ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২০, ০১:১৪ পিএম
ধরে নেওয়া হয় সেইসব রূপকথাই হলো লোক ঘরানা থেকে উঠে আসা গল্প, সময়ের প্রত্যুষ থেকে গল্পকথকদের মাধ্যমে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে এসেছে। এ কথা যদিও সত্যি যে বেশির ভাগ রূপকথার শেকড়ই আছে মৌখিক লোককথায় নিহিত, কিছু কম বা কিছু বেশি মাত্রায়, অতি পরিচিত এমন অনেক গল্পও আছে, যা প্রকৃতপক্ষে এসেছে সাহিত্য-সংক্রান্ত উৎস থেকে।
উনিশ শতকে ডেনমার্কে, লেখক হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন (১৮০৫-১৮৭৫) সর্বকালের সর্বাধিক ভালো-লাগা রূপকথাগুলোর কিছু রচনা করেছিলেন : দি লিটল মারমেইড, দি ওয়াইল্ড সোয়ানস, দি প্রিন্সেস অ্যান্ড দি পী, দি এমপাররস নিউ ক্লোদস, দি নাইটিংগেল, দি টিনডার বস্ক, দি আগলি ডাকলিং, দি স্টেডফাস্ট টিন সোলজার, দি রেড গুজ, দি ফার ট্রি, দি স্নো কুইন (তাঁর সেরা কীর্তি)-সহ আরো অনেক রচনা।
এখানে আরও উল্লেখ করা যায়- আন্ডারসেন কেবল রূপকথা রচনা করেননি, তিনি অসংখ্য চমৎকার কবিতারও রচয়িতা; কিন্তু দুর্ভাগ্য আন্ডারসেন-এর সেরা রচনা বলে রূপকথাকেই উল্লেখ করা হয়। ফলে কবিতার কদর আর হয়নি, অসম্ভব সুন্দর চিত্রকল্পে নির্মিত, ছোট ছোট বাক্যে তা পাঠমুগ্ধ করে রাখে সচেতন কাব্যপ্রেমিককে।
হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের নিজের জীবনে ছিল রূপকথায় পাওয়া যায় এমন বেশ কিছু উপাদান, যা রূপকথার চেয়ে কম নয়- এক দরিদ্র মুচির ঘরে তাঁর জন্ম, আর মৃত্যুর সময়ে তিনি এক ধনী ও বিখ্যাত মানুষ, সারা পৃথিবীতে সম্মানিত, বহু রাজা ও রাণীর নিকটজন। আজ যদিও অ্যান্ডারসেন পরিচিত একজন শিশু সাহিত্যিক রূপে, জীবৎকালে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর অন্য সাহিত্য কীর্তিগুলোর জন্যও, যার মধ্যে আছে ছয়টি উপন্যাস, পাঁচটি ভ্রমণ-দিনলিপি, তিনটি আত্মজীবনী আর অজস্র কবিতা ও নাটক।
অ্যান্ডারসেনের অধুনা যে ভাবমূর্তি (১৯৫২ সালের ড্যানি কে অভিনীত ‘হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন’ নামক চিনি-ঢালা এক ছায়াছবিতে যেমন আঁকা হয়েছে) তা হলো এক শিশুর মতো সরল, নিরীহ গল্প বয়নকার, যিনি তাঁর নিজের গল্পগুলোরই কোনো চরিত্র। অ্যান্ডারসেন এবং তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গের যে সব চিঠি আর ডায়েরি, সে সবে কিন্তু একেবারে অন্য এক মানুষের ছবি ধরা পড়ে : একজন ক্ষুরধার বুদ্ধিমান, উচ্চাকাক্সক্ষী লেখক, যাঁর অতীত রুক্ষ আঁকিবুকি দাগে ভরা, অভিজাত সমাজের প্রতি যাঁর এক ভালোবাসা, আর এক লাঞ্ছিত প্রাণ। ঠিক একইভাবে, অ্যান্ডারসেনের রূপকথাগুলো, মূল ড্যানিস ভাষায় পড়লে বোঝা যায় যে সেগুলো, প্রভূত এবং যথেচ্ছ অনূদিত যত সংস্করণে, পুনর্কথনে এবং অন্য মাধ্যমের দ্বারা একাধারে আত্মসাৎ ও পরিমার্জনার ফলে যে রকম সাদাসিধে, শিশু-মনের উপযোগী নীতিকাহিনি রূপে রচিত হয়ে উঠেছে।
আসলে তার থেকে অনেক বেশি পরিশীলিত এবং বহুস্তরবিশিষ্ট। তিনি তেমন সরল, শিশুসুলভ লেখক ছিলেন না যে পরীরা তাঁর কানে কানে ফিসফিসিয়ে যা বলেছে, আজগুবি সে সব কল্পনাই কেবল লিখে গেছেন; তিনি ছিলেন সিরিয়াস এক শিল্পী, সাহিত্যের এক দক্ষ কারিগর, মনুষ্য প্রকৃতি আর ঊনবিংশ শতাব্দীর ডেনমার্কের এক অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন নিরীক্ষক।
বড় হয়ে ওঠার পরে, অ্যান্ডারসেনের গল্পগুলোর সংক্ষেপিত এবং পরিবর্তিত সব সংস্করণে তাঁর গদ্যপাঠ করা, এক আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারেÑ অনেকটাই যেমন জে. এম. ব্যারীর কুশলী, ধূর্ত, নাশকতামূলক কাহিনি ‘পিটার প্যান’ মূল রচনায় পাঠ করলে হয়। অ্যান্ডারসেন এবং ব্যারী দুজনেই ছোটদের এমন সব গল্প লিখতেন যাতে তাঁরা সযত্নে, তাঁদের দক্ষ হাতে পুঁতে রাখতেন কমেডি, সমাজ-সমালোচনা, ব্যঙ্গ, আর দর্শন, প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের উদ্দেশ্যে।
এ স্টাইলের জনক অ্যান্ডারসেন স্বয়ং আর ব্যারীর মতো লেখকেরা তাঁর কাছে এ বিষয়ে তেমনই ঋণী, যেমন কিনা আজকের অজস্র শিশুপাঠ্য কাহিনিকার, যাঁদের মধ্যে আছেন জেন ইয়োলেন, রোয়াল্ড ডাল, ডায়না উইন জোনস, ফিলিপ পুলম্যান এবং জে. কে. রাউলি- যাঁরা তাঁদের প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের কাছে সমাদৃত।
আন্ডারসেন বলতেন- ‘বয়স্কদের উপযোগী কোনো আইডিয়া পেলেই আমি তা আঁকড়ে ধরি আর তার পরে যখন গল্পটা ছোটদের বলি, এ কথা সর্বদা মনে রাখি যে বাবা-মায়েরাও প্রায়শই মন দিয়ে শোনেন, আর তাই তাদের মনের জন্যেও আমায় অবশ্যই কিছু দিতে হবে।’
তাঁর রূপকথাগুলো জাদুজগাতীয় অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে পড়া যায় সহজেই, কিন্তু কোনো বিচারশীল পাঠকের কাছে ধরা পড়ে আরও বেশি কিছু। অ্যান্ডারসেনের নিজের জীবন থেকে, এবং তাঁর চমকপ্রদ জীবনের যাত্রাপথে যে অজস্র দুনিয়ায় তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, সে সব থেকেও তুলে নেওয়া চরিত্র সম্ভার ভিড় করে আছে তাঁর রচনায়।