নাজাতের ১০ দিন শুরু

পবিত্র রমজানের তৃতীয় ও শেষ ১০ দিন অর্থাৎ নাজাতের ১০ দিন শুরু হল আজ থেকে। এর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটল রহমত ও মাগফিরাতের ২০ দিনের। 

গত ২০ দিনের মধ্যে প্রথম ১০ দিন ছিল রহমতের ও দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাতের। শেষের ১০ দিনকে ইতকুম মিনাননার তথা নাজাতের ১০ দিন বলা হয়। বিভিন্ন ইবাদতের কারণে রমজানের শেষ ১০ দিন অনেক ফজিলতপূর্ণ। এই সময়েই শুরু হয়েছে ইতিকাফ ও লাইলাতুল কদর। 

রমজানের শেষ ১০ দিনে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারী: ২০২০) 

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সেই সফল। এবং পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। (আল ইমরান-১৮৫)

রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের প্রতিটি দিবা-রাত্রিতেই আল্লাহর দরবারে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয় এবং রমজানের প্রতি দিবারাত্রিতে প্রত্যেক মুসলমানের একটি দোয়া কবুল হয়। (বুখারি)

সুতরাং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এসব নেক আমল বেশি বেশি করে করতে হবে। এছাড়া গোটা রমজান জুড়েই হযরত মোহাম্মদ (সা.) চারটি কাজ অধিক হারে করার জন্য বলেছেন। ১. কালেমার জিকির, ২. ইস্তেগফার, ৩. জান্নাত চাওয়া, ৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রার্থনা করা। 

রমজানের এই শেষ ১০ দিনেও এই চারটি কাজ বেশি বেশি করতে হবে। সর্বোপরি নিজের গোনাহের জন্য কান্নাকাটি করে দোয়াও করতে হবে। কারণ আল্লাহর ভয়ে কন্দনরত মানুষের চোখের পানি আল্লাহ তাআলা বড় বেশি পছন্দ করেন।

মুয়াত্তা-ই-ইমাম মালেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূল (সা.) জানতে পারলেন, পূর্বেকার উম্মতের বয়স অনেক দীর্ঘ হতো এবং সে তুলনায় নিজের উম্মতের বয়স অনেক কম। সুতরাং আমার উম্মতের আমলের পরিমাণ এ হায়াতের ব্যবধানে পূর্বেকার উম্মতের আমলের পরিমাণের সমান হতে পারে না। বিষয়টি অবগত হয়ে রাসূল (সা.) দুঃখিত হলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা লাইলাতুল কদর প্রদান করেন। যাতে এ সমস্যা ও দুঃখ দূরীভূত হয়। তাই এমন এক রাত দান করলেন যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) একদা সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর সামনে বনি ইসরাঈলের এমন এক আবিদ ব্যক্তির বর্ণনা করলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে বিরামহীনভাবে এক হাজার মাস জিহাদ করতে থাকেন। রাসূল (সা.) এর এ বর্ণনা শুনে সাহাবায়ে কেরাম সে লোকটির প্রতি বিমুগ্ধ হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহ পাক এ দীর্ঘ বয়সের বিকল্প স্বরূপ লাইলাতুল কদর প্রদান করেন।

আল কুরআনুল করীম লাইলাতুল কদরে নাযিল হয়েছে। এ রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের এক বিরাট জামায়াত নিয়ে দুনিয়ার বুকে অবতীর্ণ হন ও জগতবাসীর মধ্যে লাইলাতুল কদরের কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন। এ বিতরণের কাজ ফজর হওয়া পর্যন্ত অনবরত চলতে থাকে। লাইলাতুল কদর আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিরাট নেয়ামত- যার কোনো তুলনা হয় না। এ রাতে ইবাদতের একাগ্রতা হাসিল হয়। অন্তর গাফিল হয় না। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য পাপী বান্দাকে মাফ করে দেন। এ রাতে তওবা কবুল হয়, আসমান-যমীনের রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়। ইবাদতে মাশগুল মুমিনকে ফেরেশতারা সালাম করে। এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, তসবীহ-তাহলীল পাঠ করে কাটিয়ে অনেক সওয়াব অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।

‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’ (বুখারি ও মুসলিম)। এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)।

‘কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হলো রাত্রি জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুণ। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- ‘তারা রাত্রি যাপন করে রবের উদ্দেশে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে।’ (সূরা ফুরকান : ৬৪)

 রমজানের বিদায়ের সূর বেজে ওঠেছে। এ সময় বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে নাজাত হাসিল করা খুব জরুরি। কেননা জাহান্নাম থেকে নাজাত হাসিল করে জান্নাত লাভ করাই মুমিন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা। রাসুল (সা.) নিজে এ সময় ইবাদত বন্দেগি বাড়িয়ে দিতেন। 

আয়েশা রা. বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আগমন করতো, রাসূলে আকরাম (সা.) কোমর বেঁধে নিতেন (অর্খাৎ ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতেন), নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারবর্গকেও রাতে জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারী: ১৮৮৪) 

আয়েশা রা. আরো বলেন, ‘নবী করীম (সা.)রমজানের শেষ দশকে যে পরিমাণ ইবাদত বন্দেগি করতেন, তা অন্য সময় করতেন না।’ (মুসলিম: ২৮৪৫)

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে লাইলাতুল কদরে ঈমানের ও সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করবে, তার জিন্দেগির সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী: ১৭৬৮)

রমজানের শেষ ১০ দিনেই কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন।’ (সূরা বাকারা: ১৮৫) মহান আল্লাহ এ কোরআনকে লাওহে মাহফুজে রমজানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছেন। আর লাওহে মাহফুজ থেকে রাসুল (সা.) এর ওপর ২৩ বছরে প্রয়োজনানুসারে ধিরে ধিরে নাজিল হয়েছিল। সেজন্য এ সময় বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করা কোরআন মাজিদের হক বা অধিকার। 

রাসূল(সা;) বলেছেন, ‘রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে ইয়া আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বাধা দিয়েছি, অতএব আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, ইয়া আল্লাহ আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বাধা দিয়েছি, অতএব আমার সুপারিশ কবুল করুন। এরপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। (মুসনাদে আহমদ: ৬৬২৬) 

অন্য হাদিসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোরআন মজিদের একটি আয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনলো, তার জন্য বর্ধনশীল সাওয়াব রয়েছে, আর যে তা তেলাওয়াত করলো, কিয়ামত দিবসে তা তার জন্য আলোকবর্তিকা হবে। (মুসনাদে আহমদ: ৮৪৭৫)

এ সময়ে ইতেকাফের মতো অশেষ ফজিলতপূর্ণ ইবাদত রয়েছে। আল্লাহর হাবিব রাসুল (সা.)মদিনার জিন্দেগিতে কোনো রমজানে শেষ দশকের ইতেকাফ পরিত্যাগ করেননি। লাইলাতুল কদর তালাশের নিশ্চিত পদ্ধতি হলো ইতেকাফ। সাহাবায়ে কেরাম আওলিয়ায়ে ইজাম সকলেই ইতেকাফ করেছেন। মনিবের সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপনের এ এক অনিন্দ্য সুন্দর মাধ্যম। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন সব কিছু ত্যাগ করে মহান প্রভুর একান্ত ইবাদতে লিপ্ত থাকার মহা সুযোগ ইতেকাফ। 

আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘নবী (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর ২০ দিন ইতেকাফ করেছিলেন।’ (বুখারী: ২৬০)

মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনে সাদকাতুল ফিতর দেয়া হয়ে থাকে। সিয়াম-সাধনাতে বান্দার দোষ-ত্রুটি হয়ে থাকলে এর মাধ্যমে তার কাফফারা হয়ে যায়। তাছাড়া এতে গরিব-মিসকিনদের সাহায্যও করা হয়ে থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এটা (সাদকাতুল ফিতর) রোজার ভুল-ত্রুটিকে পবিত্রকারী ও মিসকিনদের খাবার।’ (আবূ দাউদ: ১৬১১) এ আমলের মাধ্যমে আমাদের রোজাগুলো ত্রুটিমুক্ত করার সুযোগ থাকে।

নাজাতের এ শেষ ১০ দিনে তাই আমাদেরকে নতুন উদ্যোমে ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। যে কয়টি দিন অবহেলায় কাটিয়ে দিয়েছি, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, বাকি দিনগুলো সিয়াম-কিয়ামের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল আমলের মাধ্যমে কাটাতে হবে। অন্যান্য নফল আমলের পাশাপাশি বিশেষ করে আমাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত কামনা  করতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : রমজান নাজাত

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //