয়। অতঃপর অপূর্ব সুন্দরী মাহবুবার বিয়ে হয় এক বৃদ্ধ জমিদারের সাথে। জমিদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাহবুবা বিধবা জীবনে প্রবেশ করে, আর উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি লাভ করে। সেনাবাহিনীর জীবন শেষে বাঁধনহারা নুরুল হুদার ফিরে আসার ইঙ্গিতের মধ্যে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সচেতন পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারে, নুরুল চরিত্র যে নজরুলেরই প্রতিচ্ছবি।
লেখক এ উপন্যাসে প্রচণ্ড আবেগ ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। চিঠিগুলো থেকে ইঠে এসেছে চাপা কষ্ট ও বেদনার বাষ্প। সবকিছুর মূলে হারানো স্মৃতি দুঃখের প্রতিলিপি হয়ে উঠেছে। তবে উপন্যাসে যথেষ্ট শিথিলতা লক্ষণীয়। বর্ণনার ভিড়ে কোথাও কোথাও অস্পষ্টতার ছাপ রয়েছে। যেন লেখক কোনো চরিত্রকেই শিল্পগুণে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে ইচ্ছুক নন। তবু প্রেমের অপ্রাপ্তি পাঠক মনে ভাবনার ঢেউ তুলতে সক্ষম।
নজরুলের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ প্রকাশ পায় ১৯৩০ সালে (বৈশাখ ১৩৩৭)। মৃত্যুক্ষুধা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের নিদারুণ দৈন্য, অর্থসংকট, সমাজ ও শ্রেণিবৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে উপলব্ধির প্রকাশ। এ উপন্যাসকে বলা যায় সাম্যবাদী চেতনাসম্পন্ন বাস্তুবাদী আখ্যান। শিল্পগুণ ও জীবনবোধের বিচারে খুঁজে পাওয়া যায় ভিন্ন রূপরেখা। এখানে শৃঙ্খলে আবদ্ধ সমাজের প্রকৃত চিত্র বিন্যাসে লেখক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যেখানে মৃত্যু ও ক্ষুধা একই তুলির আঁচড়ে দৃশ্যমান। কাহিনীর ক্যানভাস পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের দলিত জনগোষ্ঠীকে ঘিরে আরম্ভ হয়েছে। ধ্বনিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবার দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে চলমান জীবন সংগ্রাম, বেঁচে থাকার আকুতি।
ক্ষুধা ও মৃত্যুর মাঝেও লেখক প্রেমের চিত্র আঁকতে ভুল করেননি। ঘটনার প্রথম পর্বে কলতলায় দরিদ্র দুই মহিলার মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া দেখা যায়। ঝগড়াটা হিন্দু হিড়িম্বার সাথে মুসলিম গজালের মায়ের। গজালের বৃদ্ধ মায়ের সংসারে তিন বিধবা যুবতী পুত্রবধূসহ ডজনখানেক বাচ্চাকাচ্চা ও পুত্র প্যাঁকালে। এত বড় সংসারের ভার ১৮-১৯ বছরের রাজমিস্ত্রি কর্মী প্যাঁকালের ওপর ন্যস্ত। দারিদ্র্যপীড়িত সংসারের মুখগুলো ক্ষুধার যন্ত্রণার জন্য আহারের অপেক্ষায় থাকে। সেখানে এসে যুক্ত হয় স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা প্যাঁকালের প্রসব বেদনাতুর বোন। জন্ম নেয় নতুন মুখ, নতুন স্বপ্ন-আশা। দুঃখ-আনন্দে ঘটনা এগোতে থাকে। একসময় রুগ্ন সেজো বউয়ের মৃত্যু এসে কাঁদিয়ে যায় পাঠক হৃদয়।
উপন্যাসে পাওয়া যায় কুর্শি নামের এক খ্রিস্টান তরুণীকে, যার সাথে প্যাঁকালের প্রেমের সম্পর্ক। অপরূপা সুন্দরী বিধবা মেজো বউকে তার বড় বোনের স্বামী বিয়ে করতে আগ্রহী হয়। অনটন-দুর্দশার পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারিরা সাহায্যের ছলনায় দারিদ্র্যপীড়িতদের ধর্মান্তরিত করার নানা চেষ্টা চালায়। বিধবা সুন্দরী মেজো বউয়ের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণে নতুন নাম হয় হেলেন। বিপ্লবী নেতা আনসারের সাথে প্রেমের মাধ্যমে হেলেন আবার মুসলিম হয়। বিপ্লবী চেতনা ও দেশমাতৃকার কর্মকাণ্ডের জন্য আনসারের কারাবরণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। উপন্যাসের গাঁথুনিতে কোথাও কোথাও সামঞ্জস্যের দুর্বলতা মনে হলেও জীবন-মৃত্যু-ক্ষুধা-আনন্দ-বেদনার মাঝে প্রেম, বিপ্লব ও সাম্যের সুরে এক অপূর্ব সৃষ্টিকর্ম ‘মৃত্যুক্ষুধা’।
ঔপন্যাসিক নজরুলের সর্বশেষ উপন্যাস স্বদেশী বিপ্লবী চেতনার অপূর্ব আখ্যান ‘কুহেলিকা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ১৯৩১ সালে। এ উপন্যাসে লেখক প্রধান চরিত্র স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবী জাহাঙ্গীরের মধ্য দিয়ে সমসাময়িক স্বদেশ চেতনা বোধ, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতির সফল প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। সেই সাথে ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও মিথকথনের মাধ্যমে অনন্যপ্রবাহ সঞ্চারিত করেছেন। ঘটনার সূত্রপাত তরুণ কবি হারুনের মেসে নারীকে কুহেলিকা বলে রসাত্মক কথোপকথনের মাধ্যমে। জাহাঙ্গীরের জীবনে দাগ এঁকে যাওয়া নারীদের ঘিরে এগোতে থাকে সময়। সে নারীদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চম্পা ও ভূণী চরিত্র। বিপ্লবী জাহাঙ্গীরের দ্বীপান্তরের মাধ্যমে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। জাহাঙ্গীরের পারিবারিক জীবন থেকে জানা যায় মা-বাবার বিবাহবন্ধন ছাড়াই তার জন্ম হয়েছে। মা-বাবার দূরত্ব তার মধ্যে কিছুটা হলেও ভিন্নতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। নজরুল তার সমসাময়িক জাহাঙ্গীরের মতো চরিত্র সৃষ্টি করে সত্যিই সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, যা এ সমাজকে পাল্টে দেয়ংর প্রত্যয় ঘোষণা করে।
কাজী নজরুল ইসলাম তার স্বল্প সময়ের সাহিত্যজীবনে কবিতার পাশাপাশি মাত্র তিনটি উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে নিজেকে ঔপন্যাসিক হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তার চেতনার পূর্ণ প্রকাশের জন্য তিনি বরাবরই সচেষ্ট ছিলেন।